অনিন্দিতা গোস্বামী
স্নেহলতার তামাটে ত্বকের ওপর রোদ পড়ে চকচক করছে৷ চামড়া তো গ্লসি না৷ তাই রিফ্লেকশন ধরা পড়ার কথা না৷ কিন্ত্ত সে বেশ পুরু করে কী যেন সব মেখেছে৷ ওই মেকাপ-টেকাপ যাকে বলে আর কি৷ ক্রিকেটাররা গালের ওপর জিংক মাখে না? গলা বুক ঘামে সপসপ করছে৷ এই পোড়া দেশে প্রায় সারা বছর গরম৷ তবে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠার এটাও একটা পজিটিভ দিক৷ অধিক শীতলতায় গাছও বাঁচে না, ব্যবসাও না৷ কারণ যে দু-চারটে লোক সেখানে বেঁচেবত্তে থাকে তারা উত্তুরে হাওয়ার দাপট থেকে বাঁচতে প্রায় সারাক্ষণ বাঙ্কারে সিঁদিয়ে আছে৷ কে আর সেখানে হাওয়াকে ঝুঁকে আজ… বলে আঁচল উড়িয়ে ছাদের ওপরে নৃত্য করবে৷ কোটি টাকার ইনভেস্ট হলে সে আলাদা কথা৷ পরিচালক ঠেলে খাদেও নামিয়ে দিতে পারে৷
পরের মাস থেকে আরও দু-চারজন লোক লাগবে ভিড় ম্যানেজ করতে৷ যাগগে আপাতত একা তাকেই সামলাতে হচ্ছে সব দিক৷ লাইন চলেছে এঁকেবেঁকে বহুদূর৷ শেষ দেখা যাচ্ছে না৷ স্নেহলতা দেখার খুব একটা চেষ্টাও করছেন না৷ এই না দেখার মধ্যে যে অনন্তের ফিলিং লুকিয়ে আছে তা কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাননা তিনি৷ এই যে রাস্তার বাঁকে গিয়ে মিলিয়ে যাওয়ার মতো একটা ধূসর অনুভূতি এইটাই প্রখর রোদকে কুয়াশা ঘেরা দার্জিলিং বানিয়ে দেয়৷ নাহলে রেশন দোকান থেকে ডাক্তারের চেম্বার, পৌঁছনোর আগেই পটল তুলতো অধিকাংশ লোক৷
দিদি জল খাবেন? বোতল এগিয়ে দিল একজন৷ এক ঢোক জল খেয়ে স্নেহ বললেন, ধন্যবাদ৷ কিন্ত্ত আপনি কী করে জানলেন আমি জল খেতে চাইছিলাম৷ ভদ্রলোক একটু কেশে নিয়ে বললেন, আপনি যেভাবে এই ব্যবসা ফেঁদে বসলেন৷ বুদ্ধি তো ওই, নদীর মতো৷ বুঝলেন কিনা? একবার আপনার জটা থেকে নেমেছে যখন তা ঢাল বেয়ে গড়াবেই৷ আমি ঝোপ বুঝে আপনার পদতলে বসে পড়েছি৷ যদি কিছু পাওয়া যায় বলে৷ ধর্না মঞ্চে বুক ঠুকে বসে পড়া পাবলিক আমরা৷ তাকিয়েই তো থাকি সারাজীবন ওপরের দিকে কখন কী খসে পড়বে বলে৷ একটা মেয়ে ছাতা নিয়ে এগিয়ে এলো৷ দিদি বড্ড রোদ৷ আপনার কষ্ট হচ্ছে না?
স্নেহ হাত দিয়ে ছাতা সরিয়ে দিয়ে বলল, আশ্চর্য, আজ এতো দেরি হচ্ছে কেন? এতো তো দেরি হবার কথা নয়৷
ভদ্রলোক বললেন যদি অনুমতি দেন একটা কথা বলতে পারি?
