জয়দেব দত্ত
হাঁড়া তালগাছটার মাথার উপর চাঁদ উঠেছে৷ তাও যে সে চাঁদ নয়,ঝড়ি পিসির হাতে তেল-শালপাতা দিয়ে মাজা, কাঁসার থালার মত ঝকঝকে চাঁদ৷ হায় চাঁদ, হায় গোল চাঁদ!
চাঁদের আলো তালপাতায় ধাক্কা খেয়ে, ঠিকরে এসে পড়ছে খড়ের চালে৷ চাল থেকে চুঁয়ে চুঁয়ে নামছে, গোবর দিয়ে নিকানো উঠানে৷ উঠানটা চাঁদের আলোয় ফিন ফুটছে৷ ফিন৷
ভিজে আর্দ্র মাটি পেয়ে, পিঁপড়েগুলো গর্ত থাকে তেড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে, চাঁদের আলো মাখছে৷ আলো৷ আর তার ফাঁকে, গোবরে ম্যাড়ম্যাড়ি ভিজে ধান, মুখে করে বয়ে, গর্তে ঢুকচ্ছে৷
নোংরা আবর্জনার স্তুপ থেকে, ছুঁচোর বাচ্ছাগুলো বেরিয়ে, পরপর লাইন দিয়ে, এর তার লেজ কামড়ে, চক্রাকারে ঘুরছে৷ আমাদের উঠানে ট্রেন চলছে৷ ট্রেন৷ ছোট ট্রেন৷
মানুষের গন্ধ পেয়ে, ছুঁচোর বাচ্ছাগুলো লেজ ছেড়ে, ছুটে পালাচ্ছে৷ ট্রেন ভেঙে যাচ্ছে৷ ভেঙে যাচ্ছে৷
বাগদিপাড়ার মনসাথানে নতুন টিনের চাল উঠেছে৷ চাঁদের আলো পেয়ে, টিনগুলো জ্বলজ্বল জ্বলছে৷ জ্বলজ্বল৷
পুকুরের জলে ঢেউ উঠছে৷ ঢেউয়ের ভেতর চাঁদ নিঃসাড়ে ঢুকে যাচ্ছে৷ লক্ষ লক্ষ চাঁদ, পুকুরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত খেলা করছে৷ খেলা৷
আমি উঠানের এক কোণে বসে আছি৷ খালি গায়ে, খালি পায়ে৷ কেবল, ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে, ঠ্যাঙ নাচাচ্ছি৷ আর, বেপরোয়া প্রেমিক চাঁদের প্রেমরসে মজে, প্রেমসুধা পান করছি৷
এমন সময়, এমন ভালো লাগা মুহূর্তে, একটা ছায়ামূর্তি কেবলই আমার দিকে সরে সরে আসছে৷ সরে সরে৷ ভয়ে আমার গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল৷ কোনও মহিলা নয় তো? মহিলা হলে, গোলমাল৷ গো-ল-মা-ল! ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার পর, সকাল হতে না হতেই, সারা গাঁয়ে ঢি-ঢি পড়ে যাবে৷ জীবনভর আমাকে এ কলঙ্কের বোঝা বইতে হবে৷
এসব ছাইপাঁশ কত কী ভাবছি৷ হঠাৎ, মূর্তিটা, নারী মূর্তিটা চুপিসারে এসে, আমার গায়ে গা দিয়ে দাঁড়াল৷ বাপ রে— এ কী গরম ভাপ! ভাপে, সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি৷ সেদ্ধ হতে হতে, চোখ তুলে তাকিয়েছি মাত্র৷ অবাক, আমার মুখ থেকে বাক বার হচ্ছে নাই৷ চিৎকার করে কাউকে যে ডাকব, তাও পারছি নাই৷
