• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

শতবর্ষে অরুন্ধতী দেবী: সৌন্দর্য, আভিজাত্য ও গুণের আশ্চর্য সংমিশ্রণ

এবছর ২৯ এপ্রিল অরুন্ধতী দেবীর জন্মশতবার্ষিকী৷ সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, অভিনয় ও চিত্রপরিচালনার মতো নানান গুণের এক বিরল সমাহার ঘটেছিল তাঁর শিল্পীসত্তায়৷ সেই সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্য ও আভিজাত্য তাঁকে করেছিল একবারেই স্বতন্ত্র৷ এই প্রতিভাময়ী শিল্পীর জীবন ও কর্মের কথা লিখেছেন ধ্রুবজ্যোতি মন্ডল৷ রাত তখন অনেক৷ দার্জিলিঙে জগদীশচন্দ্রের কটেজে বিছানায় শুয়ে নিবেদিতা মৃতু্যর প্রহর গুনছেন৷ সামনে টেবিলে

এবছর ২৯ এপ্রিল অরুন্ধতী দেবীর জন্মশতবার্ষিকী৷ সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, অভিনয় ও চিত্রপরিচালনার মতো নানান গুণের এক বিরল সমাহার ঘটেছিল তাঁর শিল্পীসত্তায়৷ সেই সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্য ও আভিজাত্য তাঁকে করেছিল একবারেই স্বতন্ত্র৷ এই প্রতিভাময়ী শিল্পীর জীবন ও কর্মের কথা লিখেছেন ধ্রুবজ্যোতি মন্ডল৷

রাত তখন অনেক৷ দার্জিলিঙে জগদীশচন্দ্রের কটেজে বিছানায় শুয়ে নিবেদিতা মৃতু্যর প্রহর গুনছেন৷ সামনে টেবিলে থাকা ধূপদানির দিকে তাঁর পলকহীন চোখ৷ আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালাতে হাত রেখে শুধু বলে চলেছেন, জানিনা স্বামীজির দেওয়া এই মালার মর্যাদা আমি রাখতে পেরেছি কিনা৷ দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো৷ বাইরের হাওয়ায় ঘরের পর্দা উড়ছে৷ গাছগাছালি আন্দোলিত হচ্ছে৷ সেই সঙ্গে নিবেদিতার সেই আবেদন, জোয়ার এসেছে, বাঁধন খুলে দাও, তরি ভেসে যাক৷ তারপর আবার বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, তবু সূর্য উঠবে৷তোমাদের দৃষ্টিতে দেখবো ভারতের নব সূর্যোদয়৷ এই ভাবেই ঠোট নাড়তে নাড়তে তিনি চিরনিদ্রায় ঢলে পডে়ন৷

আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দীরও আগে ‘ভগিনী নিবেদিতা’ ছবির শেষ দৃশ্যে অরুন্ধতী দেবীর সেই অসাধারণ অভিনয় মানুষকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল৷ ১৯৬২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাধা, পূর্ণ প্রভৃতি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি যখন মুক্তি পেল তখন দর্শকদের মধ্যে সে কী উন্মাদনা৷ এই সিনেমা চলেছিল টানা ১১৯ দিন৷ সমস্ত রের্কড ভেঙে নতুন ইতিহাস গডে়ছিল ‘ভগিনী নিবেদিতা’৷ আর তার জন্য অরোরা ফিল্মস প্রযোজিত এই ছবি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে৷ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের হাত থেকে স্বর্ণপদক কুডি় হাজার টাকা গ্রহণ করেন প্রযোজক সংস্থার কর্ণধার অরুণ বসু৷
তবে এটাই একমাত্র ছবি নয়৷ এরকম বহু ছবিতে অরুন্ধতী তাঁর সুঅভিনয়ের ছাপ রেখে গেছেন৷ তপন সিংহ পরিচালিত কালামাটি (১৯৫৮), ক্ষুধিতপাষাণ (১৯৬০), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), জতুগৃহ (১৯৬৪), হারমোনিয়াম-এর কথা তো বারবার আলোচনায় উঠে আসে৷ কালামাটিতে অনুপমা রায় নামে একজন নার্সের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি৷ কোলিয়ারি অঞ্চলে মহিলা শ্রমিকদের বাচ্চাদের দেখাশোনার ভার তাঁর উপর বর্তায়৷ অর্থাৎ খনি কর্তৃপক্ষের একটা বেবিক্রেশ চালানো দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবিকার চরিত্র৷ রমাপদ চৌধুরীর লেখা ‘বিবিকরজ’ অবলম্বনে এর পটভূমিকা সাজানো হয়েছিল৷ কাহিনীর মূল চরিত্র অনুপমা৷ এর আউটডোর শুটিং হয়েছিল রানীগঞ্জ কোলিয়ারি অঞ্চলে৷ এখানেও তুমুল প্রশংসনীয় অভিনয় করেছিলেন অরুন্ধতী যেখানে আবেগ, অনুভূতি, সংযম মিলেমিশে যথার্থ একজন সেবিকাকে আমরা পাই৷

