শুরু হয়ে গেল অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্ব৷ সংসদীয় নির্বাচন তো শুধু ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া নয়, তা কেবলমাত্র একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে না৷ এর উৎসে আছে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খা, আর দেশ পরিচালনায় অংশীদারিত্বের তীব্র ইচ্ছা৷ সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন পদ্ধতি তাকেই ফলবতী করে তোলার মাধ্যম৷ তাই নির্বাচনকে বলা হয় রাজনৈতিক সংগ্রাম৷ এ বছর লোকসভা নির্বাচন এমন একটা সময়ে হতে চলেছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা বিপদজনক পরিস্থিতির মধ্যে৷ সাম্প্রদায়িক স্বৈরতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, এই দুইয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সচেতন নাগরিককে৷
মোদির নেতৃত্বাধীন বিগত এক দশকের বিজেপি সরকার দেশের সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার চারটি স্তম্ভ— ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, আর্থিক সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং বহু ভাষা, বহু জাতি-ধর্মের দেশে সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো— সব কিছুকে আজ এক অতলান্ত খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে৷ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে ক্ষমতার নগ্ন অপব্যবহার মোদি সরকারের এক এবং একমাত্র বৈশিষ্ট্য৷ এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনপ্রতিনিধিত্বের দায়বদ্ধতাকে বাতিল করে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের পথকেই তারা বেছে নিয়েছে৷ মোদি সরকারের এই শাসন প্রক্রিয়া আসলে স্বৈরতন্ত্রেরই নামান্তর৷ আরএসএসের রাজনৈতিক মুখোশ হিসাবে আসন্ন নির্বাচনে তাই বিজেপির লক্ষ্য, ভারতের উদারমুখী সমাজভাবনাকে সাম্প্রদায়িকতায় বিষিয়ে তোলা, যাতে মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসের অবলম্বনটাই হারিয়ে যায় এবং যুক্তি, বিচারবোধ আর বাস্তব অভিজ্ঞতাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মিথ্যায় ঢেকে দেওয়া যায়৷ কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচারের গর্ভে জন্ম নেওয়া ‘রাষ্ট্রগুরু’র নির্লিপ্ত ভালোমানুষি চেহারাকে সামনে রেখে বর্বর পাশবিকতার অতীতে আধুনিক ভারতকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে গেরুয়াবাহিনি৷
নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণের রাজনীতি ভারতকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত করে তুলেছে৷ সীমাহীন বেকারত্ব, আকাশছোঁয়া আয়বৈষম্য, আর উল্কাগতির মূল্যবৃদ্ধি তারই প্রতিফলন৷ দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিরা আরএসএস-বিজেপির স্বৈরাচারে মুগ্ধ অনুগত৷ ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ দুর্নীতি তারই প্রতিফলন— তাদের মুগ্ধ আনুগত্যের সোচ্চার ঘোষণা৷ বিনিময়ে দাবি, এদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের অবশিষ্ট সব কিছু বা রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলি প্রায় বিনামূল্যে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে৷
তবে এই আগ্রাসন, স্বৈরাচারের পদধ্বনিই শেষ কথা নয়৷ প্রতিবাদের ভাষাও গোটা দেশজুড়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে৷ শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী, দলিত, মহিলা-ছাত্র-যুব-কর্মচারী—সকলের রাস্তার লড়াইয়ের সাক্ষ্য এদেশের রাজপথ থেকে মেঠো পথ৷ এই সমস্ত লড়াই-আন্দোলন, বিশেষ করে দিল্লির বুকে কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও তার সাফল্য নিশ্চিতভাবেই প্রত্যয় জাগিয়েছে যে, নগ্ন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পেশী আস্ফালনকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, তাকে পরাস্ত করা যায়৷ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামেরই অপর নাম নির্বাচনী-যুদ্ধ৷ লোকতন্ত্র বাঁচাতে সেই লড়াইই শুরু হল আজ৷ ক্ষমতা দখলের জন্য কিছু কিছু কেন্দ্রে, বিশেষ করে কোচবিহারে বিক্ষিপ্ত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে আমজনতা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে৷