• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

কেরালায় কুস্তি, বাংলায় দোস্তি, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নামে কংগ্রেস-সিপিএমের ভন্ডামি

পুলক মিত্র: দক্ষিণের রাজ্য কেরালায় এখন শাসন ক্ষমতায় রয়েছে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএফ)৷ আর প্রধান প্রতিপক্ষ অর্থাৎ বিরোধী পক্ষ হল, সংযুক্ত গণতান্ত্রিক জোট (ইউডিএফ), যার নেতৃত্বে রয়েছে কংগ্রেস৷ এবার এখানকার লোকসভার ২০টি আসনেই পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কেরলে বিজেপি এখনও অত্যন্ত দুর্বল শক্তি৷ তাই মূল লড়াই সিপিএম ও কংগ্রেসের মধ্যে৷ পশ্চিমবঙ্গে যেখানে সিপিএম-কংগ্রেসের এত

পুলক মিত্র: দক্ষিণের রাজ্য কেরালায় এখন শাসন ক্ষমতায় রয়েছে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএফ)৷ আর প্রধান প্রতিপক্ষ অর্থাৎ বিরোধী পক্ষ হল, সংযুক্ত গণতান্ত্রিক জোট (ইউডিএফ), যার নেতৃত্বে রয়েছে কংগ্রেস৷ এবার এখানকার লোকসভার ২০টি আসনেই পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কেরলে বিজেপি এখনও অত্যন্ত দুর্বল শক্তি৷ তাই মূল লড়াই সিপিএম ও কংগ্রেসের মধ্যে৷

পশ্চিমবঙ্গে যেখানে সিপিএম-কংগ্রেসের এত মাখামাখি, সেখানে কেরলে দুই দলের এই লড়াই কিছুটা আশ্চর্য্যজনক মনে হতে পারে৷ তার চেয়ে বড় কথা হল, কেরলের যুযুধান দুই পক্ষই আবার বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র শরিক৷
বিজেপি দুর্বল শক্তি হলেও, কেরালায় আর এস এসের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে৷ তবুও গত লোকসভা আসনে এই রাজ্য থেকে একটিও আসনে জিততে পারেনি বিজেপি৷ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ইউডিএফ একাই ১৯টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল৷ এর মধ্যে ১৫টি কংগ্রেস এবং বাকি ৪টি জিতেছে তাদের জোটসঙ্গী ইউনিয়ন অফ মুসলিম লিগ (আইইউএমএল), আরএসপি এবং কেরালা কংগ্রেস মণি (কেসিএম) গোষ্ঠী৷

২০১৮ সালে ত্রিপুরায় ক্ষমতাচু্যত হয় সিপিএম৷ এরপর ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে কেরালায় বড় ধাক্কা খায় সিপিএম৷ তারা শুধুমাত্র আলাপ্পুঝা আসনটিতে জিততে সক্ষম হয়৷ দেশে তখন ৬টি রাজ্য কংগ্রেসের দখলে ছিল৷ সংসদেও সেসময় প্রধান বিরোধী দল ছিল কংগ্রেসই৷

তবে গত ৫ বছরে কেরালায় জমি হারিয়েছে কংগ্রেস৷ এর অন্যতম মূল কারণ হল, রাজ্যের দাবিদাওয়া সংসদে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কংগ্রেস সাংসদদের ব্যর্থতা৷ বিশেষত, রাজ্যের প্রাপ্য টাকা কেন্দ্র আটকে রাখলেও, তা নিয়ে খুব সরব হতে দেখা যায়নি কংগ্রেস সাংসদদের৷ রাজ্যের অধিকার আদায়ে শাসক ও বিরোধী শিবির কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একজোট হলেও, তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ এতে ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে৷

এলডিএফ-এর নির্বাচনী ইস্তাহারে সিএএ কার্যকর করা হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷ অন্যদিকে, ইউডিএফ এই ইসু্যতে সুস্পষ্ট কোনও অবস্থান নিতে পারেনি, যা ভোটারদের অনেককে হতাশ করেছে এবং এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে৷

কেরালায় ভোটারদের মধ্যে সংখ্যালঘু মুসলিম রয়েছেন ২৬.৫৬ শতাংশ এবং ভোটের ফলাফল নির্ধারণে তাঁদের নির্ণায়ক ভূমিকা রয়েছে৷ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় কংগ্রেস কতটা তৎপর হবে, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে৷
কংগ্রেসের অন্যতম শরিক কেসিএম ২০২০ সালে ইউডিএফ ছেড়ে এলডিএফ-এ যোগ দিয়েছে৷ ২০১৯-এর ভোটে এই দল একটি আসনে জয়ী হয়েছিল৷ ওই ভোটে কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়ের জন্য তৃণমূল স্তরে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন কেসিএম-এর কর্মীসমর্থকরা৷ এছাড়া, অনেক কংগ্রেস নেতা ইতিমধ্যে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন৷ এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, এক সময়ের কংগ্রেস নেতা কে করুণাকরণের কন্যা পদ্মজা বেনুগোপাল৷