আসলে তাঁর অভিনয়ের গতিপ্রকৃতিই ছিল আলাদা৷ কখনো মাত্রা হারাতেন না৷ সংবেদনশীল এবং চরিত্র অনুযায়ী অভিব্যক্তি বেরিয়ে আসত তাঁর অভিনয়ে৷ ক্ষুধিত পাষাণ-ও হিট ছবি৷ ১৯৬০ সালে ৬ মে মিনার, বিজলী, ছবিঘরে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি পুজো পর্যন্ত চলেছিল৷ হায়দ্রাবাদে অভিশপ্ত এক রাজপ্রাসাদের মধ্যে অতৃপ্ত আত্মাদের বাস, সেখানে গা ছমছমে পরিবেশে আলি আকবর খাঁ সাহেবের মিউজিক৷ সেই আবহের মধ্যে অরুন্ধতীর নির্বাক অভিনয় সত্যিই অনবদ্য৷ জাতীয় পুরস্কার পেল এই ছবি৷ পুরস্কৃত হলেন তিনিও৷ শুধু তাই নয় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সম্মানিত হয়েছিল আয়ারল্যান্ডের কোক ফেস্টিভ্যালে৷ অন্যদিকে সুবোধ ঘোষের গল্প নিয়ে ‘জতুগৃহ’ ছবিতে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় উত্তমকুমার-অরুন্ধতীর অভিনয়ও সেকালে দর্শকদের মন কেডে়ছিল৷ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, তাঁদের ভুল বোঝাবুঝি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেই জতুগৃহ গল্প৷ ঝিন্দের বন্দী-র আউটডোর শুটিং হয়েছিল উদয়পুরে৷ তার কথা বলতে গেলে বলতে হবে নাথুরামের কথা৷ সামান্য টাঙ্গাওয়ালা৷ উদয়পুর রেলস্টেশনে নেমেই তার সঙ্গে পরিচয় পরিচালকের৷ ঢোলা কুর্তা পাজামা, মাথায় কালো টুপিপরা মাঝবয়সি সাদাসিধে মানুষ কিন্ত্ত খবরাখবর রাখে৷ উপর মহল থেকে নিচ পর্যন্ত যোগাযোগ দারুণ৷ তাই আর কোনও চিন্তাই করতে হয়নি৷ থাকার জন্য পাহাডি় টিলার উপর লক্ষ্মীবিলাস হোটেল, লোকেশন দেখতে উদয়পুর থেকে প্রায় আশি-নব্বই মাইল দূরে কুম্ভলগড় যাওয়ার ব্যবস্থা করা, শুটিংয়ের জন্য দশ-বারোটা তেজি ঘোড়ার জোগাড় সব নাথু৷ যাই হোক, এই ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে ছিলেন অরুন্ধতী৷ এছাড়াও অসিত সেন পরিচালিত চলাচল (১৯৫৬), পঞ্চতপা (১৯৫৭), প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের বিচারক (১৯৫৯) এবং আরও যে কত ছবিতে তিনি দাপিয়ে অভিনয় করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ মূলত পঞ্চাশের দশকেই তাঁর উত্থান৷ সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন৷ কেননা সিনেমায় তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সালে৷ নিউ থিয়েটর্স প্রযোজিত, কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত মহাপ্রস্থানের পথে-র নায়িকা ‘রানী’-র চরিত্রে৷ নায়ক ছিলেন বসন্ত চৌধুরী৷ প্রবোধকুমার সান্যালের ভ্রমণ কাহিনী অবলম্বনে এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র লেখক (বসন্ত) নিজেই৷ হরিদ্বার হয়ে কেদার-বদ্রীর পথে তাঁর যাত্রা৷ এবং সেই যাত্রা খুব সুগম ছিল না৷ আর এমনই এক পরিক্রমায় লেখক অনেকের মতো রানীর সংস্পর্শে আসেন৷ বাল্যবিধবা রানীর অকৃত্রিম ব্যবহার লেখককে মুগ্ধ করে৷ এখান থেকেই দু’জনের মধ্যে ভালোবাসা অথচ তা কোনো পরিণতি পায় না৷ এই দুই নবাগত শিল্পীকে নিয়ে তৈরি এই ছবি বাংলা ও হিন্দি উভয় সংস্করণ সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷

