• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

রামলালাজির ঘরের ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী কি রামলালাজির চেয়েও বড়?

বরুণ দাস জানুয়ারিতে রামমন্দির উদ্বোধন ও রামলালাজির প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এতদিনে রামলালা ‘ঘর পেলেন’৷ অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘরের ব্যবস্থা না করলে রামলালাজি গৃহহীন অবস্থায় দিন কাটাতেন৷ রামলালাজির এই দুঃখ তিনি অবশেষে ঘোচালেন৷ আরাধ্য দেবতাকে মাথা গোঁজার স্থান দিয়ে তিনি মহৎ কাজ করেছেন— সম্ভবত এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন৷ আপামর রামভক্তদের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তিনি এই

বরুণ দাস

জানুয়ারিতে রামমন্দির উদ্বোধন ও রামলালাজির প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এতদিনে রামলালা ‘ঘর পেলেন’৷ অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘরের ব্যবস্থা না করলে রামলালাজি গৃহহীন অবস্থায় দিন কাটাতেন৷ রামলালাজির এই দুঃখ তিনি অবশেষে ঘোচালেন৷ আরাধ্য দেবতাকে মাথা গোঁজার স্থান দিয়ে তিনি মহৎ কাজ করেছেন— সম্ভবত এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন৷

আপামর রামভক্তদের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তিনি এই গূঢ় বার্তাটুকুই দিতে চেয়েছেন৷ প্রচারের ঢক্কানিনাদে রামলালাজিকে ছাপিয়ে গেছেন রামভক্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজি৷ সবার নজরই ছিল তাঁর দিকে৷ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের প্রধান লক্ষ্যও ছিল সম্ভবত একই দিকেই৷ ফলে অযোধ্যায় রামলালাজি গৌণ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজিই মুখ্য হয়ে উঠেছিলেন৷ শাসকদলের উদ্দেশ্যেও ছিল সম্ভবত তাই৷

তাঁর এই মহৎ কাজের জন্য তিনি নিজে যেমন উল্লসিত, তেমনি তাঁর দলও উল্লাস করেছে৷ এই উল্লাস অবশ্য দলগত পর্যায়েই থেমে থাকেনি, গোটা ভারতবাসীর মধ্যেই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁরা৷ অসমাপ্ত মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে কতিপয় বিশিষ্ট সাধু-সন্ত প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও তাতে খুব একটা গুরুত্ব দেননি মামনীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের অতি উৎসাহী লোকজন৷

রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে ওই বিশিষ্ট সাধুসন্তজনেরা অবশ্য প্রাপ্য গুরুত্ব পাননি বলে বিরোধিতা করেছিলেন এমনটাই অভিযোগ অনেকের৷ কেউ কেউ গুরুত্ব পাবে, কেউ কেউ পাবে না— এমনটা হলে তো ক্ষোভ জন্মানোরই কথা এবং জন্মেছিলও৷ সাধুসন্তজনেরা কি মানুষ নন? তাঁদের কি মান-সম্মানবোধ থাকতে পারে না? তাঁদের মান্যতা না দিলে কি ক্রোধান্বিত হতে পারেন না?
ওই বিশিষ্ট সাধুসন্তজনদের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে হাতিয়ার করে বিরোধীপক্ষ অবশ্য বাজার মাত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল৷ কিন্ত্ত বাস্তবে তা সফল হয়নি৷ যে বামপন্থীরা ধর্ম মানেন না, তাঁরাও সাধুসন্তজনদের বক্তব্যকে ‘গুরুত্ব দিয়ে’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে লাগাতর বিষোার শুরু করেছিলেন কিন্ত্ত ধোপে টেকেনি৷ তাই শেষকালে হতাশ হয়ে চুপ করতে বাধ্য হয়েছেন৷

