নিজস্ব প্রতিনিধি— বাংলায় প্রথম দফার নির্বাচন উত্তরবঙ্গেই৷ তাই উত্তরের মাটিতে জোড়াফুলের ভিত শক্ত করতে সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছে তৃণমূল৷ শনিবার নিজের জোড়া কর্মসূচি সম্পন্ন করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়৷ একদিকে যেমন ছিল রাজবংশী সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক, অন্যদিকে ছিল অভিষেকের রোড শো৷ পরিকল্পনামাফিক দুই গুরুদায়িত্বই সামলেছেন তৃণমূল সেনাপতি৷
কোচবিহার তথা গোটা উত্তরবঙ্গের ভোট ব্যাঙ্কে রাজবংশী সমাজ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর৷ তাই এবার রাজবংশী সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন অভিষেক৷ এদিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার সভাপতি তথা গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) প্রধান অনীত থাপা৷ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও জনসভা করে গেছেন উত্তরবঙ্গে৷ তিনিও টার্গেট করেছিলেন এই রাজবংশী ভোট ব্যাঙ্ক৷ বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত রায় সম্প্রতি বলেছিলেন, রাজবংশীদের জন্য কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়নি৷ তৃণমূল এবার এই মন্তব্যকেই ভুল প্রমাণ করতে নেমেছে ময়দানে৷ রাজবংশীদের জন্য করা একাধিক উন্নয়নমূলক কাজের খতিয়ান তুলে ধরে পাহাড়ে চলবে প্রচার৷ এদিনের বৈঠকে অনীত থাপার উপস্থিতি প্রমাণ করে, প্রস্তুতির শেষলগ্নে এসে রাজবংশী ভোট ব্যাঙ্কে বাজিমাত করতে চলেছে তৃণমূল৷
এবারের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে পারে তৃণমূল, আশাবাদী জোড়াফুল শিবির৷ বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, পাহাড়ে সমস্যা, বিএসএফের প্রায়ই হিংসাত্মক আচরণ, নিশীথ প্রামানিককে নিয়ে তৈরী হওয়া জল্পনা ইত্যাদি উত্তরবঙ্গের মাটিতে ঘাসফুল ফোটার কারণ হতে পারে৷ আর এই সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে রাজবংশী ভোট৷
বৈঠক শেষে অভিষেক কোচবিহারের সিতাই -এ শুরু করেন তাঁর শনিবারের দ্বিতীয় কর্মসূচি, রোড শো৷ কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী জগদীশ চন্দ্র বর্মা বসুনীয়ার সমর্থনে প্রচারে নামেন অভিষেক৷ শেওড়াতলা থেকে সিতাই বাজার পর্যন্ত ছিল অভিষেকের রোড শো৷ এদিন ব্যাপক জনস্রোতে ঢেকে যায় রাস্তা৷ অভিষেকের ভাষায়, এটি নির্বাচনী প্রচার ছিল না, ছিল ‘বিজয় মিছিল’৷ এই বিপুল জনসমাগমকে নিরাশ করেননি যুবরাজ৷ নিজ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনিও হাত নাড়িয়ে, নতমস্তকে প্রণাম জানিয়ে প্রতিবার্তা দিয়েছেন সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে৷ কখনও দলীয় পতাকা হাওয়ায় ভাসিয়েছেন আবার কখনও বা সাধারণ মানুষের দিকে ফুল ছুঁড়ে দিয়েছেন৷ অভিষেক রোড শো থেকেই সম্পূর্ণ আশাবাদী হয়ে বলেন, আগামী ৪ঠা জুন উত্তরবঙ্গের মাটিতে সবুজ আবির উড়বে৷ তার প্রমান হলো এই জনসমাগম৷ তিনি কথা দিয়ে বলেন, “বিজয় মিছিল করতে আগামী জুন মাসে আসবো৷ ”