অসম্ভব প্রতিভাময়ী নারী এই অরুন্ধতী দেবীর জন্ম ১৯২৪ সালের ২৯ এপ্রিল অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে৷ পিতা বিভুচরণ গুহঠাকুরতা ছিলেন একজন দার্শনিক প্রকৃতির মানুষ৷ সেইসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজসেবী৷ সকল ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব শ্রদ্ধা৷ মন্দিরে দাঁডি়য়ে তিনি যেমন নিবিষ্ট মনে আরতি দেখতেন, ঠিক তেমনই শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে গির্জা ও মসজিদে যেতেন৷ বাবার এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত হয়েছিল অরুন্ধতীর মধ্যে৷ বাডি়তে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত থেকে শুরু করে বাউল, কীর্তন, শ্যামাসংগীত প্রভৃতি গান গাওয়ার চল ছিল৷ ফলে খুব ছোটবেলা থেকেই অরুন্ধতীর মধ্যে গানের একটা বুনিয়াদ তৈরি হয়ে যায়৷ ভাবতে অবাক লাগে মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ গানখানি গেয়ে সকলের মন জয় করেন৷ সংগীতের সেই শুরু৷ পরে প্রথাগত বিদ্যা ও সংগীত শিক্ষা শুরু হয় শান্তিনিকেতনে৷ এই মোক্ষম সুযোগটি তিনি পেয়েছিলেন পিসিমার দৌলতে৷ তখন তাঁর ছোট পিসেমশাই অজিত চক্রবর্তী এবং পিসিমা লাবণ্যলেখা শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লিতে থাকতেন কেবল রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে ভালোবেসে৷ তাই অসুবিধা হয়নি৷ এখানে সংগীত বিষয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন অরুন্ধতী৷ তখনকার দিনে শান্তিনিকেতনে যেসব ছাত্রছাত্রীরা গান শিখতে চাইতেন তাঁদের টোনাল কোয়ালিটির পরীক্ষা নেওয়া হতো৷ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁদের গান শুনতেন৷ এই গান শেখার পাশাপাশি বিশ্বভারতী থেকেই অর্থনীতিতে অর্নাস গ্র্যাজুয়েট এবং তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর হন অরুন্ধতী৷ বিশেষ করে শান্তিনিকেতনে গানের পরিবেশে মানুষ হওয়ায় এবং হিমাংশু দত্ত ও শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে সংগীতগুরু হিসেবে পাওয়ায় অরুন্ধতী রবীন্দ্রসংগীতে যথেষ্ট নাম করেন৷ নাচ শেখেন গুরু ব্রজবাসী ও বালকৃষ্ণ মেননের কাছে৷ ১৯৪০ সাল নাগাদ বেতার শিল্পীর পাশাপাশি তাঁর গানের রের্কড প্রকাশিত হয়৷ তবে অরুন্ধতীর মা কখনোই চাননি তাঁর মেয়ে গান গেয়ে রোজগার করুক৷ এই নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি করেছিলেন রেডিওতে গান গাওয়ার ব্যাপারে৷ কেননা আকাশবাণীতে গান গাইলে সম্মান দক্ষিণা পাওয়ার একটা ব্যাপার থাকেই৷ অন্যদিকে অরুন্ধতীর সংগীত গুরু শৈলজারঞ্জনও ছেডে় দেবার পাত্র নন৷ তিনি পাল্টা যুক্তি দিলেন৷ বললেন, আমরা তো সবসময় নেপথ্যেই থেকে গেলাম৷ গুরুদেবের গানের বিরাট ঐশ্বর্যলোকের খবর ক’জনই বা জানতে পারছে৷ তোমরা শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা যদি মাঝে মাঝে রেডিওতে গাও তাহলে তাঁর গানের সঙ্গে সকলের পরিচয় হয়৷ আমাদের দিক থেকে এটার খুব প্রয়োজন আছে৷ শৈলজাদার এই কথা শোনার পর অরুন্ধতী দেবীর মা আর আপত্তি করেননি৷