এমতো অবস্থায়, এমন বিপদের সময়, নারীমূর্তিটা ‘ফ্যাঁস’ করে কেঁদে দিল৷ কান্না শুনে, ঘাড় ঘুরে তাকিয়েছি— ও বাবা, মহিলাটা তো চেনা, জানাশুনা৷ আমাদের পাশের বাড়ির পুল্লেবৌদি৷ তার মানে, পুরুলিয়ায় যে বৌটার বাপের বাড়ি৷ আমাদের পুরোহিত ঘাবা-দা যাকে অগ্নিসাক্ষী করে, ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে, বিয়ে করে নিয়ে এসেছে৷ ঘাবা-দা পুজো করে ফিরে এসে, গামছার মোটটা বওয়ার জন্য, দরজার বাইরে থেকে যাকে আদর সোহাগ করে ‘পুল্লে’ ‘পুল্লে’ বলে ডাকে৷ যে আমাকে পাল-পরবে নিমন্ত্রণ করে এটা সেটা খাওয়ায়৷ কখনও সখনও, লুকিয়ে লুকিয়ে আম-বাঁটা কুল-বাঁটা ইত্যাদি প্রভৃতি নানারকম ফলমূল আমার হাতে দিয়ে, মুচকি হেসে কেটে পড়ে৷ আমি আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৌতাত করে খাই৷ খাওয়া হয়ে গেলে, গামছায় মুখ মুছে, তালুতে জিভ ঠেকিয়ে, ‘টক’ ‘টক’ শব্দ তুলি৷ সেই পুল্লেবৌদি আমার কাছে, আমার গায়ে গা দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে৷
আমি খুব ইতস্তত করছি৷ কী বলব, কী বলব নাই ভাবছি৷ ভেবে কূল পাচ্ছি নাই৷ শেষে, বৌদিই ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে, খুব নিচু স্বরে, আমার কানে মুখ গুঁজে বলল— তোমার দাদা পুজো করে এসে, সেই যে কষা-কষি হাতে নিয়ে বেরিয়েছে, এখনও ঘরে ফিরে নাই৷
বৌদি কাঁপতে কাঁপতে, কাঁদতে কাঁদতে, চলে গেল৷ যাবার সময়, পায়ে কোনও শব্দ করল নাই পর্যন্ত৷ নিঃশব্দে যাওয়া৷ কেউ জানতেই পারল নাই৷ একমাত্র, যার জানার, যাকে উদ্দেশ্য করে আসা, সে-ই কেবল জানল৷ তবে, শুধু নিঃশব্দে চলেই গেল নাই৷ যাবার সময়, নাকের জল চোখের জল এক করে, ‘ধাবড়িস’ করে, এক ধ্যাবড়া সিগনি ফেলে দিল আমার পিঠে৷ সেই সিগনি শুকিয়ে, এখনও সাদা সর পড়ে আছে আমার পিঠে৷
তা থাকুক৷ কিন্ত্ত ঘাবা-দা এখনও ঘরে ফিরল নাই কেন৷ ঘাবা-দা কি মরে গেছে? দূর, মরবে কী করে? মরতে হলেও তো মরতে জানা চাই৷
ঘাবা-দা যে তাও জানে না৷ ভালো করে চলতেই জানে না, আর মরণ৷ চলতে গেলেই, পা থ্যার ব্যার থ্যার ব্যার৷ কখনও কখনও এর তার গায়ে উল্টে পড়েও যায়৷ তখন গাঁ শুদ্ধ লোকের মুখে মুখে হাসির ফোয়ারা চলে৷ হাসির ফোয়ারা৷
শুধু কি পাগুলোই থ্যার ব্যার৷ আর আস্ত মাথাটাকে ধরে আছে যে লম্বা ঘাড়টা? সেই লম্বা ঘাড়টা অদ্ভুত রকমের বাঁকা৷ তাই, গাঁয়ের মেয়েগুলো, বাকুলের বৌগুলো, পাড়ার মা কাকিমারা ‘ঘাবা’ বলে ডাকে৷ ঘাড়ের ‘ঘা’ আর বাঁকার ‘বা’ নিয়ে, ‘ঘাবা’৷ বেশ বেশ, চেহারার সঙ্গে নামটা ‘খলতায়’ দিয়েছে ভালো৷ যেমন বামুন, তেমনই তার পৈতা৷
পৈতা যেমনই হোক, মানুষটাই তো আসল নাকি৷ এতরাত হল, মানুষটা ফিরল কৈ? বাধ্য হয়ে, ইচ্ছা না থাকলেও, আমাকে আসন ছেড়ে উঠতেই হল৷ পুল্লেবৌদি এসে, আমার সবকিছু নষ্ট করে দিল৷ এমন সুন্দর চাঁদ আর তার আলোর ভেল্কি, এক নিমেষে আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেল৷ সম্পূর্ণ উধাও৷
