অভিষেক রায়, খড়গপুর, ৩০ এপ্রিল— নারায়ণ চৌবে৷ ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ মেদিনীপুর লোকসভার সাংসদ৷ রেল শ্রমিক আন্দোলনের এই প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবি আজ ধূসর হয়ে গিয়েছে খড়গপুরের চালচিত্র থেকে৷ সারা রাজ্যের সঙ্গে তাল রেখে সেখানে এখন শুধুই রাজনৈতিক উচ্চতায় বামনদের দাপুটে আনাগোণা৷
নির্বাচন, বিশেষ করে লোকসভা নির্বাচন এলে এই চৌবে নামটা অনেক পুরনো লোকেদের মনে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে৷ খড়্গপুরের খরিদা এলাকায় একটি ভাড়া বাডি়তে সারা জীবন সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন দুবারের সাংসদ নারায়ণ চৌবে৷ আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁডি়য়ে যার তুলনা কোনওভাবেই করা যায় না৷ চৌবে পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তাপস দে বলছিলেন, চৌবে কাকুর দুই ছেলে গৌতম আর মানস৷ তপশিলি জাতি কোটায় গ্যাসের ডিলারশিপের জন্য আবেদন করে ছোট ছেলে মানস৷ মুনমুনের কাস্ট সার্টিফিকেট ছিল তাই মুনমুনের নামেই সেই আবেদন করা হয়৷ চৌবে কাকুর কাছে গিয়ে আবেদনপত্রের সঙ্গে মন্ত্রীর কাছে দেওয়ার জন্য তার একটা রেকমেন্ডেশনের জন্য একদিন সকালে যেতেই মানসের হাত থেকে আবেদনপত্র নিয়ে ছিডে় ফেলে দেন আর বলেন, ছেলে গ্যাসের ডিলারশিপ নেবে আর তার জন্য মন্ত্রীকে রিকোয়েস্ট করে চিঠি লিখতে হবে, এই কাজ আমি পারব না৷ এই ছিলেন নারায়ণ চৌবে৷ একজন দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব৷ যিনি মাথা উঁচু করে রাস্তায় হাঁটতেন৷ দেখা হলেই পিঠে থাপ্পড় মেরে দরাজ গলায় কথা বলতেন৷ সমস্ত খড়্গপুরের লোক ছিল তার আপনার জন৷ যে কোনো বাডি়র অন্দরমহলে তার যাতায়াত ছিল মসৃণ৷
১৯৮০ সালে ইন্দিরা কংগ্রেসের সুধীর ঘোষালকে হারিয়ে মেদিনীপুর থেকে প্রথমবারের জন্য সাংসদ নির্বাচিত হন নারায়ণ চৌবে৷ ১৯৮৪ সালে প্রবল ইন্দিরা হাওয়ার মধ্যে দাঁডি়য়েও কংগ্রেসের অজিত খাড়া কে হারিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য সাংসদ নির্বাচিত হন৷ ১৯৮৯ সালে জেলা কমিটি নারায়ণ চৌবের নাম প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব আকারে রাজ্য কমিটিকে পাঠায়৷ রাজ্য কমিটির যেদিন বৈঠকে বসার কথা সেদিন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেত্রীর মৃতু্যর কারণে বৈঠক বাতিল হয়৷ আর ঠিক সেই দিনেই কংগ্রেস মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে তাদের প্রার্থী হিসেবে নারায়ণবাবুর সহধর্মিনী গৌরী চৌবের নাম ঘোষণা করে দেয়৷ এরপরেই তৎকালীন সেচমন্ত্রী কানাই ভৌমিকের মাধ্যমে নারায়ণবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে দল৷ নারায়ণবাবু পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান না৷ এরপর সিপিআই মেদিনীপুর কেন্দ্রে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের নাম ঘোষণা করে৷ রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য কার্যত নারায়ণ চৌবেকে ঠেলে দেওয়া হয়৷ যার দায় তার পরিবারও এডি়য়ে যেতে পারে না৷
১৯৯২ সালের ৬ মে চৌবে পরিবারের পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে ঢোকেন হেমা চৌবে৷ হেমা বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেস করেন এবং খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি৷ হেমা বলেন, অষ্টমঙ্গলায় যাওয়ার আগের দিন জেঠুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়৷ যমে মানুষে টানাটানি কাটিয়ে এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত জীবন৷ রাজনৈতিক জীবন আগেই শেষ হয়েছিল৷ জীবনের প্রদীপ নিভে গেল ১৯৯৭ সালের ৭ই আগস্ট৷
তাপসবাবু বলছিলেন, নারায়ণ চৌবে ছিলেন একটা বটবৃক্ষের মতো৷ সেই বৃক্ষের ছায়ায় অনেকেই নাদুসনুদুস হয়েছেন৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত সেই বটবৃক্ষটিকেই নির্দয়ভাবে কেটে দিয়েছেন৷ নারায়ণ চৌবে স্মৃতি সরণী নামে একটি ছোট্ট গলিপথে আটকে গিয়েছেন দুবারের সাংসদ৷ লোকসভার ভোট এলে নারায়ন চৌবে নামটা ঘোরাফেরা করে৷ দুই ছেলে দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছেন৷ সহধর্মিনী থাকেন ভুবনেশ্বরে মেয়ের সঙ্গে৷ গুরুদাস দাশগুপ্তের সৌজন্যে বছর আটেক আগে প্রয়াত সাংসদের স্ত্রীর পেনশনের ব্যবস্থা হয়েছে৷ খড়গপুরে রয়েছেন চৌবে পরিবারের একমাত্র প্রতিনিধি, হেমা চৌবে৷