সুরেশ চক্রবর্তী মশাই তখন রেডিওর কর্ণধার৷ তিনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন৷ সেই প্রথম অরুন্ধতী আর সুবিনয়বাবু একটা প্রোগ্রামে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন৷ এরপর সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ হলো৷ শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছাড়াও অরুন্ধতীর সংগীত জীবনে বিবিদির অবদানও কম ছিল না৷ বিবিদি হলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী৷ প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর স্ত্রী৷ তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া৷ তাঁকে গান শোনানো৷ ঠাকুরবাডি়তে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে সেই ‘মায়ার খেলা’ নাটকে তাঁর অংশগ্রহণের দিনগুলির কথা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মনে রেখেছিলেন৷ এম.এ পড়তে পড়তে একবার সাংবাদিক হওয়ার শখ হয়েছিল অরুন্ধতীর৷ কিন্ত্ত ১৯৫২ সালে চিত্রনাট্যকার বিনয় চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে নিউ থিয়ের্টাসের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবিতে নায়িকার সফল অভিনয় তাঁকে এই জগতের দিকে টেনে নিয়ে যায়৷

তারপর তিনি আর দিক পরিবর্তনের কোনও সুযোগই পাননি৷ একের পর এক বকুল (১৯৫৪), ছেলে কার (১৯৫৪), গোধূলি (১৯৫৫), টাকা আনা পাই (১৯৫৬), মা (১৯৫৬), নবজন্ম (১৯৫৬), চলাচল (১৯৫৬), পঞ্চতপা (১৯৫৭), মানময়ী গার্লস স্কুল (১৯৫৮), শিউলি বাডি় (১৯৬২) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে তিনি ছায়াছবির এক জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন৷ এইসব ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি কোথাও কোথাও সংগীত পরিচালনা এবং গানও গেয়েছেন৷ প্রভাত মুখোপাধ্যায় পরিচলিত মা (১৯৫৬), বলাই সেনের সুরের আগুন (১৯৫৬) ছবিতে প্লে ব্যাক সিঙ্গার ছিলেন৷ অসিত সেনের ‘চলাচল’-এ একজন মেডিকেল ছাত্রী সরমা ব্যানার্জীর রোলে দর্শকদের প্রায় কাঁদিয়ে ছাডে়ন৷ নায়িকা চরিত্র৷ বিয়োগান্ত এই ছবির নায়ক ছাত্র অবিনাশ (নির্মলকুমার)৷ কাহিনী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের৷ তখনকার কালে ডাক্তারি পড়া একরকম মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে ছিল৷ সরমাদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভাল ছিল না৷ তবু তার লড়াইটা ছিল৷ এদিকে বন্ধুদের চ্যালেঞ্জ রাখতে ক্লাসের অতীব সুন্দরী সরমার পাশে গিয়ে বসতে হয় অবিনাশকে৷ সেখান থেকে প্রেম৷ কিন্ত নানান পারিবারিক দুর্যোগে দু’জনের ভালোবাসা পরিণতি পায় না৷ খারাপের দিকে এগোয়৷ এবং তার সেই মানসিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অরুন্ধতী যা দর্শকদের মনকে নাড়া দেয়৷ বলতে গেলে, সেই সময়ের এক প্রশংসিত সিনেমা ‘চলাচল’৷ ‘পঞ্চতপা’-তে অরুন্ধতী (সান্ত্বনা) অনুপ্রেরণার প্রতীক৷ বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা এক ইঞ্জিনিয়ারকে (অসিতবরণ) তিনি ক্রমাগত উৎসাহিত করেন৷ ‘বকুল’-এ বড়লোকের মেয়ে৷ এরকম নানান চরিত্রে তাঁর সাবলীলতা মানুষের নজর কেডে়ছিল৷