যাঁরা ধর্মকে আফিং বলে বিশ্বাস করেন, তাঁরাই যদি ধর্মীয় গুরুদের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে কারও বিরুদ্ধে প্রচারে নামেন, তাহলে বলতেই হয়, এদেশে বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকার৷ দ্বিচারিতারও একটা সীমা থাকে যা এদেশের বামপন্থীদের মধ্যে দেখা যায় না৷ তাঁরা যখন যা হাতের কাছে পান, বাছবিচার না করেই তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েন৷ একশো বছরেও বোধোদয় হল না৷

তাঁরা একদিকে যেমন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা বিজেপির বিরোধিতা করেন, অন্যদিকে নির্বাচনের আগে ধর্মীয় জলসাপন্থী উগ্র নেতার সঙ্গে প্রকাশ্য মঞ্চে হাত মেলান৷ একমাত্র লক্ষ্য কিছু ভোট পাওয়া৷ এবং সেই ‘লক্ষ্য পূরণ’-এ তাঁরা চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েও কিছুমাত্র শিক্ষা নেন না৷ আবারও একই পথে হাঁটেন৷ আসলে তাঁরা সম্ভবত শিক্ষা দিতে জন্মেছেন, শিক্ষাগ্রহণ করতে নয়৷ এ এক আজব কাণ্ড৷

এদেশের বামপন্থীরা আর কবে যে সাবালক হবেন কে জানে? এই অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে আবার যেন ঠোঁট উল্টাবেন না মাননীয় কমরেডগণ৷ বয়স তো আপনাদের দলের একশো পেরিয়েছে৷ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও আপনাদেরই বয়সী৷ তাঁরা দিনে দিনে গোটা দেশজুড়ে ডালপালা ছড়িয়ে দিল্লির মসনদে দখল নিয়েছেন আর আপনারা? ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন রাজ্য থেকে এক রাজ্যে পেঁৗছেছেন৷

আপনারা হয়ত নিঃসঙ্কোচে (এক্ষেত্রে নির্লজ্জ কথাটিই হয়ত প্রাসঙ্গিক ছিল) বলবেন, এটা তো আপনাদের ভুল নয়, জনসাধারণের ভুল৷ তারা আপনাদের মূল্যায়নে ব্যর্থ৷ বেশ তা না হয় মেনে নেওয়া গেল৷ কিন্ত্ত আপনারা এই একশো বছরে জনগণকে কী শিক্ষা দিতে পেরেছেন? যে শিক্ষায় একজন সাধারণ খেটেখাওয়া মেহনতী মানুষ আপনাদের সঙ্গ ছেড়ে যাবেন না? অন্তত নিজের সামগ্রিক স্বার্থেই৷

উল্লেখ্য, সাবেকি হিন্দু মহাসভা থেকে জনসংঘ এবং পরে জনসংঘ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি শ্রীরামচন্দ্র-রামলালা-রামমন্দির নিয়ে দৃষ্টিকটূ মাতামাতি করবে এটাই স্বাভাবিক৷ তারা কেন এটা করে, তাও আমাদেরই সবারই কমবেশি জানা৷ সুতরাং তাদের ধর্মীয় (নাকি অ-ধর্মীয়) কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের মনে তেমন কোনও সংশয়, কৌতূহল কিম্বা জিজ্ঞাসা জাগে না৷ জাগার কথাও নয়৷

আসলে জানা জিনিস নিয়ে কে-ই বা অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়? মানুষের যাবতীয় আগ্রহ-কৌতূহল তো অজানা জিনিস নিয়ে৷ ‘অজানাকে জানা’ বলে একটা কথা আছে না? সেই কথাকে গুরুত্ব দিয়েই এই গোলার্ধের সিংহভাগ মানুষের যুগ যুগ ধরে পথ চলা৷ এর ব্যতিক্রম খুব একটা দেখা যায় না৷ যদি-বা দেখা যায় তো তা নেহাৎই এক ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে বিবেচিত হতে বাধ্য৷
ভগবান রামলালাজিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘ঘর পাইয়ে দেওয়া’ নিয়ে বীরভূমের মাননীয়া সাংসদ তথা প্রাক্তন অভিনেত্রী শতাব্দী রায় একটি অর্থবহ মন্তব্য করেছিলেন যা নিয়ে প্রথমদিকে কিছুটা হৈ-চৈ হলেও আখেরে তা একেবারেই চুপসে যায়৷ কী বলেছিলেন তিনি? ভগবান রামলালা কী বিপিএল কার্ডধারী (গোত্রের) ছিলেন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘আবাস যোজনা’য় ঘর পেলেন?

