নিশীথ সিংহ রায়
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে স্টেটসম্যান গ্রুপের দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকা বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি বা বিনোদন মূলক রচনায় সমৃদ্ধ ‘নববর্ষ ১৪৩১’ শীর্ষক ম্যাগাজিন গত ২৯/১২ /১৪৩০ ইংরেজি 12/4/24, শুক্রবার কলকাতার রোটারি সদনে প্রকাশ করে৷ এ উপলক্ষে স্টেটসম্যান জাকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে সাহিত্য, নাটক, সিনেমা বা খেলার জগতের বিশিষ্ট গুণিজনের উপস্থিতিতে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আলোয় আলোকিত করার যে শুভপ্রচেষ্টা করেছে তাতে ম্যাগাজিন সম্পর্কিত সমাজের বিশিষ্ট জনের মতামতে আমরা যেমন সমৃদ্ধ হলাম তেমনি ভবিষ্যতে আমরা এরকম বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে আরও তথ্যনির্ভর ও সাহিত্য সমৃদ্ধ ম্যাগাজিন বা গ্রন্থ প্রকাশ করার পাথেয় ও সাহসও পেলাম৷ সাধারণত বাংলা নববর্ষে বাংলা ম্যাগাজিন প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলার খ্যাতসম্পন্ন সংবাদপত্র বা প্রকাশকদের যে উন্নাসিক ভাব প্রকাশ পায় তা বাংলার ঐতিহ্যকেই আঘাত করে৷ সেখানে দাঁডি়য়ে স্টেটসম্যান গ্রুপের নববর্ষে বাংলার সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যশীল সাহিত্য-সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এই শুভ প্রয়াসের এক অংশীদার হতে পেরে আমি দারুণ দারুণ ভাবে গর্বিত৷
কলকাতার সুবিখ্যাত রোটারি সদন অডিটোরিয়ামে সন্ধ্যা ৬.১৫ মিনিটে স্টেটসম্যান গ্রুপের ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ পত্রিকা ও ‘নববর্ষ ১৪৩১’ সংখ্যার সম্পাদক শেখর সেনগুপ্ত মহাশয়ের স্বল্প ও মর্মস্পর্শী ভাষণে ম্যাগাজিন প্রকাশের আদ্যোপান্ত বলেন৷ এরপর অনুষ্ঠানে আগত বিশিষ্ট অতিথিদের বাঙালির চিরাচরিত প্রথায় পুষ্পস্তবক ও মেমেন্টো দিয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চে সংবর্ধনা জানানো হয়৷ স্টেটসম্যান গ্রুপের কলকাতার কর্ণধার গোবিন্দ মুখার্জী তাঁর নাতিদীর্ঘ ভাষণে অনুষ্ঠান এবং পত্রিকা সম্বন্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্য রাখেন৷ এরপর প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক শুভ সূচনা হয়৷ এবার গানের পর্ব৷ বাঙালির বর্ষবরণ বা বাংলা ম্যাগাজিন উদ্বোধনে রবী ঠাকুর থাকবেন না তা কি কখনও হয়? রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মহুয়া সুর এলেন মঞ্চ মাতাতে৷ দূরদর্শন ও বেতার খ্যাত বিশিষ্ট শিল্পী মহুয়া সুর, তিনি তাঁর সুরেলা কণ্ঠের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় অডিটোরিয়ামে উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দকে আকৃষ্ট করে রাখেন৷ এরপর ‘বৈশাখী আড্ডায় বাঙালির একাল-সেকাল’ শীর্ষক আলোচনার মধ্যমণিগণ একে একে মঞ্চে আসেন৷ শুরু হয় দেড় ঘন্টা ব্যাপী গুণিজনদের বৈঠকী আড্ডা৷ কোনো ভাবগম্ভীর আলোচনা নয়, ঘরোয়া পরিবেশে বাঙালি বৈশাখ মাসে কিভাবে আচার-পার্বণ করে বা করতো তা নিয়ে এক নিটোল আড্ডা৷ অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা একেবারেই তাঁদের চোখে দেখা বা পড়া এবং নিজের জীবনের বাস্তব কাহিনী তুলে ধরেন এই নির্ভেজাল আড্ডায়৷ বৈঠকী আড্ডাটি ছিল সত্যিকারের চাঁদের হাট৷ ছিলেন সমাজের সর্বশ্রেণীর বিদগ্ধ আলোচকগণ৷ যেমন শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদ বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে জমাটি এই অনুষ্ঠানটি উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দ খুবই উপভোগ করেন৷ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, যিনি শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রীই নয় তিনি একাধারে সমাজসেবক, ভারত সেরা বক্সার বা বাংলা সাহিত্যের একজন বরিষ্ঠ লেখকও৷ ছিলেন ডঃ পবিত্র সরকার মহাশয়৷ যিনি শুধু রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্যই নন, তিনি বিশ্বখ্যাত ভাষাবিদ এবং সুলেখক৷ তাঁর সাহিত্য ছাড়াও জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিকের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে লেখা খুবই সমাদৃত৷ কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী, সমাজ সচেতনতার বিষয়ে যিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত৷ যাঁর লেখা ‘লাল পাহাডি়র দেশে যা’ গানটি বাংলা ছাড়াও আরও ছাব্বিশটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে৷ এসেছিলেন সুদেষ্ণা রায়৷ যিনি বিশিষ্ট অভিনেত্রী, সিনেমা পরিচালক ও শিশু সুরক্ষা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন৷ উপস্থিত ছিলেন উর্মিমালা বসু৷ অর্দ্ধ শতাব্দী জুডে় যাঁর গলার যাদুতে আপামর বাঙালি মজে আছে সেই উর্মিমালা বসু৷ আর নাট্যকার গৌতম হালদার মহাশয়৷ শারীরের মোচডে়ও যে নাটক করা য়ায় তার কুশীলব তিনি৷ আর মুখের অভিব্যক্তি এবং গানের মাধ্যমে যিনি চিরাচরিত প্রথার নাটককে এমন এক ব্যতিক্রমী জায়গায় নিয়ে গেছেন যা দর্শকদের চুম্বকের মতো টানে এবং অভিভূত করে রাখে৷ সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক সৈয়দ হাসমত জালাল৷ যাঁর সুচারু পরিচালনার গুণে অনুষ্ঠানটি আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে৷
এরপর আসে সেই মহীন্দ্রক্ষণ৷ যাঁদের অমূল্য সৃষ্টি ‘নববর্ষ ১৪৩১’ ম্যাগাজিনটিকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের ম্যাগাজিনের তরফ থেকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা৷ উপস্থিত দর্শকবৃন্দের হল ফাটানো স্বতঃস্ফূর্ত করতালির মাঝে লেখক-লেখিকাদের মঞ্চে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়৷ অনুষ্টানের শেষলগ্ণে ছিল অতিথিবৃন্দের জন্য রাতের খাবারের আয়োজন৷ এভাবে কখন যে নির্ধারিত সময় ছেডে় অনুষ্ঠান দুই যামিনী পেডি়য়ে যাচ্ছে সেদিকে মোহিত দর্শকবৃন্দেরও যেমন হুঁশ ছিল না তেমনই কুশীলবদেরও৷
এবার আসি ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে৷ ‘নববর্ষ ১৪৩১’ এই ম্যাগাজিনটির বিশেষত্ব হচ্ছে এটি খুবই বৈচিত্র্যময়৷ যেমন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ও সুলেখিকা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের লেখায় সমৃদ্ধ তেমনই বিশিষ্ট সাহিত্যিক অমর মিত্র, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সবুজকলি সেন, সুখেন্দু হীরা বা শমীকস্বপন ঘোষের লেখাতেও সমৃদ্ধ৷ আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছেন পোড়খাওয়া সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল বা দেবাশিস দাস মহাশয়৷ আছে বাঙালির প্রিয় রিয়েলিটি শো দিদি নং -১ এর সঞ্চালিকা রচনা ব্যানার্জ্জীর সাক্ষাৎকার৷ বাঙালি মাত্রই একটু ভাবুক৷ ভাবের বহিঃপ্রকাশই তো কবিতা৷ তাই