আসলে অভিনয়, গান সব মিলিয়ে একটা ট্যালেন্ট তো ছিলই তায় তিনি আবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী৷ ফলে কাজ করার সুযোগ অরুন্ধতী পেয়েছিলেন৷ তাই এত কিছুর পরেও তাঁকে দেখা গেল প্রভাত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত আকাশপাতাল (১৯৬০) ছবির প্রযোজনা করতে৷ এছাড়া ১৯৬৭ সালে ছুটি, ১৯৭০ সালে মেঘ ও রৌদ্র, ১৯৭২ ও ১৯৮৪-তে যথাক্রমে পদিপিসীর বর্মি বাক্স, দীপার প্রেম ছবিগুলির পরিচালনা তিনি নিজেই করেছেন৷ সঙ্গে এই সব সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা, সংগীত পরিচালনা এমনকী দীপার প্রেম ছবিটির শিল্প নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন৷ লীলা মজুমদারের কাহিনী নিয়ে পদিপিসীর বর্মির বাক্স তো সে সময় ছোটদের মধ্যে দারুণ আনন্দ দিয়েছিল৷ হল-ফেরত বাচ্চাদের মুখে মুখে তখন বাক্স খোঁজার গল্প৷ পদিপিসী (ছায়াদেবী) ডাকাত সর্দার নিমাইখুড়োর কাছ থেকে কীভাবে বর্মির বাক্স ছিনিয়ে নিল, আবার হারিয়েও ফেলল৷ তারপর বাডি়সুদ্ধ লোক বাক্স খুঁজে হয়রান৷ সেই খোঁজার দৃশ্যে পরতে পরতে কৌতূহল আর উত্তেজনা৷ সুন্দর ছবি করেছিলেন অরুন্ধতী৷ সেখানে নজরুলগীতির প্রয়োগ৷ অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনা সবেতেই সফল৷ একেই বলে বহুমুখি প্রতিভা৷ আর এসবের মধ্যেই আমরা পাই মানুষ অরুন্ধতীকে৷ সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র সান্নিধ্যে মানুষ হওয়ার ফলে, অরুন্ধতী দেবীর কথাবার্তায় বলতে গেলে ওঁর সারা সত্তায় একটা রবীন্দ্রময়তা ছিল৷ সেটা নানা সময় বাডি়তে ঘরোয়া আলোচনায় বোঝা যেত৷ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যখন আড্ডা বসত সেখানে সাংবাদিক, সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ, চলচ্চিত্র সমালোচক রবি বসু প্রমুখ উপস্থিত থাকতেন৷ সন্তোষবাবু থাকতেন নিউ আলিপুরে তপন সিংহর পাড়ায়৷ রবীন্দ্র বিষয়ে সন্তোষবাবুর পাণ্ডিত্যের কথা কারো অজানা নয়৷ সে কারণে ওই আলোচনা শুরু হলে আর শেষ হতে চাইত না৷ অনেক রাত পর্যন্ত গড়াতো৷ অরুন্ধতীর কথায়, গানে মজে যেতেন সন্তোষকুমার৷ একদিন কথায় কথায় বিস্ময় ভরা চোখে তিনি রবি বসুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা রবি, অরুন্ধতী সম্পর্কে তোমার অ্যাসেসমেন্ট কী? রবি বলেছিলেন, অরুন্ধতী বৌদি অসাধারণ সুন্দরী, দুর্দান্ত অভিনেত্রী, সুগায়িকা, একজন ভালো চিত্রপরিচালক৷ সন্তোষবাবু বলেছিলেন, তুমি একটা ইডিয়ট৷ অরুন্ধতীকে তুমি একদম চিনতে পারোনি৷ জানো, ওঁর ভিতরে রবীন্দ্রনাথ বাস করেন৷ কাল সারা সন্ধে ওদের বাড়িতে ওঁর গান শুনেছি৷ রাতে বাডি় ফিরে ভালো করে ঘুমোতে পারিনি৷ অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদেছি৷