আমাদের পেছপাঁদাড়ে খেজুর গাছ৷ খেজুরগাছ পার হলে রাস্তা৷ লাল মোরাম রাঙানো রাস্তা৷ রাস্তায় পা দিবার আগেই, খেজুরগাছ থেকে খেজুরের শুকনো ডালপালা পড়ল মাটিতে৷ যা বাব্বা, কাঁটাডালটা পড়ল-পড়ল, আমার মাথায় পড়ে নাই৷ পড়লে মাথায় কাঁটা ফুটে যেত৷ যখন পড়ে নাই, তখন ওসব ভেবে লাভ নাই৷ আমাকে ভাবতে হবে— ঘাবাদা কোথায়৷ এখনো এত রাতে কোথায় কী করছে৷ যদি মরেও যায়, তো আমাকে ওর মরা পচা বডিটাও খুঁজে বার করতেই হবে৷ কেননা, ঘাবা-দা আমাদের পুরোহিত৷ আমাদের গোটা গাঁয়ের পুরোহিত৷ আমরা সবাই ওর যজমান৷ ও না থাকলে, আমাদের ঠাকুর দেবতাগুলোকে পুজো করবে কে৷ কে রোজ রোজ ঠাকুরের পায়ে ফুল চাপাবে৷ তাই আমাকে যে করেই হোক, ঘাবা-দাকে খুঁজে বার করতেই হবে৷ নিদেনপক্ষে, ওর মরা পচা বডিটাও৷
রাস্তায় লাল ধুলো উড়ছে৷ পায়ে লেগে যাচ্ছে ধুলো৷ পায়ে লাল ধুলো আর পিঠে সিগনির চ্যাটচ্যাটে আঠা নিয়ে, খুব দ্রুত হাঁটছি৷ আমার পদভারে, রাস্তায় সাপ ব্যাঙ ইঁদুর ছুঁচো যে যেখানে ছিল, সব লাফিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে৷ পালিয়ে বাঁচছে৷
আমাদের গ্রাম ষোলনার কালীতলায় যেতে না যেতেই, আমাকে কে যেন পেছন দিকে টেনে ধরেছে৷ আমি আর টান ছাড়িয়ে সামনে যেতে পারছি নাই৷ কী ব্যাপার কী৷ চারিদিকে তো কেউ কোথাও নাই৷ তাহলে, কে আমাকে টেনে ধরল? ঘাবা-দা কি? ঘাবা-দা মরে পচে ভূত হয়ে গেছে কি? ভূত হয়ে হয়তো আমাকে টেনে ধরেছে৷ তাও হতে পারে৷ ভয়ে-ময়ে আমার শরীরে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে৷ ঘামে চান করছি৷
সামনে তাকাতেই আরও বিপদ বাড়ল৷ বিরাট একটা কাটা হাত! কাটা হাতটা আমার চোখের সামনে ঝুলছে৷ আমি নির্ঘাত ভূতের পাল্লায় পড়েছি৷ আমাকে ভূতে ধরেছে৷ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি নাই৷ উল্টে পড়ে যাচ্ছি৷ অর্ধেকটা হেলেও গেছি৷ এমন সময়, এমন বিপদে, কে একজন আমাকে জাপ্টে ধরল৷ চিৎকার করে বলল— তোর সাহস নাই, এতরাতে একা কেন?
আমি ‘বু’ ‘বু’ করতে করতে বললাম— ভূত!
কতক্ষণ পরে কোনোরকম চোখ মেলতেই দেখি কিনা, ভূত কোথায়, আমাদের ভূতো৷ যে আমাদের বাগানে প্রায়শই, আম চুরি করে, হাটে হাটে বিক্রি করে, সেই ভূতো৷
ভূতো বলল— তোর এত ভয় কী রে৷ দেখছিস নাই, আমি পার্টি অফিসে লম্ফ জ্বালিয়ে, ঝাঁটা বাঁধছি৷ ঝাঁটার ছায়াটা আমাদের পার্টি অফিসের জানালা টপকে, তোর মুখে এসে পড়ছে৷ তাতেই এত ভয়! ভূতের কাটা হাত দেখলি!
আমি ওর কথা বিশ্বাস করলাম নাই৷ বললাম—তাহলে কে আমাকে টেনে ধরেছে?
ভূতো হাসতে হাসতে আমার পেছনে গেল৷ পরখ করে বলল— তুই কানা৷ বুঝলি, তুই কানা৷ এত আলো থাকতে, রাস্তার শিয়াকুল গাছটাকে দেখতে পেলি নাই৷ শিয়াকুল কাঁটাতে তোর লুঙ্গিটা ছিঁড়ে গেছে যে রে৷ গর্ধব কোথাকার!