কারো অতিরিক্ত গায়ে পড়ে কথা বলা স্নেহলতা খুব একটা পছন্দ করেন না৷ তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে হনহন করে একটু পিছনের দিকে এগিয়ে গেলেন৷ আজ রোদ এতো তেতে উঠেছে, কেউ একটা উলটে পড়লেই ঝামেলা পাকবে৷ সামান্য হৈচৈ শুরু হলেই ভেস্তে যাবে ব্যাপারটা৷ না ভালো লাগছে না৷ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে৷ তা-ও সাড়াশব্দ নেই৷ হলোটা কী আজ!
স্নেহলতা ফের ওপরের দিকে তাকালেন৷ আর তক্ষুনি বটগাছের ডাল থেকে টপ করে তার কপালের ওপর এসে পড়ল কাকের বিষ্ঠা৷ এই জন্যেই তার কপালকে সবাই ঈর্ষা করে৷ ঝপ করে হাতে নিয়ে তিনি দেখলেন একখানা স্যান্ডো গেঞ্জি৷ এঃ, কেউ আর নিতে চাইবে না৷ তিনি লাইনের দিকে তাকালেন৷ লাইনে পিন পতনের শব্দ৷ মুহূর্তে সব চোখ আকাশ থেকে মাটিতে৷ পিঁপড়ে খুঁজছে সব৷ তিনি গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন নিয়ম মতো লাইনে যে প্রথম আছে তাকেই এটা নিতে হবে৷ এই কথা ঘোষণা হতেই ফোঁস করে উঠল সেই লোক৷ বলল, এতোক্ষণ রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে এখন এই৷ কিছুতেই হবে না ম্যাডাম৷ ওটা আপনার কপালে টপকেছে, আপনি রাখুন৷ দ্বিতীয় থেকে কাউন্টিং শুরু হবে৷
স্নেহলতা একটু থতমত খেয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন৷ বাব্বা, এতো রোয়াব৷ মালিক কে? ব্যবসা কার? তিনি বললেন প্রথমেই কিন্ত্ত বলা ছিল শর্ত৷
ভদ্রলোক তেড়িয়া হয়ে বললেন, রাখুন ম্যাডাম আপনার শর্ত আপনার কাছে৷ কী ভেবেছেন এঁ্যা?
একটা গেঞ্জির জন্যেও তো গলায় গামছা দিয়ে কমিশন আদায় করবেন৷ তাও আবার আপনার কী এক ছাতার মাথা নিয়ম, ফ্ল্যাট রেটে থুড়ি রেট ও নয় ফ্ল্যাট এমাউন্টের কমিশন৷ আরে বাবা অংক পারেন না একাউন্টেট পুষুন, ব্যবসা তো আপনার কম বাড়েনি৷ লাপ্পা খাইয়ে খাইয়ে আপনার মুরগি দুটোর তো বারো বাজিয়ে দিয়েছেন৷ এবার থেকে আর কিছুই পড়বে না৷
স্নেহলতা অনেকক্ষণ ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছিলেন, এবার রেগেমেগে বললেন, শুনুন আপনি গেঞ্জি নেবেন কি না?
লোকটা আরও মারমুখি হয়ে বলল, যদি না নিই আপনি কী করবেন?
এবার স্নেহলতা কিছুটা মিইয়ে গিয়ে বলল, পরের জন কে দিয়ে দেব৷
লোকটা বলল, আর সেও যদি না নেয়?
তাহলে তার পরের জন কে৷
আর সে-ও যদি না নেয়? লোকটা প্রায় হুংকার দিয়ে উঠল৷
স্নেহলতা বলল, লাইন তো অনেক লম্বা, কোনো অসুবিধা নেই৷
এবার লোকটা কিছুটা হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, কেউই যদি না নেয়?