অথচ আশ্চর্য এটাই, এমন একজন নারীর ব্যক্তিগত জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি৷ চিরস্থায়ী হয়নি প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবন৷ পরে অবশ্য তিনি আর এক স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক তপন সিংহর ঘরণী হন৷ এবং সেখানে কাজের পরিবেশ ছিল অতুলনীয়৷ আর হবে না-ই বা কেন! তপন সিংহ শুধু উঁচু দরের পরিচালক নন, একজন বড় মনের মানুষ ছিলেন৷ প্রকৃত বন্ধুর মতো অরুন্ধতীর পাশে দাঁডি়য়েছেন৷ তাঁর সব কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যা অরুন্ধতীর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করেছে৷ গোটা অভিনয়-জীবনে প্রায় চৌত্রিশটি ছবিতে অভিনয় করেছেন৷ ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃতও হয়েছেন বহুবার৷ তাঁর পরিচলিত ‘ছুটি’ ছবিটির জন্য ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রীয় রৌপ্যপদক লাভ করেন৷ ১৯৫৭ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব এবং কারলো ভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেন৷ তারও আগে ১৯৫১ সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক মিশনের সদস্য হয়ে আমেরিকা যান৷ এবছর ২৯ এপ্রিল এই কিংবদন্তী শিল্পীর জন্মশতবার্ষিকী৷ সে কথা আমরা যেন ভুলে না যাই৷

প্রথম বিয়ে ভেঙে গেলে তিনি পরবর্তী কালে ঘরনি হন তপন সিংহের৷ তাঁর ও তপন সিংহের বোঝাপড়া ছিল খুব গভীর৷ পরিচালক তপন ছিলেন অগোছালো মানুষ৷ সারাদিন তিনি ব্যস্ত থাকতেন নিজের ছবির কাজ ও পড়াশোনা নিয়ে৷ তাঁর জামাকাপড়, বইপত্র থেকে শুরু করে সংসারও যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন অরুন্ধতী৷ ছেলে ও স্বামীর খাওয়ার জলও ঢাকা দেওয়া থাকত টেবিলের উপরে৷ ঘরের কোনও আসবাবে ধুলো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত না৷ ছেলেমেয়েরা যাতে অমলিন চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হয়, সে দিকেও ছিল তাঁর কড়া নজর৷

ছেলে অনিন্দ্য তখন এক নামী কনভেন্টে পড়ছে৷ স্কুল থেকে ফিরে কী এক কথা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সে উল্লেখ করল ‘মিস্টার চ্যাটার্জি’ বলে৷ সেটুকুও কান এড়ায়নি অরুন্ধতীর৷ সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন স্কুল বদলের৷ সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে এসে ভর্তি করে দিলেন অন্য স্কুলে৷ মেয়ের ব্যাপারেও ছিল একই ধরনের নিয়মানুবর্তিতা৷

এতটা নিয়মানুবর্তিতা ছিল বলেই হয়তো একই জীবনে এত কিছু করতে পেরেছিলেন৷ অভিনয় জগতেও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র৷ ১৯৫২ সালে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবি দিয়ে তাঁর অভিনয় জগতে পদার্পণ৷ তার পরে ‘চলাচল’, ‘গোধূলি’, ‘বিচারক’, ‘জতুগৃহ’… কত ছবি৷ পাশাপাশি গানের রেকর্ডিংও তখন শুরু করেছেন৷ এইচএমভি থেকে বেরোচ্ছে ক্যাসেট৷ যেমন সুন্দরী ছিলেন, তেমনই ছিল অভিজাত ভাবভঙ্গি৷ ফলে খ্যাতি পেতে বেশি সময় লাগেনি৷ তিনি যখন অভিনয় করতে আসেন, সুচিত্রার সৌন্দর্যে তখন আপামর বাঙালি কাবু৷ তার মাঝেও আলাদা করে লাইমলাইট কেডে় নেন অরুন্ধতী৷ এমনকি পুরুষপ্রধান ছবিতেও তিনি আলাদা করে নজরে পড়তে শুরু করলেন৷ তাঁর আদবকায়দা, সংলাপ বলার ধরন… সবেতেই ছিল অভিজাত ভঙ্গি৷ সে সময়ের এক কাগজে তাঁকে ‘উওম্যান অব ক্লাস’ বলেও অভিহিত করা হয়৷