অন্ধ বিজেপিপন্থীরা রামলালাজিকে কেন্দ্র করে বীরভূমের মাননীয়া সাংসদ তথা প্রাক্তন অভিনেত্রী শতাব্দী রায়ের এমন বিরূপ মন্তব্য নিয়ে শোরগোল পাকিয়েছিলেন৷ স্বয়ং রামলালাজিকে বিপিএল কার্ডধারী বলা? এমন দুঃসাহস দেখানোর ক্ষমতা তিনি পেলেন কীভাবে? মর্ত্যের সাংসদ বলে কি স্বর্গের দেবতাদের মাথা কিনে নিয়েছেন? রাজনীতি করেন বলে কি ‘সাপের পাঁচ-পা’ দেখেছেন?

বাল্মীকি-সৃষ্ট মহাকাব্যের ‘পৌরাণিক চরিত্র’ বলে কি তাঁর কোনও মানসম্মান নেই? মর্ত্যের অভাবী মানুষের মতো তাঁকে বিচার-বিবেচনা করা? তাঁর উদ্দেশ্যে এমন অবাঞ্ছিত মন্তব্য? উল্লেখ্য, ‘পৌরাণিক চরিত্র’ থেকে ‘ঐতিহাসিক চরিত্র’-এ টেনে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের কাছে জনৈক বিরোধী-সাংসদের রামলালাজির এই ইচ্ছেকৃত অপমান কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না৷

না, ‘ভুল স্বীকার’ করা কিংবা ‘ক্ষমা চাওয়া’ জাতীয় কিছুই করতে হয়নি বীরভূমের মাননীয়া সাংসদ শ্রীমতি শতাব্দী রায়কে৷ বিজেপি বিষয়টিকে নিয়ে বেশিদূর এগোয়নি৷ এখন প্রশ্ন হল, এগোয়নি– না, এগোতে পারেনি? কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার মধ্যেই ছিল বেশ কিছুটা ত্রুটি বা ফাঁক৷ সেই ত্রুটি বা ফাঁক ধরেই বীরভূমের মাননীয় সাংসদ ওই ‘আপত্তিকর’ উক্তি করেছিলেন৷
মাননীয়া সাংসদকে বেশি ঘাঁটালে খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েই যে টানাটানি হতে পারত এবং সেটা মোটেও সুখকর হত না দলের কাছে৷ বরং অস্বস্তি বাড়ত তাঁর৷ কেননা, রামলালাজির প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে তিনি যে মন্তব্যটি করেছিলেন, তা কিন্ত্ত বেশ আপত্তিকর৷ কেন আপত্তিকর? ওই মন্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ভগবান রামলালার চেয়েও বেশি শক্তিমান বলে তুলে ধরেছিলেন৷

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোরতর অস্বস্তি কিংবা বিড়ম্বনা বাড়ত ঠিক এখানেই৷ বিরোধীদের মধ্যে যাঁরা যুক্তিতর্কে কিছুটা আস্থা রাখেন, কিংবা অকারণে যুক্তিতর্কের মারপঁ্যাচে ফেলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাজেহাল করতে প্রস্ত্তত, তাঁরা বিষয়টি ছাড়বেনই-বা কেন? এই বেলাগাম প্রশ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনায়াসেই চেপে ধরতে পারতেন তাঁরা৷ সুযোগ তো করে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই৷