স্নেহলতা পড়ে গেলেন খুব সমস্যায়৷ অঙ্ক জানেন না বলে বৃহৎ কোনো এক জটিল ধাঁধায় এসে শেষমেষ তার সব উত্তর থমকে যায়৷ সে বুঝতে পারে লোকটা এনিহাউ তাকে ওই গেঞ্জিটা গিলাতে চাইছে৷ কিন্ত্ত সে এ-ও বুঝতে পারছে এই উত্তরটা দিলেই তার ব্যবসা গুটিয়ে যাবে৷ আর লোকটা যা ধুরন্ধর, সে মই বেয়ে পৌঁছে যাবে তার সাধের পোলট্রি ফার্মে৷ অনেক ভেবে চিন্তে বুদ্ধি করে সে বলল, রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাই ঘেমে উঠেছে৷ ওটা সবাই ঘাম মোছার কাজে ব্যবহার করবে৷ খুশি?
লোকটা বলল, না৷ আমরা গরীব হতে পারি৷ তাই বলে এটুকুও জানি না ভেবেছেন! আপনার দু’পয়সার ভিক্ষা নিতে গিয়ে দু’শো পয়সার ওষুধ গিলাবেন? এক গেঞ্জিতে ঘাম মুছবে এতো লোক! হাইজিন বোঝেন?
স্নেহলতা বলল, যত দিন যাচ্ছে আমি কিছুই বুঝিনা এই কথাটা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারছি না৷ আপনি এতো দিগগজ, তাহলে খামোখা আমার এই পাতি ব্যবসায় এসে বাগড়া দিচ্ছেন কেন বলুন তো?
এবার পিছন থেকে লোকজন চেঁচিয়ে উঠল, দিদি আজ কি কিছু পড়বে, নাকি আপনাদের ক্যাচাল শুনেই বাড়ি যেতে হবে?
স্নেহলতার মুখটা মলিন হয়ে গেল৷ ঝগড়া তো বাধার কথা ছিল উপরে কিন্ত্ত এ যে দেখি বেধে গেল নিচে৷ সে যে রাতে লোক পাঠিয়ে এতো ভজঘট করে রেখে এলো দোতলায় তাও কেন আজ এমন চুপচাপ সব?
বুল্টিটাও তো ফ্রিজ হয়ে গিয়েছে৷ খবর আনার বদলে জমিয়ে বসে ঠাণ্ডা এসির হাওয়া খাচ্ছে মনে হচ্ছে৷ সাদা মেশিনের চাকা ঘুরছে বোঁ-বোঁ করে৷ ফোন যে করবেন তাও পারছেন না৷ বুল্টির বদলে যদি তিনি ধরা পড়ে যান, মান সম্মান নিয়ে টানাটানি৷
স্নেহলতা বললেন, আজ মনে হয় কোনো সমস্যা নেই৷ আজ বরং চলুন সবাই বাড়ি চলে যাই৷ কাল সক্কাল সক্কাল আবার এসে পড়বো৷
একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বলল, আমি কি একটু ওপরে গিয়ে দেখবো?
স্নেহলতা বললেন, না, একদম না৷ প্রয়োজন হলে আমি যাবো, আপনি কেন?
মেয়েটি বলল, কারণ এই সামান্য চালাকি দিয়ে বেশি দিন আর ব্যবসা চালানো যাবে না ম্যাডাম৷ ওদের ঝগড়া আর বাধবে না৷ আর তাছাড়া ওদের ঘরেও আর কিছু অবশিষ্ট নেই৷ আপনার তৈরি করা ঝগড়া লড়তে লড়তে ওরা ওদের ঘরের সব জিনিসপত্রই তো ছুঁড়ে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে৷ আর কী দেবে বলুন৷
স্নেহলতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন মেয়েটির দিকে, এ তো দেখছি সব কথাই জানে৷ সেই যে বুল্টিকে পাঠিয়ে এদের মধ্যে প্রতিদিনই কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাধার পরিস্থিতি তৈরি করে রাখেন, সেটাও৷ পুরো ফেসবুক মার্কা গল্প৷ কাজের মেয়েগুলোকে বিশ্বাস নেই৷ সে বলল, এই এসব আবোলতাবোল কথা বলবে না৷ আমি কাউকে কোথাও পাঠাইনি৷ ওরা বড়লোক মানুষ৷ নিজেদের খেয়ালে জানলা দিয়ে জিনিসপত্র ফেলে দেয়৷ আর সেগুলো রাস্তায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়৷ তাই ভাবলাম যদি মানুষের কাজে লাগে৷
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, আচ্ছা! তাই জন্যে কমিশন নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসলেন৷
স্নেহলতা বললেন, ক’পয়সা কমিশন নিয়েছি আমি বলুন৷ এই যে আপনারা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন লাইন দিয়ে, তারপর আমাকে দিদি দিদি করেন, একটা একটা করে জিনিসপত্র বুঝে, নিজেকে একটা কেউকেটা মনে হয়৷ ব্যাস ওইটুকুই৷
তাই জন্যে একজনের ঘরে শুধু শুধু ঝগড়াঝাঁটি বাধিয়ে রাখেন!