বাঙালি থাকবে কবিতা থাকবে না তাই কখনও হয়? সেই কবিতায় যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন, তেমন আছেন অরুণ কুমার চক্রবর্তী, রতনতনু ঘাটী, হাননান আহসান বা শ্যামলকান্তি দাশের মতো বিশিষ্ট কবিদের লেখা৷ লিখেছেন বাংলাদেশের সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা৷ প্রবন্ধের ক্ষেত্রে পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ রাজ্য সরকারের পরিবেশ সম্পর্কিত মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন পরিবেশের দূষণ সমস্যা৷ শান্তিনিকেতনের বর্ষবরণ নিয়ে লিখেছেন সবুজকলি সেন৷ তেমনই রবীন্দ্রনাথ নিজের জন্মদিনে পাহাড় থেকে কবিতা পডে়ছিলেন তা নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ ‘কর্মসংস্থান’ ও সুখবর পত্রিকার সম্পাদক শমীকস্বপন ঘোষ ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান নিয়ে লিখেছেন৷ ওপার বাংলার শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন লিখেছেন বৈশাখ মাসে বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে৷ সম্বুদ্ধ দত্ত সুইডিশ নাইটেঙ্গেল জেনি লিন্ডকে নিয়ে কলম ধরেছেন৷ আছে খাদ্যরসিক বাঙালিদের জন্য একটা সুন্দর রেসিপি৷ গ্রীষ্মের দাদানলে পুডে় কি খাবারে তৃপ্ত হবেন? সে সম্বন্ধে সুন্দর ভাবে আলোকপাত করেছেন খাদ্য বিশেষজ্ঞ সুলেখিকা ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়৷ বাঙালি যেমন খাদ্যরসিক তেমন ভ্রমণপ্রিয়ও৷ তাই ভ্রমণ সম্বন্ধে লেখা থাকবে না তাই কি কখনও হয়? সে ব্যাপারে কলম ধরেছেন ভ্রমণ বিশেষজ্ঞ সুখেন্দু হীরা ও মধুছন্দা মিত্র ঘোষ৷ সুখেন্দু বাবুর কলমে শুধুমাত্র ভ্রমণ সম্পর্কীয় তথ্য নয় ফুটে উঠেছে ওই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা ও তাঁদের সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রাও৷ মধুছন্দার তথ্যসমৃদ্ধ লেখায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে কোঙ্কণ উপকূলের বিস্তারিত বিবরণী৷
অর্থাৎ সমাজের সর্বশ্রেণীর গুণিজনের অভিজ্ঞতার ডালি দিয়েছে সাজানো স্টেটসম্যান গ্রুপের এই ‘নববর্ষ ১৪৩১’ সংখ্যা৷ তেমনই আশা করি সমাজের সর্বশ্রেণীর নিষ্ঠাবান, সাহিত্য-পিপাসু পাঠক-পাঠিকার কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে এই ‘নববর্ষ ১৪৩১’ সংখ্যাটি৷
পত্রিকার অতিথি সম্পাদক হিসেবে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি স্টেটসম্যান গ্রুপের কলকাতা অফিসের প্রধান আধিকারিক মাননীয় গোবিন্দ মুখার্জী মহাশয়ের আমার উপরে রাখা আস্থাকে সম্মান জানাতে৷ এই অনুষ্ঠানে আগত সকল সাহিত্যপ্রেমী দর্শককে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁরা তাঁদের অমূল্য সময় ব্যয় করে অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমন্ডিত করতে সাহায্য করেছেন৷ ধন্যবাদ জানাই সেই সকল লেখক-লেখিকাকে যাঁরা তাঁদের অমূল্য লেখা দিয়ে পত্রিকাটিকে সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন৷ ধন্যবাদ জানাই স্টেটসম্যান গ্রুপের সেই সমস্ত সহকর্মীদের যাঁরা এই বই প্রকাশে আমাকে সর্বতভাবে সাহায্য করেছেন বিশেষত সুনিতা দাসকে যিনি এই ম্যাগাজিনের সহসম্পাদিকাও বটে তাঁর প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া এই বই আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারতাম না৷ সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