আমি ভূতোর থ্যাবড়া মুখটার দিকে অপলক চেয়ে থাকলাম৷ ভূত নাহয় না দেখলাম৷ কিন্ত্ত রাতবাঘা ভুতোকে তো দেখলাম৷ খুব কাকুতি-মিনতি করে বললাম— চ ভাই, আমার সঙ্গে চ৷ ঘাবা-দা এখনও ঘরে ফিরে নাই…৷
ভূতো কী শুনল কে জানে৷ বড় বড় ছেয়া ফেলে চৌমাথা পেরিয়ে, বোদাই নদীর রাস্তা ধরল৷ আমিও ওর পেছন পেছন৷ একদম, ছিয়াতে ছিয়া মিলিয়ে মিলিয়ে হাঁটছি৷ বাঁ পায়ের পর ডান পা৷ ডান পায়ের পর বাঁ পা৷ বাঁ পা, ডান পা করে করে হাঁটছি৷ হাঁটতে, বেশ মজা লাগছে৷ ভূতোর পেছন পেছন, অবিকল ভূতোর মত হাঁটা৷
চাঁদটাকে সেই কখন আমাদের উঠানে ফেলে এসেছি৷ কিন্ত্ত চাঁদটা আমাকে ভুলে নাই৷ আমার মাথার উপর, আমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে৷
রাস্তায় নতুন পিচ পড়েছে৷ ট্রাক্টরের চাকার ঘুর্ণিতে পিচ উঠে গেছে৷ পাথর হাঁ হয়ে বেরিয়ে গেছে৷ পাথরে একবার কারু পা পড়েছে, তো সঙ্গে সঙ্গে পা দু’ফালা৷ আমরা কেউই পাথরে পা দিচ্ছি নাই৷ পাথর টপকে টপকে পেরিয়ে যাচ্ছি৷
সামনে বোদাই নদী৷ বোদাই ছোট নদী৷ নদী এখন মরে গেছে৷ নদীতে মরা বালিগুলো পড়ে আছে৷ চাঁদের আলোয় বালিগুলো চিকচিক করছে৷
বোদাই নদী পার হলে, ডান পাশে মেঠো রাস্তা৷ মেঠো, পলি রাস্তা৷ পলি শুকিয়ে ধুলো হয়ে আছে৷ পায়ের চাপে ধুলো আরও ক্ষুদ্র হয়ে উপরে উড়ছে৷ উড়ে, আমাদেরকে ঢেকে দিচ্ছে৷ আমরা ধুলোতে ঢাকা পড়ে যাছি৷
মেঠো রাস্তার ডান পাশে, রায়দের বাঁশবন৷ বাতাসে, বাঁশবনে বাঁশ দুলছে৷ বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণে কেমন একধরনের ‘ক্যা কুচ কুচ’ শব্দ হচ্ছে৷
বাঁশবনের পর সিএডিসি স্যালোঘর৷ স্যালোতে ভদভদ জল বেরচ্ছে৷ পাতাল জলে কেমন এক ধরনের গন্ধ বেরিয়ে আসছে৷
স্যালোঘরের পর আদিগন্ত কৃষিক্ষেত্র৷ কৃষিমাঠে, ফুলভারে গাছগুলো সব নুয়ে আছে৷ নুয়ে৷
কৃষিমাঠের মাঝে, ঘোষদের কাঁঠাল বাগান৷ কত বড় বাগান! কী তার সারি সারি গাছ! হয়তো, হাজার বছর বেঁচে আছে বাগানটা৷ হাজার হাজার বছর৷
গাছের পাতায় পাতায় শিশির জমেছে বিস্তার৷ শিশির জমে নীচে দিকে ঝরে পড়ছে৷ না পড়ে, পাতার মুখে আটকে আছে৷ আটকে ঝুলে আছে৷ তাতে চাঁদের আলো এসে হুসমুস ঢুকে যাচ্ছে৷ ঢুকে, শিশির বিন্দু চিকচিক করছে৷ চিকচিক৷ যেন হাজার, কোটি কিশোরী, নাকে নোলক পরে, গাছের পাতায় পাতায় দুলছে৷ হা হা, কিশোরী!
কাঁঠাল গাছে, কাঁঠালের ‘মচা’ ধরেছে৷ ‘মচাতে’ পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ মচার গন্ধে পিঁপড়েগুলো মাতাল৷ মা-তা-ল!
