চলতি বছরেই ৯০-এ পা রাখল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)৷ সেই উপলক্ষে মুম্বইয়ে সংস্থার সদর দফতরে এক অনুষ্ঠানে আরবিআইকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দাবি করেন, মূল্যবৃদ্ধি এখন নিয়ন্ত্রণে৷ করোনার সময় থেকেই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে অসাধ্যসাধন করেছে আরবিআই৷ প্রধানমন্ত্রীর এই প্রশংসাবাণীতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তারা উল্লসিত তো হলেনই না, বরং এর চারদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে আরবিআই গভর্নর জানিয়ে দেন, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ হয়নি৷ তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার উপরেই রয়েছে৷ অর্থাৎ দাম বেশিই রয়েছে৷ চলতি অর্থবছরেও খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৪.৫ শতাংশ থাকার সম্ভাবনা৷ শুধু তাই নয়, এই তীব্র গরমের সময় সবজিসহ খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে আরবিআই৷ আর এইসব কারণেই রেপো রেট গত ছ’বারের মতো এবারেও অপরিবর্তিত অর্থাৎ সাড়ে ৬ শতাংশ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক৷ এই ঘোষণায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বলে যে দাবি প্রধানমন্ত্রী করছেন, সেই মূল্যবৃদ্ধিকেই রেপো রেট না কমার কারণ হিসেবে দেখিয়েছে আরবিআই৷ সর্বোচ্চ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দাবি শুধু অযৌক্তিক নয়, বিভ্রান্তিকরও৷ শুধু তাই নয়, রেপো রেট অপরিবর্তিত থাকায় গাড়ি-বাড়ির জন্য ইএমআইয়ের চড়া সুদের হার থেকে একটু স্বস্তি মেলার আশা নেই মধ্যবিত্তদের৷
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, করোনার পর থেকেই দেশে পাইকারি ও খুচরো বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে৷ বৃদ্ধির হারে মাঝেমধ্যেই সামান্য তারতম্য ঘটলেও তা কখনই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেঁধে দেওয়া শতাংশের নীচে নামেনি৷ গত পাঁচ মাসে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ০.২০ শতাংশ৷ কিন্ত্ত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৬.৯৫ শতাংশ হারে৷
শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধি ১৯.৭৮ শতাংশ, ডালের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.৪৮ শতাংশ৷ ফেব্রুয়ারিতে খুচরো বাজারেও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৮.৬৬ শতাংশ হারে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইকারি মূল্যসূচকে খাদ্যপণ্যের ভাগ কম৷ ফলে বাজারে তার প্রভাব তেমন চোখে পড়ে না৷ কিন্ত্ত খুচরো বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আশঙ্কাজনক বেশি হলে তা ক্রেতাকে সরাসরি আঘাত করে৷ ফলে চিত্রটা না বদলালে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে৷ দেশের আমজনতার অবস্থা এখন তেমনটাই৷ দুর্ভাগ্য হল, এসব জেনেবুঝেও ‘মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে’ বলে মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি হয়ত দেখাতে চাইছেন মূল্যবৃদ্ধির হার ৮ থেকে কমে ৭ শতাংশ বা ৭ শতাংশ থেকে কমে ৬ শতাংশ হয়েছে৷ অতএব মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এবং জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করেছে৷ কিন্ত্ত বাস্তব হল, নির্দিষ্ট মাত্রার (৪ শতাংশ) নীচে মূল্যবৃদ্ধির হার না নামলে মানুষের কোনও সুরাহা হয় না৷ প্রধানমন্ত্রী এই ছবিটাকেই আড়াল করে একটা ‘ফিল গুড’ চিত্র তুলে ধরতে চাইছেন৷ অথচ গরমের মরশুমে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে চলেছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করছে আরবিআই৷ শীর্ষ ব্যাঙ্ক- গভর্নরের বক্তব্য, যে হারে মূল্যবৃদ্ধির হার কমার প্রত্যাশা ছিল, সেটা হচ্ছে না৷ তাই আগামী অক্টোবর মাসের আগে রেপো রেট কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ ব্যাঙ্কের সাফাই, মূল্যবৃদ্ধির জন্যই রেপো রেট কমানো যাচ্ছে না৷ অর্থাৎ গরিব, মধ্যবিত্তের কোনও সুরাহাই হচ্ছে না৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ঠিকমতো বৃষ্টি হয় তাহলে মূল্যবৃদ্ধির হার অক্টোবরে ৩.৮ শতাংশে নামতে পারে৷ দেশে স্বাভাবিক বর্ষা হলে গম ও খরিফ চাষে উন্নতি হবে৷ তাহলে কৃষিসহ গ্রামীণ কর্মকাণ্ড বাড়বে৷ যার পরিণতিতে কেনাকাটাও বাড়বে৷ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম সামান্য হলেও কমিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি৷ ফলে আগামী দিনে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমতে পারে৷ কিন্ত্ত দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হলে, তাপপ্রবাহে একাধিক ফসল নষ্ট হলে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ফের বেড়ে গেলে ফল হবে উল্টো৷ মানে দাম আরও বাড়বে৷ ভোটের স্বার্থে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কিছুটা কমলেও ভোট মিটলে ফের দাম বাড়তে পারে৷ সব মিলিয়ে আগামী দিন কোনও আশার আলো দেখাচ্ছে না৷ বরং নরেন্দ্র মোদি ফের ক্ষমতায় ফিরলে মূল্যবৃদ্ধি হয়ত রুটিন হয়ে দাঁড়াবে৷ গরিব মধ্যবিত্তের অবস্থান হবে সেই তিমিরেই৷