দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবেই৷ বিরোধীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একথা বলেছেন৷ কিন্ত্ত পরিসংখ্যান এর উল্টো কথাই বলছে৷ গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নেওয়া মাত্রই সেই দুর্নীতিগ্রস্ত বিরোধী নেতাদেরই ‘চুন চুন কে মাফ’ করে দিয়েছে বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিন’৷ ২০১৪ সাল থেকে এভাবে দুর্নীতির কলঙ্কমুক্ত হয়েছেন অন্তত ২৩ জন৷ এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রেই একথা জানা গিয়েছে৷ ওই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২৫ জন বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল৷ এঁদের মধ্যে ১০ জন কংগ্রেসের, ৪ জন করে এনসিপি ও শিবসেনার, তিনজন তৃণমূল কংগ্রেসের, টিডিপি’র দু’জন এবং একজন করে নেতা সমাজবাদী পার্টি ও ওয়াইএসআর কংগ্রেসের৷ তদন্ত শুরু হতে না হতেই তাঁরা যোগ দেন বিজেপিতে৷ আর তারপরই তিনজনের বিরুদ্ধে চলা মামলাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে আরও ২০ জনের বিরুদ্ধে চলা তদন্তও৷ বিষয়টি সামনে আসা মাত্র সমালোচনায় সরব হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র৷ তিনি সাফ জানিয়েছেন, ‘এ এক অঘোষিত ইমার্জেন্সি৷ গণতন্ত্রের মুখ পুড়ছে প্রধানমন্ত্রী মোদির জমানায়৷’
লোকসভা নির্বাচনের আগে শুধু চলতি বছরেই গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছেন ছ’জন বিরোধী নেতা৷ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে ‘ওয়াশিং মেশিন’এর মহিমা টেরও পেয়েছেন৷ বিরোধী নেতা-নেত্রীদের কাবু করতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে ব্যবহারের অভিযোগ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে নতুন কিছু নয়৷ ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতরের ভয়ে অভিযুক্তদের অধিকাংশই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নাম লিখিয়েছেন বিজেপিতে৷ আশ্চর্যজনকভাবে এরপর তাঁদের বিরুদ্ধে এজেন্সিগুলির তৎপরতা কমে যাওয়া বা মামলা প্রত্যাহারের ঘটনার সাক্ষী হল গোটা দেশ৷ সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এসব কথা ফলাওভাবে প্রকাশ করা হয়েছে৷
দেখা যাচ্ছে তালিকায় এই ২৫ বিরোধী নেতার মধ্যে ১২ জনই মহারাষ্ট্রের৷ তাঁদের ১১ জন ২০২২ বা তার পরবর্তী সময়ে বিজেপিতে যোগ দেন৷ ১০ জনের বিরুদ্ধে নাম-কা-ওয়াস্তে মামলা রয়ে গিয়েছে৷ কেন্দ্রীয় এজেন্সি সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল মহারাষ্ট্রে৷ ২০২২ সালে সেখানে মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন একনাথ শিন্ডে৷ শিবসেনার বিধায়কদের ভাঙিয়ে এনে বিজেপির সমর্থনে সরকার গড়ে মুখ্যমন্ত্রীও হয়ে বসেন শিন্ডে৷ তবে এক বছরের মধ্যে এনসিপি ভেঙে অনুগামীদের নিয়ে মহারাষ্ট্রের এনডিএ সরকারে যোগ দেন অজিত পাওয়ার৷ সঙ্গী হন একদা এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ারের বিশ্বস্ত অনুগামী প্রফুল্ল প্যাটেলও৷ সেই অজিত এবং প্রফুল্লের বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতির মামলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, সংসদে আদর্শ সোসাইটি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল মোদি সরকার৷ তাতে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চ্যাবনের নাম উল্লেখ করা হয়৷ এরপরই তিনি কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দেন বিজেপিতে৷ প্রধানমন্ত্রী দল বিজেপি তাঁকে সাংসদ করে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে৷
২০১৯ সালে নারদ স্ট্রিং অপারেশন ঘিরে ঝড় ওঠে বাংলার রাজনীতিতে৷ রাজ্যের তৎকালীন এক তৃণমূল সাংসদের নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে৷ তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর জন্য লোকসভার অধ্যক্ষের অনুমতি চায় সিবিআই৷ কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই অনুমতি মেলেনি৷ ২০২০সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে বর্তমানে রাজ্যে বিরোধী দলনেতা৷ দীর্ঘ পাঁচ বছরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ তালিকায় আছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও৷ ২০১৪ সালে সারদা বেআইনি অর্থলগ্নি প্রতারণা মামলায় তাঁর নাম জড়িয়েছিল৷ সিবিআই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করে৷ অফিস ও বাড়িতেও হানা দেয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা৷ ২০১৫ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর অবশ্য আর কোনও তল্লাশিতে পড়তে হয়নি তাঁকে৷
তালিকায় নাম রয়েছে প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ জ্যোতি মৃধা এবং প্রাক্তন টিডিপি সাংসদ ওয়াই এস চৌধুরির নাম৷ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর এঁরা বিজেপিতে যোগ দেন৷ ইডি অবশ্য এঁদের আর বিরক্ত করেনি৷ তথ্যের ভিত্তিতেই তদন্ত করে সিবিআই৷ এই দাবি জানিয়ে এক সিবিআই আধিকারিক বলেন, যথাযথ তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ ইডি অবশ্য একটু অন্যরকম বক্তব্য রাখে৷ ইডি’র এক আধিকারিক জানান, অন্যান্য এজেন্সির অভিযোগের ভিত্তিতে ইডি তদন্ত করে থাকে৷ অন্যরা তদন্ত বন্ধ করে দিলে ইডি’র করার কিছু থাকে না৷
বিজেপি-বিরোধী হলেই এজেন্সিগুলি তৎপর ও সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ বিজেপিতে যোগ দিলেই এজেন্সিগুলি ‘শীতঘুমে’ চলে যায়৷ এ এক বিচিত্র খেলা!