কোচবিহারের মাটি থেকেই ফের আক্রমণ শানিয়েছেন কেন্দ্রকে৷ তিনি বলেন, “পাঁচ বছর তো দেখলেন বিজেপি তথা ডবল ইঞ্জিন সরকারের নমুনা৷ তৃণমূল প্রার্থী জগদীশ চন্দ্র বসুনিয়া কে ভোট নেওয়া মানে সরাসরি এই প্রতারকদের গালে দুটো চড় মারা৷ বিজেপি যদি আবার আপনাদের ভুল বুঝিয়ে জেতে তাহলে আবার মানুষের অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করবে৷ কিভাবে বাংলার টাকা তুলে নিয়ে গিয়ে ইউপি, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশের হাতে তুলে দেওয়া যায়, নিশীথ প্রামানিক এবং তাঁর দল সেই পরিকল্পনাই করবে৷ ”
প্রধানমন্ত্রী বারংবার নিজ জনসভায় বলেছেন, বিজেপি ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ এবার এই প্রসঙ্গেই গেরুয়া শিবিরকে কটাক্ষ করে অভিষেক বলেন, কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামানিক যাঁর বিরুদ্ধে ৬ মাস আগে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল৷ তাঁকেই পুনরায় প্রার্থী করেছে বিজেপি৷ তাই বিজেপির মুখে ভ্রষ্টাচারের কথা মানায় না৷ শীতলকুচির ঘটনার স্মৃতিচারণা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের দিকে, জানতে চেয়েছেন বিগত পাঁচ বছরে মানুষ কি পেয়েছেন বিজেপির সাংসদের কাছ থেকে? এ প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, দিনহাটা, সিতাই, শীতলকুচিতে খালি বিএসএফ এর চোখ রাঙানি আর একের পর এক গুলি ছাড়া মানুষ কিছু পাননি৷ প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো আচ্ছে দিন এসেছে৷ কিন্ত্ত সেই আচ্ছে দিন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, নিশীথ প্রামানিকের৷ সাধারণ মানুষের থেকে টাকা নিয়ে সেই টাকায় সাংসদদের বাড়ি অট্টালিকায় পরিণত করেছে৷ সরাসরি নিশীথ প্রামানিককে আক্রমণ করে অভিষেক বলেন, “নিশীথ প্রামানিক যদি জেতেন তাহলে তাঁর প্রথম কাজ হবে, কোচবিহারে মাছ খাওয়া বন্ধ করবেন কারণ তাঁর নেতা (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন মাছ খাওয়া হিন্দুত্বের বিরোধী৷ অমিত শাহ সভা করতে এসে ‘বালুরঘাট’ কে ‘বেলুরঘাট’ বলেছেন৷ পঞ্চানন ‘বর্মা’ কে বলেছেন পঞ্চানন ‘বর্মন’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান জানেন না, বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি এঁদের নেতৃত্বেই ভাঙা হয়েছিল তাই এঁদেরকে বাংলা বিরোধী বলা হয়৷ ”
পাশাপাশি অভিষেক পেশ করেন তাঁর রিপোর্ট কার্ড৷ অসংখ্য প্রকল্পগুলির খতিয়ান তুলে ধরেন৷ আবাসের টাকা রাজ্য সরকারই মিটিয়ে দেবে চলতি বছরে, সে কথাও পুনরায় মনে করিয়ে দেন৷ পাশাপাশি তিনি বলেন, রবিবার নববর্ষ, শুক্রবার নীলষষ্ঠী ছিল, তার আগে ছিল ঈদ৷ নিকটবর্তী বাজার গুলিতে পা ফেলার জায়গা ছিল না তার কারণ লক্ষীর ভান্ডারের বরাদ্দ বৃদ্ধি৷ ধর্মের নামে নয়, কর্মের নামে ভোট দেবার বার্তা দেন সাধারণ মানুষকে৷ এ প্রসঙ্গে অভিষেক মানুষকে ভরসা দিয়ে বলেন, “আগামী ১৯শে এপ্রিল এমনভাবে জোড়াফুলের বোতাম টিপবেন যাতে ইলেকট্রিক কারেন্টের মতো দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং অমিত শাহের চেয়ারে লাগে৷ আর নিশীথ প্রামানিকের কোটি কোটি টাকা খরচা করা দিল্লির মার্বেল প্যালেস থেকে যেন এক একটা মার্বেল এক একটা ভোটে খসে খসে পড়ে৷ এবারের ভোট, ভোট টু ইলেক্ট নয়, ভোট টু প্রোটেস্ট অথবা ভোট টু রিজেক্ট৷ কোচবিহারের উন্নয়ন আমার থেকে বুঝে নিন, আমি দায়িত্ব নিয়ে যাচ্ছি৷ “