তবে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ নিয়ে কংগ্রেস – বিজেপি, দুই দলই সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ দুই দলই এমআরএফ-এর কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিয়েছে৷ অন্যদিকে, বন্ড থেকে অর্থ না নিয়ে কেরালায় নিজের নৈতিক ভিত্তি শক্ত করেছে সিপিএম৷ পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা এবং করোনা অতিমারীর সময় ভালো কাজ করার সুবাদে, ২০২১-এর বিধানসভার ভোটে ফের জয়ী হয় এলডিএফ৷ এবারের লোকসভার ভোটে কেরালায় কংগ্রেসের তুলনায় সিপিএম অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷

কেরালার ওয়ানাড় লোকসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রাহুল গান্ধি৷ এখানে রাহুলের বিরুদ্ধে এলডিএফ-এর প্রার্থী হলেন, সিপিআই-এর অ্যানি রাজা৷

রাজনীতির এ এক অদ্ভূত খেলা৷ কেরলে কংগ্রেস-সিপিএম প্রবল প্রতিপক্ষ৷ আর পশ্চিমবঙ্গে দুই দল যেন ভাই ভাই৷ এখানে সিপিএমের কংগ্রেস প্রীতি এতটাই যে, শরিকদের আসন কেড়ে তা কংগ্রেসের হাতে তুলে দিতে পিছপা হয়নি সিপিএম৷

যেমন পুরুলিয়া৷ এই আসনে এতকাল ধরে প্রার্থী দিয়ে এসেছে বাম শরিক ফরোয়ার্ড ব্লক৷ এবার পুরুলিয়ায় প্রার্থী দিয়েছে কংগ্রেস৷ সেখানে ধীরেন মাহাতোকে প্রার্থী করেছে ফরওয়ার্ড ব্লকও৷ কিন্ত্ত তাঁর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেননি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু৷ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম জানিয়েছেন, ‘‘বিমান বসু যে নাম ঘোষণা করেননি, তিনি বামফ্রন্টের প্রার্থী নন৷ ওখানে তৃণমূল এবং বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়বে কংগ্রেস৷ বামফ্রন্ট কংগ্রেসকে সমর্থন করবে৷’’

এবার আসা যাক বসিরহাটের কথায়৷ স্বাধীনতার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জিতেছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী৷ পরবর্তীকালে হুমায়ুন কবির, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মতো ব্যক্তিত্ব বসিরহাট থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ ২০০৯ থেকে টানা তিনটি নির্বাচনে তৃণমূলের দখলে থাকা এই কেন্দ্রে ২০১৯-এ জেতেন অভিনেত্রী নুসরত জাহান৷ এই লোকসভার অধীন বিধানসভার ৭টি আসনেই (সন্দেশখালি, হাড়োয়া, বাদুডি়য়া, মিনাখাঁ, বসিরহাট উত্তর, বসিরহাট দক্ষিণ এবং হিঙ্গলগঞ্জ) জিতেছিল তৃণমূল৷ এবার এই কেন্দ্রে লড়ছেন সিপিএমের নিরাপদ সর্দার৷

অন্যদিকে, বাম-কংগ্রেস জোট হলেও, কোচবিহারে কংগ্রেস এবং ফরওয়ার্ড ব্লক, দুই দলই প্রার্থী দিয়েছে৷ আবার বসিরহাট, ব্যারাকপুর ও মথুরাপুরে সিপিএম একতরফাভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করায় বেজায় রুষ্ট কংগ্রেস৷ কারণ, এই আসনগুলিতে প্রার্থী দিতে চেয়েছিল কংগ্রেস৷

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে আইএসএফ-এর হাত ধরেছিল সিপিএম৷ এবার সিপিএম-কংগ্রেস যেভাবে নিজেদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ আইএসএফ৷ তিন দফায় ১৩টি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে আইএসএফ৷ এগুলি হল জঙ্গিপুর, বনগাঁ, কৃষ্ণনগর, মালদা উত্তর, জয়নগর, মুর্শিদাবাদ, বারাসত, বসিরহাট, মথুরাপুর, ঝাড়গ্রাম, শ্রীরামপুর, ডায়মন্ডহারবার, যাদবপুর, বালুরঘাট, উলুবেডি়য়া এবং ব্যারাকপুর৷ আইএসএফ আলাদা প্রার্থী দেওয়ায়, সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল – তিন দলেরই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরবে৷ তাতে বাড়তি লাভ হতে পারে বিজেপির৷

সব মিলিয়ে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলায় ‘ইন্ডিয়া’ নামক জোট তৈরি হলেও, তা কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে৷ আর এই জোটকে আমজনতার কাছে হাস্যকর করে তোলার জন্য দায়ী কংগ্রেস, সিপিএম দুই দলই৷