• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

১ মে— নবীন প্রজন্মের কণ্ঠে হতাশা

চাকরিটা আমার চলে গেছে ‘বেলা’ শুনছো! সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় ১লা মে-র প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে বর্তমান নবীন প্রজন্মের কাছে৷ তাদের কণ্ঠে আজ হতাশার সুর৷ কারণ কয়েকশো বছর আগে সেই কুৎসিত শোষণের নগ্ন চেহারা আবার দেখা দিয়েছে রঙিন মোড়কে৷ সেই সঙ্গে হালফিল সময়ে পুরনো দিনের বৈপ্লবিক অনেক শব্দ ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ যেমন— ‘শ্রমিক-মালিক লড়াই’, ‘বুর্জোয়া

চাকরিটা আমার চলে গেছে ‘বেলা’ শুনছো!

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

১লা মে-র প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে বর্তমান নবীন প্রজন্মের কাছে৷ তাদের কণ্ঠে আজ হতাশার সুর৷ কারণ কয়েকশো বছর আগে সেই কুৎসিত শোষণের নগ্ন চেহারা আবার দেখা দিয়েছে রঙিন মোড়কে৷ সেই সঙ্গে হালফিল সময়ে পুরনো দিনের বৈপ্লবিক অনেক শব্দ ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ যেমন— ‘শ্রমিক-মালিক লড়াই’, ‘বুর্জোয়া ব্যবস্থা’, ‘শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস’, ‘শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে সারা দুনিয়া’ প্রভৃতি শব্দগুলিকে পাশ কাটিয়ে শোনা যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, ফেসবুক, ইউটিউব, টু্যইটার নামক মগজ ধোলাই করা শব্দগুচ্ছ৷

চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত ‘মডার্ন টাইমস’ ছবির প্রথম দৃশ্যেই একপাল ভেড়াকে খেদিয়ে নিয়ে চলছেন তাঁর মালিক৷ পরের দৃশ্যেই দেখা যায় হাজার হাজার শ্রমিক গুঁতোগুঁতি করে ঢুকছেন কারখানার গেট দিয়ে৷ এই সময়ে কারখানার যন্ত্রের প্রবল ঘষটানির শব্দ স্তিমিত হয়ে এসেছে৷ এখন অটোমেশনের যুগে শব্দ কম, কাজ বেশি৷ বিনিয়োগ আকাশছোঁয়া, অথচ কর্মচারীর সংখ্যা কমছে৷

অন্যদিকে প্রতিটি কারখানায় যাঁরা কাজ করেন, বিভিন্ন কোম্পানির যাঁরা কর্মচারী, তাঁদেরকে জন্ত্ত-জানোয়ারের মতো খাটিয়ে মারছেন মালিক শ্রেণি৷ অথচ এ ব্যাপারে কাউকে টঁ্যা ফোঁ করতে দেখা যায় না৷ আন্তর্জাতিক (শ্রমজীবী) শ্রমিক শ্রেণির দলগুলি এবং তাদের তাত্ত্বিক-পড়ুয়া নেতারা ১লা মে-তে লালঝান্ডা উড়িয়ে আর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়েই ক্ষান্ত৷ অথচ তলে তলে কী ভীষণ শোষণ বঞ্চনার প্রক্রিয়া সুচতুর কায়দায় চলছে তা জানলে অবাক হতে হয়৷

কয়েকশো বছর আগে শ্রমজীবী কর্মচারীদের ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা গাধা-ঘোড়ার মতো খাটিয়ে মারতেন মালিকপক্ষ৷ কিন্ত্ত ১লা মে-র রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর শ্রমিক শ্রেণি জয়যুক্ত হন৷ এরপর থেকে ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টার বিনোদন ব্যবস্থা আইনত চালু হয় বিশ্ব জুড়ে৷ কিন্ত্ত বর্তমান সময়ে ১লা মে-র ঐতিহ্য কতটা ফলপ্রসূ, সেটাই এখন নবীন প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন৷ তাঁদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রমিক এবং সমাজতান্ত্রিক দলগুলি এখন আলস্য-জর্জরিত দোষে দুষ্ট৷ কার্যত আপ-টু-ডেট হওয়ার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছে৷ অর্থাৎ সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্বজুড়ে যে নয়া শোষণের পরাগ্রম চলছে, তাকে লড়াইয়ের মাধ্যমে পর্যুদস্ত করার ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণির দলগুলি কোনও ভূমিকা নিতে পারছে না৷

পেশাগতভাবে প্রতি মাসে অনেক তরুণ-তরুণী, স্বামী-স্ত্রী আমার কাছে আসেন৷ তাঁরা অনেকেই বিভিন্ন কোম্পানি, কারখানায় চাকরি করেন৷ কথা প্রসঙ্গে তাঁরা জানান, দিনে ১২ থেকে ১৫-১৬ ঘণ্টা তাঁদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়৷ সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ঊর্ধ্বতন বস ল্যাপটপ-ফোনের মাধ্যমে তাঁদের ব্যস্ত রাখেন৷ এখন পুলিশ-হাসপাতালের মতোই সব অফিস যেন ‘জরুরি পরিষেবা কেন্দ্র’৷ ছুটি নেই৷ মুখে রক্ত তুলে খাটো৷ বাবা-মা মারা গেলেও ছুটি হবে কিনা সন্দেহ৷ কর্মস্থলে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ নেই৷ তাহলে কলমের এক খোঁচায় চাকরি খতম৷ আপনি চাকরি ছাডলে কুছপরোয়া নেই৷ লাইনে লক্ষাধিক বেকার যুবক-যুবতী হা-পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে আছেন৷ সেই সঙ্গে মজার বিষয়, এখন চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেক নেতা-মন্ত্রী নাকি টাকা ঘুষ নেন— দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত৷ তা নিয়ে অনেক প্রতিবাদী মানুষ সোচ্চার৷ অথচ বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কর্মচারীদের নিয়োগপত্র দেওয়ার আগে লক্ষাধিক টাকা ‘জমা’ রাখে কেন তার যৌক্তিকতা ধোপে টেকে না৷ সেই সঙ্গে বলা যায়, একজন কর্মচারীর মাস মাইনেতে তাদেরকে তিনজন কর্মচারীর কাজ করিয়ে নেওয়া হয় কাজের সময় বাড়িয়ে৷ অর্থাৎ ১৫-১৬ ঘণ্টা৷ সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জেরে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে৷ যেকোনও আইনজীবীর সাক্ষাৎকার নিলেই তার ভয়াবহতা জানা যায়৷ অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের হতাশা, ক্ষোভ, বদহজম, নিদ্রাহীনতা, স্ট্রোকের মতো নানা রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে৷ মনস্তত্ববিদ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এই নিয়ে নানা সতর্কবার্তা শোনাচ্ছেন৷ সব মিলিয়ে বলা যায়, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্ম ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে৷ এই কুৎসিত, নগ্ন শোষণের প্রতিকার কি হবে? আন্তর্জাতিক শ্রমজীবীর দলগুলি যদি এই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লাগাতারভাবে গর্জে না ওঠে, তবে ১লা মে হবে একটি পিছিয়ে পড়া শ্লোগান মাত্র৷

অনেক বছর আগে অঞ্জন দত্ত গান বেঁধেছিলেন— ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো’— তখনও চেষ্টা চরিত্তির করে হয়ত চাকরিটা জুটত৷ কিন্ত্ত বর্তমানে কোনও এক স্বামী হয়ত অফিসে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে বলবেন— ‘‘চাকরিটা আমার চলে গেছে ‘বেলা’ শুনছো!’’— দেশের আজ বড় দুর্দিন৷