ফোনে-গোয়ালার বাতাবি গাছে ফুল ধরেছে৷ ফুলে, মৌমাছি আটকে আছে৷
শিবা-গোয়ালার কুল গাছে, কুল পেকেছে৷ রাতচরা পাখিগুলো গাছের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ঘুরে, পাখা মেলে, চাঁদের আলো মাখছে৷ হায়, চাঁদ! হায়, ফাল্গুনী রাতের চাঁদ!
আমি কাঁঠাল গাছের ছায়াতে এসে আটকে গেছি৷ না, আটকে যায় নাই, মরে গেছি৷ শিশির সিক্ত চাঁদ আমাকে মেরে দিয়েছে৷ আমি খুন হয়ে গেছি৷ খুন৷
দূরে, আচ ফুলের গন্ধ, শিবা-গোয়ালার কুল গাছে, পাকা কুলের গন্ধ, বাতাবি ফুলের গন্ধ, ইঁচড়ের গন্ধ, মাঠে মাঠে সরষে ফুল, মুলো ফুল, মটর ফুলের গন্ধ সব মিলেমিশে এক স্বর্গীয় উদ্যান! উদ্যান!
আমি এভাবে কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম জানি না৷ ভূতোর থ্যাবড়া নাকের গোল গোল ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা, কেলে সাপের গর্জানি শুনে আমার জ্ঞান ফিরল৷
ভূতো বলল— ইস, কী ভুল করে, ঘর থেকে দা-টা আনলাম নাই রে৷ আনলে, বাগানের ইঁচড়গুলো কেটে কুচিকুচি ফেলে রাখতাম৷
আমার কোপালে ভাঁজ পড়ল৷ বললাম— এখানেও দস্যিপনা!
কোথায় কোন ঝোড়ে, না পাতলে লুকিয়ে ছিল, আমাদের গ্রামের বদ, বদের গোঁড়া আশপাকুলে৷ আমাদের কথাবার্তা শুনে, জোড় থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো৷ এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল— আজ যদি সেই ক্ষেপিটাকে পেতাম…৷
আমি জোরে ধমকে উঠলাম— চুপ৷
আশপাকুলে ধমক খেয়ে দমবার পাত্র নয়৷ ঝগড়ার রেশ তুলে বলল— মিছিমিছি আমাকে একা দোষ দাও কেন দাদা৷ দোষ যদি দিতেই হয়, ওই দুইজনকে দাও৷ ওই যে তোমার ফাল্গুনী রাত, আর মায়াবী চাঁদ৷ ওই দু’জনেই তো, মিলেমিশে আমাদের সক্কলের ঢাকনা খুলে দিয়েছে৷ তুমি সত্যি করে বলত, পকেটে যদি খাতা আর কলম থাকত, তাহলে আজ রাতে একটা মহাকাব্য লিখে ফেলতে নাই কি৷
আমি বেয়াদবটাকে কী শাস্তি দিব ভাবছি৷
হঠাৎ, বেয়াদবটা আমার হাতটা টিপে ধরল৷ ধরে, হড়হড় করে টেনে নিয়ে গেল৷ টানতে টানতে বলল— মূর্খের কথা শুনলে তোমার রাগ হয়, তাই তো৷ নাও, তবে নিজে চোখে দেখ৷ বলেই, আমাকে সামনে দিকে ঠেলে দিল৷
আমি ঠেলা সামলাতে না পেরে, মুখ গুঁজে পড়ে যাচ্ছিলাম৷ দেরুপুরের কোণে, মোটা কাঁঠাল গাছটাকে ধরে, কোনোরকম বাঁচলাম৷ বেঁচেও কি আর শান্তি আছে৷ গাছটার নীচে চোখ যেতেই, দেখি কিনা— যার খোঁজে বাগান আসা, যে মানুষটার জন্য পুল্লেবৌদি কেঁদে কেঁদে মরতে বসেছে, যে আমাদের পুরোহিত, আমরা গোটা গ্রাম যার যজমান, যার জন্য এখনও আমার পায়ে লাল ধুলো আর পিঠে সিগনির চ্যাটচ্যাটে আঠা লেগে আছে, সেই ঘাড় বাঁকা ঘাবা-দা, গাছের নিচে বসে, কষা-কষি নিয়ে পুজো করছে৷ পুজো৷