মধুছন্দা চক্রবর্তী
এবার পয়লা বৈশাখে দহনজ্বালা তেমন ছিল না৷ তাতে রবিবারের ছুটির দিনের আমেজ৷ ফলে বৈশাখী শুরুটা সুখকরই ছিল৷ কিন্ত্ত প্রকৃতি উত্তাপ কমালে কী হবে, সামনেই ভোট৷ ফলে রাজনৈতিক উত্তাপ ছিলই৷ ফলে এদিন নববর্ষের শোভাযাত্রায় পা মিলিয়েছিল রাজনীতি৷ পয়লা বৈশাখের প্রভাতফেরিতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের ব্যানার-ফেস্টুনের ছড়াছড়ি৷ তাকে রাজনৈতিক রং চড়ানোর যুক্তি দিতেই পারেন বিরোধীরা ৷ কিন্ত্ত তাতে কী, সেখানেও তো সেই বাংলা, সেই বাঙালির পয়লা বৈশাখ৷ সেই সুর- ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই’৷
তবে তার মধ্যেই নববর্ষের রীতিনীতি পালনে কোনও ত্রুটি ছিল না৷ সকাল থেকেই দক্ষিণেশ্বরে, কালীঘাটে মানুষের লম্বা লাইন৷ চুবড়িতে লাল শালুতে মোড়া খাতা, গণেশের মূর্তি, ফুল-বেলপাতা৷ এখন কম্পিউটারের যুগে হালখাতার আর তেমন গুরুত্ব নেই৷ ব্যবসার সব হিসেব নিকেশই হয় প্রযুক্তির মাধ্যমে৷ তা সত্ত্বেও কিছু কিছু কখনও পেছনে ফেলে দেয় প্রযুক্তিকে৷
এই যেমন বইপাড়ার পয়লা বৈশাখ৷ এদিন কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বইয়ের দোকানে দোকানে অতিথি আপ্যায়ণ৷ লেখাক ও পাঠকের মধ্যে মেলবন্ধন, যেখানে সাঁকোর কাজ করেন প্রকাশকরা৷ এদিন কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় বিভিন্ন পুস্তকবিপণীতে জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো৷ দে’জ প্রকাশকের পায়লা বৈশাখ পালন করা হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের বিদ্যাসাগর টাওয়ার-এ৷ সেখানে আবার লেখকদের মধ্যে নবীন -প্রবীণের সমাহার৷ অমর মিত্র থেকে শুরু করে স্মরণজিৎ কে ছিলেন না সেখানে৷ অসুস্থ শরীর নিয়েও এসেছিলেন নাট্যকার মনোজ মিত্র৷ সব মিলিয়ে এদিন কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ছিল ষোলোয়ানা বাঙালিয়ানা৷ শালপাতায় দেওয়া আলুকাবলি, সিঙাড়া, আম সন্দেশ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল অতিথিদের৷
শুধু বই-ই নয়য়, পয়লা বৈখাখে, আইসিসিআর- এ ‘ফাউন্টেন পেন’ -এর উৎসব হয়েছিল কালকাতার আইসিসিআর-এ৷ সেখানে ভিড় জমিয়েছিলেন নবীন এবং প্রবীণরা৷ আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিতে বল পেনের জনপ্রিয়তা বাড়লেও ফাউন্টেন পেনের কদর কমেনি৷ এখনও যে ফাউন্ডেন পেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে, তা বোঝা গেল পয়লা বৈশাখে৷ একটি সংস্থার আয়োজনে ‘পেন মহোৎসব’ এবার তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে৷
যাঁদের একটু বয়স বেশি, ঘর থেকে বাইরে বেরনোর সুযোগটা কম, তাঁরা এদিন নতুন বছরে নস্ট্যালজিয়ায় ভেসেছেন টেলিভিশনের মাধ্যমে৷ আর এই প্রজন্ম থেকে কাজে-কম্মে মজে থাকা বাঙালির পয়লা বৈশাখ কেটেছে ধুতি-পাঞ্জাবি, কিংবা বাঙালি সাজের সঙ্গে শাড়ি পরে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে৷ এদিন শহরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁতে ছিল বাঙালি ভোজের মেনু৷ মানে একেবারে অশন-বসনে বাঙালিয়ানা উদযাপন করেছে বাঙালি৷ একসময় বাংলা নববর্ষের দিন বসত জলসা৷ রামকুমারের টপ্পা,স্বর্ণ যুগের গান, বাংলা কবিতা, আবৃত্তি, নাটক শোনা যেত বেলফুলের সুবাসে আমোদিত প্রেক্ষাগৃহে৷ সেই আসরের সংখ্যা এখন হাতে গোণা৷
তবে সেই অভাবপূরণ করল নববর্ষের আনন্দ সন্ধ্যায় কলকাতার রবীন্দ্রসদনে রাজ্য সরকারের তরফে বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস তথা ‘বাংলা দিবস’ উদযাপনের অনুষ্ঠান৷ এবছরই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য দিবস পালিত হচ্ছে৷ রাজ্য সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান৷ নির্বাচনী আচরণ বিধি মেনে এদিনের অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছিল জাতীয় নির্বাচন কমিশন৷ নিয়মবিধি মেনেই মুখ্যমন্ত্রীসহ রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিয়েই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়য় উপস্থিত ছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, সুরজিত চট্টোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ, সুবোধ সরকার, শিবাজি চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, রূপঙ্কর বাগচী, শ্রীজাত, জয়তী চক্রবর্তী প্রমুখ৷ এছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি, কলকাতার পুলিশ কমিশনারসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন৷ মুখ্যসচিব বি পি গোপালিকা অনুষ্ঠানে এই অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন৷
রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের আয়োজনে বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কলকাতার সাংস্কৃতিক পীঠস্থান – নন্দন চত্বর সাজানো হয়েছিল৷ গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিধানসভায় বাংলা দিবস পালনের প্রস্তাব পাশ করা হয়৷ মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷ সেই কমিটিই প্রস্তাব দেয়, পয়লা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা হোক৷ সেইমতো বাংলার সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নাচে গানে জমজমাট বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস৷ রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গের বদলে বাংলা করার বিষয়টি এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়নি৷
কিন্ত্ত এদিন বাংলা দিবস উদযাপন আমাদের রাজ্যকে নতুন করে চিনিয়ে দিল৷ মনে করিয়ে দিল আমি বাংলার গান গাই৷ এভাবেও পয়লা বৈশাখে বাঙালিয়ানার মোড়কে নিঃশব্দে রাজনীতি ঢুকে পড়ল বাঙালির অন্দরমহলে৷