পুলক মিত্র
নিঝুম মধ্যাহ্নকাল অলস-স্বপন-জাল
রচিতেছে অন্য মনে হূদয় ভরিয়া৷
দূর মাঠ-পানে চেয়ে চেয়ে চেয়ে শুধু চেয়ে
রয়েছি পডি়য়া৷
সেই কবে ছেলেবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া৷ কবি অক্ষয় কুমার বড়ালের কল্পনায় আঁকা মায়াবী দুপুরের এই ছবি আজও আমাদের স্বপ্ন বিলাসী করে তোলে৷
ঋতু চক্রের নিয়ম মেনে ফি বছর গ্রীষ্ম আসে৷ তবে ঊনিশ শতকের এই কবির মতো এখন আমরা আর অলস দুপুরের স্বপ্নের জাল বুনতে পারি না৷ বদলে আমাদের মনকে গ্রাস করে একরাশ আতঙ্ক, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা৷
এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অংশে ১০ থেকে ২০ দিন তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা শুনিয়েছেন ভারতের আবহাওয়া দফতরের মহানির্দেশক ডঃ মৃতু্যঞ্জয় মহাপাত্র৷
যদি কোনও জায়গার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পরপর দু’দিন ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয় কিংবা টানা পাঁচ বা তার থেকে বেশিদিন দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, গড় তাপমাত্রার চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেললিয়াস বেশি হয়, তখন সেই পরিস্থিতিকে তাপপ্রবাহ বলা যেতে পারে৷
এ তো গেল তাপপ্রবাহের কথা৷ এর পাশাপাশি এখানে আরও কিছু তথ্য তুলে ধরছি, যা সভ্যতার পক্ষে অশনি সঙ্কেত বলা যেতে পারে৷
১৮৫০ সাল থেকে তাপমাত্রার হিসেব রাখা শুরু হয়৷ উষ্ণতম বছরের রেকর্ড রাখা শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে৷ সেই হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩ সাল ছিল এই গ্রহের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর৷ শুধু তাই নয়, বলা হচ্ছে, সম্ভবত গত এক লাখ বছরের মধ্যে পৃথিবী সবচেয়ে উষ্ণতম বর্ষের রেকর্ড গড়েছে গত বছর৷
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লুএমও) জানিয়েছে, চলতি বছরও আমাদের কাছে খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে না৷ তাপপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া দফতরের বার্তা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে৷ ইতিমধ্যে আমরা তা টের পেতেও শুরু করেছি৷ এপ্রিল মাসে এ পর্যন্ত তাপপ্রবাহের যে দাপট দেখেছি, তা চিন্তার ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট৷
গ্রিন হাউস গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজোন এবং জলীয় বাষ্প), যা বায়ুমণ্ডলে তাপকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে রাখে, তার মাত্রা বেড়ে চলেছে৷ বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস বেড়ে যাওয়ার অর্থ পৃথিবীর উষ্ণায়ন বেড়ে যাওয়া৷ ফল হিসেবে, জলবায়ু ঘটিত বিভিন্ন বিপর্যয় (খরা, অতিবৃষ্টি, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি) দেখা দেওয়া৷
বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে আন্টার্কটিকা ও সুমেরু মহাসাগরের বিপুল পরিমাণ বরফ গলে চলেছে৷ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ২০২২ সালে ৩টি প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস – কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের রেকর্ড বৃদ্ধি ঘটেছে৷ ২০২৩ সালেও তা বজায় ছিল৷
ভারতীয় আবহাওয়া দফতর (আইএমডি) ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসকে ১৯০১ সালের পর উষ্ণতম ফেব্রুয়ারি হিসেবে ঘোষণা করেছিল এবং গত বছরের এপ্রিল মাসও গোটা দেশ তীব্র তাপপ্রবাহের সাক্ষী থেকেছে৷ ১৭ মে, ২০২৩ তারিখে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জানান, ভারত ও বাংলাদেশে এই তাপপ্রবাহের জন্য বেশি দায়ী মনুষ্য-সৃষ্ট কারণ৷ এরপর জুন মাস উষ্ণতম জুন এবং জুলাইয়ে আরও রেকর্ডের সাক্ষী হয় ভারত৷ ৩ জুলাইকে এ যাবৎ কালের উষ্ণতম দিন হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়৷
জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার শীর্ষ বিজ্ঞানীরা জুলাই মাসকে ‘‘শত শত বছর, এমনকি হাজার হাজার বছরের’’ মধ্যে উষ্ণতম মাস হয়ে ওঠার পূর্বাভাস দেন৷ ২৭ জুলাই ডব্লুএমও-র রিপোর্টে দেখা গেল, জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহ সর্বকালের মধ্যে উষ্ণতম হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে৷
এ বছরের জানুয়ারিতে আইএমডি জানায়, ১৯০১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ২০২৩ সালই ছিল সবচেয়ে উষ্ণ বছর৷ কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসেস-ও জানায় যে, ১৮৫০ সাল থেকে এ যাবতকালের মধ্যে ২০২৩-ই ছিল উষ্ণতম বর্ষ৷ আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন সহ অন্যান্য কারণে অতিমারীর সময়ের তুলনায় খাদ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতার (কোভিডের সময় ছিল ১৪৯ মিলিয়ন, ২০২৩-এ বেড়ে হয়েছে ৩৩৩ মিলিয়ন) শিকার হয়েছেন দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ৷ এই তথ্য মিলেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি থেকে৷
তাপপ্রবাহ, দাবানল, খরা, বন্যা, সাইক্লোন– বিশ্বজুড়ে এই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ পৃথিবীর জনসংখ্যার একটা বড় অংশের মানুষের জীবনের ওপর এগুলির প্রভাব পড়েছে৷
এগুলির মধ্যে একমাত্র রূপালি রেখা হল, ২০২৩-এ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি৷ ২০২২-এর তুলনায় গত বছর এই শক্তির উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়ে ৫১০ গিগাওয়াটে পৌঁছে গিয়েছে৷ গত দুই দশকের মধ্যে এটি সর্বশেষ বৃদ্ধি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা৷
জলবায়ু-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় অর্থের জোগানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ২০২১-২২ সালে এই খাতে খরচ করা হয়েছে ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৯-২০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ৷ তবুও তা পর্যাপ্ত নয়৷ এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৬ গুণের বেশি বাড়িয়ে ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে নিয়ে যেতে হবে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠেছে পৃথিবী৷
কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরুর আগের দীর্ঘ সময়ের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির তুলনায় গত বছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ আরও দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাস থেকে প্রায় প্রতিদিন বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছে৷
গত মাসে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সূচক ৬২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করেছিল৷ এর কারণ হল, পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত আমাজনের বনভূমির নির্বিচার ধ্বংস৷
আমাজন কার্বন শোষণ করে বলেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে৷ কিন্ত্ত ভয়ের ব্যাপার হল, গত ১২ বছরের মধ্যে এবারই বন ধ্বংসের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থা৷
তাদের তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলে ২০১৯ সালের অগাস্ট থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত আমাজনের ১১ হাজার ৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়েছে৷
বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট বা প্রবল বর্ষণের বনাঞ্চল হচ্ছে আমাজন৷ আমাজনকে বলা হয় জীব বৈচিত্র্যের আধার৷ প্রায় ত্রিশ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং ১০ লাখ জনজাতির আবাসস্থল হল এই বনভূমি৷
আমাজনের এই বিপন্নতা আজ গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে৷ তাই বিশ্বের দেশে দেশে উষ্ণায়নের আঁচ পড়েছে৷ ব্যতিক্রম নয় ভারতও৷ এখনই সতর্ক না হলে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই বিপন্ন হবে এই গ্রহের অস্তিত্ব৷