অন্যদিকে যাঁরা ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কিংবা রামলালাজিকে নিয়ে ভক্তিতে গদগদ, অহেতুক মাতন ও মাতামাতি করেন, তাঁরা নিজেরাই যদি নিজেদেরকে মন্দিরের বিগ্রহের চেয়েও উঁচু আসনে স্থান দেন তো সমালোচনার ঝড় বইতেই পারে৷ রামভক্তেরা তো বলতেই পারেন, মানুষের কী সাধ্য স্বয়ং দেবতাকে ঘরের ব্যবস্থা করার? যাঁর দয়ায় কিংবা কৃপায় গোটা ব্রহ্মান্ডটাই চলছে, তাঁকেই কিনা দয়া করা?

আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে বিচক্ষণতা আশা করি, তার নূ্যনতম পরিচয় দিতে পারেননি তিনি৷ আসলে ভোটের চিন্তা তিনি ও তাঁর দলকে দিশেহারা করে দিয়েছে৷ ২০২৪-এ তাঁর দলকে আরও বেশি আসনে জিতে আসতে হবে— এই চিন্তায় তিনি আছেন বিভোর৷ কোথায় কী বলবেন কিংবা বললেন, তা আর বোধহয় তাঁর স্মরণে থাকছে না৷ স্মরণে থাকলে ওই কথা বলতে পারতেন না৷

আসলে ক্ষমতার লড়াইয়ের সঙ্গে তাঁরা জুড়ে দিয়েছেন শ্রীরামচন্দ্রকে৷ যাঁকে জুড়ে দিয়েছেন, তিনি ঐতিহাসিক কোনও চরিত্র নয়, স্রেফ পৌরাণিক চরিত্র মাত্র৷ যে শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে তাদের এত মাতামাতি, লালকৃষ্ণ আদবানির রামরথযাত্রা, তাতে ভর করেই তাদের দিল্লি-দখল সম্ভব হয়েছে একথা ঠিক৷ তাই সেই দখলকে ক্ষমতায় ধরে রাখতেই রামমন্দির নির্মাণে তাদের এত আগ্রহ-উদ্দীপনা৷

আসলে ভক্তি তো নয়, ভোট৷ ভোটই তাদের একমাত্র লক্ষ্য৷ রাজনৈতিক ক্ষমতালাভই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ যে ক্ষমতা দিয়ে সে তাদের আশপাশের মানুষকে বশে রাখা যায়৷ কারণে-অকারণে তাদের ওপর ছড়ি ঘোরানো যায়৷ শাসনের নামে শোষণ করা যায়৷ এমনকী প্রয়োজনে ক্রীতদাসে পরিণত করা যায়৷ তাই সুপ্ত সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতাকে জাগিয়ে তোলার সাধ হয়৷ জাগিয়ে তোলেন৷

আসলে প্রভুত্ব করার নেশা সবচেয়ে বড় নেশা৷ মতবাদ নির্বিশেষে এই আদিম ও অদম্য নেশা সব রাজনীতিকদের মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে৷ সেই ঘুমন্ত ক্লোনকেই মাঝেমধ্যে জাগাতে চান তাঁরা৷ শুধু রাজনীতিকদের দোষ দিয়ে লাভ কী? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যেও কী নেই? আছে৷ প্রভূত পরিমাণেই আছে৷ পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ-সংসার— প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামন্ততন্ত্রের এই ক্লোন ঘুমিয়ে আছে৷

এর বাইরে অন্যকিছু নয়৷ তাই মাঝেমধ্যেই এঁরা ‘ভুলভ্রান্তি’ করে বসেন৷ ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত— যেভাবেই হোক না কেন৷ যা নয়, তাও বলে ফেলেন৷ সাধারণ মানুষ আর এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না৷ এদেশের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরনো’ মানুষের অন্যদিকে নজর দেওয়ার অবকাশ কোথায়? সেই সুযোগই নেন ঝান্ডার রং নির্বিশেষে এদেশের অবক্ষয়িত স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো৷