তখনও উত্তমকুমারের একটি ছবিও সফল হয়নি৷ অরুন্ধতীর নায়ক হিসেবে তাঁর ডাক এল ‘বকুল’ ছবিতে৷ সে ছবিতে অবশ্য অরুন্ধতীর অভিনয় ও ক্যারিশমায় চাপা পডে় যান উত্তম৷ পরে মহানায়ক স্বীকার করেছিলেন যে, পরের দিকে তিনি যত ছবি করেছেন অরুন্ধতীর সঙ্গে, একসঙ্গে দৃশ্য থাকলে আলাদা করে প্রস্তুতি নিতেন৷ তাঁর অভিজাত চেহারা, মার্জিত স্বভাব, ব্যক্তিত্ব… সবই যেন দু্যতি হয়ে ছডি়য়ে পড়ত চারপাশে৷
(সংগৃহীত)

রেডিয়োয় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক তৈরি হয় অরুন্ধতীর৷ কিন্ত্ত সে সম্পর্কে সায় ছিল না অরুন্ধতীর বাপের বাডি়র৷ তাই তাঁরা বাডি়র অমতেই বিয়ে করেছিলেন৷ কিন্ত্ত পরবর্তী সময়ে সে দাম্পত্য বিশেষ সুখের হয়নি৷ অরুন্ধতীর জনপ্রিয়তায় তাঁর স্বামী প্রভাতের মনে সম্ভবত ঈর্ষা ও সন্দেহপ্রবণতা তৈরি হয়েছিল৷

তাঁর মেয়ে অনুরাধা ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে প্রভাতের এই মানসিকতার কথা উল্লেখ করেন৷ অনুরাধা বলেন, ‘তখন বিদেশের অনেক অনুষ্ঠানেই মায়ের আমন্ত্রণ আসত৷ সুজান হেওয়ার্থ, গ্রেটা গার্বো, অ্যালফ্রেড হিচকক, রোনাল্ড রেগ্যান… কত গুণীজনের সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছে৷ সেবার বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তপন সিংহ ও অন্যান্যদের সঙ্গে মায়েরও আমন্ত্রণ এল৷ তখন মা দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা৷ বাবা বাধা দিলেন মাকে৷ কিন্ত্ত মা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ বাবা রাগের মাথায় মাকে বলে বসলেন যে, মায়ের গর্ভের সন্তান তাঁর নয়৷ যা ছিল সর্বৈব মিথ্যে৷ মা বার্লিন থেকে ফিরে আসার পরেই আলাদাভাবে থাকা শুরু হল৷ আমার তখন খুব কষ্ট হত৷ কিন্ত্ত বাবা কখনও আমাদের কাস্টডি নিতেও চাননি৷ বরং তপন সিংহ আমাদের স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন৷ ভাইকে তাঁর পদবী ও পরিচিতি দিয়েছিলেন৷ আমাকেও দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত আমি মেয়ে, বিয়ে হয়ে যাবে৷ তাই সেই ঝামেলায় আর যেতে চাইনি৷’

গানের মতোই তাঁর নাচ শেখার সঙ্গী ছিলেন কণিকা৷ গুরু ব্রজবাসী ও বালকৃষ্ণ মেননের কাছেও নাচ শিখেছিলেন অরুন্ধতী৷ কলকাতায় ‘গীতবিতান’ প্রতিষ্ঠার সময়ে অরুন্ধতী, কণিকারা একসঙ্গে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যও করেছেন৷ অরুন্ধতী শান্তা আর কণিকা সেজেছিলেন প্রমদা৷ নাটকের রিহার্সালে কবিগুরু নিজে গান গাইতেন আর বিবিদি বসতেন পিয়ানোয়৷ অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতেন অরুন্ধতী৷ যদিও তখন তিনি শান্তার ভূমিকায়, মন পডে় থাকত গানে৷ নাটক শেষ হতেই বিবিদির কাছ থেকে সেই সব গান তুলে নিতেন৷ অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, সঙ্গীতই হবে তাঁর পরিচয়৷ কিন্ত্ত জীবনে কোনও কিছুই নিশ্চিত নয়৷

এক সাক্ষাৎকারে শৈলজারঞ্জন দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘নুকু যদি শুধু গান নিয়ে থাকত, তা হলে আমার দুই ছাত্রীর স্থান হত একই আসনে৷’’ বিশ্বভারতীতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরুন্ধতী দেবী পরিচিত ছিলেন মোহর ও নুকু নামে৷ বিশ্বভারতীতে যখন পরীক্ষার রেজ়াল্ট বেরোল, তখন নুকু প্রথম ও মোহর দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন৷