স্নেহলতা বললেন, না না, ওদের এমনিই ঝগড়া বাধত৷ আর আমি কান খাড়া করে শুনতাম৷ আর বিস্তর মজা পেতাম৷ আমার তো সারাদিন কোনো কাজ নেই৷ সাতকূলে আমার কেউ নেই৷ ঘরে বসে বসে ঝিম ধরে যায় সারাদিন৷ তাই৷ তা একদিন দেখলাম খুব একটা ঝগড়াঝাঁটি আর হচ্ছে না৷ এদিকে ততদিনে আপনাদেরও লম্বা লাইন৷ তখন বুল্টিকে পাঠালাম এটা ওটা উলোটপালোট করে দিয়ে আসতে৷ যাতে রোজই কিছু না কিছু ঝামেলা লেগে থাকে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে৷
এই কথা হতে হতেই বুল্টি সহ ওরা ওই স্বামী-স্ত্রী নেমে এলেন রাস্তায়৷ বললেন, কী ব্যাপার, এখানে এতো লম্বা লাইন কেন? বুল্টি বলছিল অনেকে এসেছেন নাকি! আমি তাদের কিছু জিনিসপত্র দিয়ে চাই৷ সত্যি সত্যি আমরা বড্ড কুঁড়ে৷ কোথাও গিয়ে যে কাউকে কিছু পৌঁছে দেব এমনটা আর হয়ে ওঠে না৷ অথচ ঘরে এতো জিনিস যে আজকাল বড় ভার লাগে৷ বোঝা হালকা করতে চাই৷ তারপর স্নেহলতার দিকে ফিরে হাত জোড় করে বললেন, আপনার কথা বুল্টি আমায় বলেছে৷ এই এতো লোকজন যে আপনি জড়ো করে এনেছেন তার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ৷ আমরাও তো একাই থাকি৷ দু’জনে একা একা৷ আপনি এতো কষ্ট করে রৌদ্রে দৌড়ঝাঁপ না করে বরং আমাদের সঙ্গে এসে একটু গল্প করে যাবেন৷ আর বুল্টিকে আমি বলে দিয়েছি বৎসরান্তে একবার ও লোকজন জোগাড় করে আনবে আর আমরা জমা যতকিছু সব বিলিয়ে দেব৷
স্নেহলতা ভদ্রমহিলার হাত ধরে বললেন, খুব ভালো প্রস্তাব তো৷ তবে না, বৎসরান্তে না, আমার এই এতো মানুষজন মাঝে মাঝেই দেখতে ইচ্ছে করে৷ তাই ওদের কিন্ত্ত আপনাদের মাঝেমাঝেই ডাকতে হবে৷ যদি কিছু নাও দিতে পারেন তবে শুধু নাহয় একটু মিষ্টিমুখ করিয়ে জল বাতাসা খাইয়ে দেওয়া হবে৷
ভদ্রলোক বললেন, শুধু জলবাতাসার জন্যে কি কেউ আর এতোক্ষণ রোদে লাইন দেবে?
ওম্মা দেখা গেলো সকলে হাত উঠিয়ে বলল, দেব, দেব, দেব, এসব রঙ্গ তামাশা আমাদের খুব ভালো লেগেছে৷
খুব সাদামাটা একটা গল্পের শেষেও আকাশে মেঘ করে এলো৷ আর টুপটাপ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরে পড়লো সকলের মাথার ওপরে৷