বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি ধরে রাখতে সচেষ্ট বিশ্বভারতী
খায়রুল আনাম: প্রকৃতিপ্রেমী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে তাঁর স্বপ্নের বিশ্বভারতীকে শুধুমাত্র যে ‘ছাঁচে ঢালা’ পুঁথিগত শিক্ষার মধ্যে বেঁধে রেখে ‘তোতা পাখি’ বানাবার এক ‘খোঁয়াড়’ করতে চাননি, তা তাঁর মুক্ত অঙ্গনের শিক্ষা ভাবনার মধ্যে দিয়েই প্রতিভাত হয়েছে৷ শান্তিনিকেতনকে প্রতিটি ঋতুতে যে নব নব রূপে পাওয়া যায় তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনব্যাপী কর্ম, শিক্ষা ভাবনা ও জীবন দর্শনের মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে দিয়ে গিয়েছেন৷ তার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে শান্তিনিকেতনে বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবসটি বৃক্ষরোপণ ও তার পরের দিনটি শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে চলেছে৷ বিভিন্ন ঋতুতে শান্তিনিকেতনে যে সব উৎসব-অনুষ্ঠানগুলি হয়ে থাকে তার অন্যতম হলো দোলের দিনের বসন্ত উৎসব৷ দেখা যাচ্ছে, শান্তিনিকেতনে শেষবার বসন্ত উৎসব হয়েছিলো ২০১৯ সালে৷ তারপর ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার মতো অতিমারি পরিস্থিতির জন্য বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বসন্ত উৎসব করেনি৷ ২০২৩ সালে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তাদের অভ্যন্তরীণ কারণে বসন্ত উৎসব করেনি৷ তবে, বিশ্বভারতীর প্রথানুযায়ী বসন্ত বন্দনার আয়োজন করা হয়েছিলো৷ এবার বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বসন্ত উৎসব পালন করবে কী না, তা নিয়ে কৌতূহল ছিলো সবার মধ্যে৷ কিন্ত্ত এবার দোলের দিন বসন্ত উৎসব পালন করেনি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ৷ এনিয়ে নানা মহলে চর্চ্চা ও নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছিল৷ কিন্ত্ত জানা যায় যে, ইতিমধ্যেই ইউনেস্কো বিশ্বভারতীকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই বিশ্বভারতীর কাছে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে৷ কিন্ত্ত দোলের দিন বসন্ত উৎসব হলে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে যে লাগাম ছাড়া ভীড় হচ্ছিল তাতে বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ও গরিমা ধরে রাখাটাই দুষ্কর হয়ে উঠছিলো৷ তাই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে, বসন্ত উৎসবের পরিবর্তে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় হবে বসন্ত বন্দনা৷
সেই ধারাতে এবং বিশ্বভারতীর গরিমা ও ঐতিহ্য বজায় রেখে চৈত্রের শেষে এবং নববর্ষ বরণের আগে বুধবার ২৭ চৈত্র, ১০ এপ্রিল শান্তিনিকেতনে চিরাচরিত প্রথায় পালিত হলো বসন্ত উৎসব৷ যাতে আপ্লুত বিশ্বভারতীর পড়ুয়া, কর্মী, প্রাক্তনী থেকে শুরু করে আশ্রমিকদের সকলেই৷ একদিন খেলাচ্ছলে রবীন্দ্রনাথের পুত্র শমীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সালে শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন বসন্ত উৎসবের৷
শমীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণের পরে পরবর্তীতে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ পূর্ণতা দিয়েছিলেন বসন্ত উৎসবকে৷ দোলের দিনের বসন্ত উৎসবে মাত্রা ছাড়া হুজুগ আর উচ্ছৃঙ্খলতায় সমগ্র বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতনে যে তাণ্ডব চলছিলো, তা থেকে এখানকার পরিবেশকে রক্ষা করতে পারার মতো জরুরি ও অতি প্রয়োজনীয় কাজটা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারায়, এই কাজকে যেমন তাঁরা সাধুবাদ জানিয়েছেন তেমনি করেছেন প্রশংসাও৷
চিরাচরিত প্রথানুযায়ী শান্তিনিকেতনে ভোরের বৈতালিক এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আশ্রম পরিক্রমা দিয়ে সূচনা হয় দিনটির৷ শান্তিনিকেতন গৃহের সামনে থেকে শুরু হয় নৃত্য সহযোগে শোভাযাত্রা৷ শোভাযাত্রা এসে পৌঁছয় গৌড় প্রাঙ্গন মঞ্চে৷ নৃত্যের তালে তালে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত৷ ‘যাও যাও গো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও’ রবীন্দ্র সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আবিরের আবেশ ছড়িয়ে মুখরিত হয় গৌড় প্রাঙ্গণ৷ এই মঞ্চেই পরিবেশিত হয় রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য-শ্যামা৷