সিপিএমেরই কি ভরসা আছে?
খায়রুল আনাম: চরম ঔদ্ধত্য আর সীমাহীন অত্যাচারের খেসারত যে কী ভাবে দিতে হয়, চৌত্রিশ বছর রাজ্য শাসনের পরে রাজ্য বিধানসভায় শূন্য হয়ে যাওয়া বামফ্রন্টের ব’কলমে চলা সিপিএমকে তা শিখিয়ে দিয়েছে মানুষ৷ যে গ্রামাঞ্চলের ভোট ছিলো সিপিএমের অন্যতম ভোটশক্তি, সেই গ্রামাঞ্চলের মধ্যবিত্ত থেকে প্রান্তিক শ্রেণির সামান্যতম জমির মালিকদেরও সিপিএম তাদের দলতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে চড়িয়ে নিঃস্ব করে দেওয়ার ফলে, সেইসব শ্রেণির মানুষ সময়ের সদব্যবহারে মধ্যে দিয়ে রাজ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের ঘর থেকে বাম তথা সিপিএমকে বেঘর করে দিয়েছে৷ আর তারপর থেকেই সিপিএম ক্ষমতায় ফেরার লিপ্সায় যে কংগ্রেসকে তাদের অন্যতম শত্রু ও প্রতিপক্ষ বলে প্রচার করতে কংগ্রেসের হাতকে রক্তলোলুপ হাত বলে চিহ্নিত করে দেওয়ালে দেওয়ালে রক্তমাখা বাঘনখের ছবি এঁকে বেড়াতো৷ প্রচার করতো কংগ্রেসের মিসা, জরুরি অবস্থার মতো গণতন্ত্রের কালো দিনের কথা৷ কিন্ত্ত সময়ের প্রেক্ষিতে সেই রক্তমাখা বাঘনখের সঙ্গে সমঝোতা করে শতাংশের হিসেবে সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়া সিপিএমের একাংশ এবারের লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্য পাওয়ার স্বপ্ন ফেরি করতে শুরু করেছে৷ বীরভূম জেলাতেও সেই চিত্র স্পষ্ট৷ রাজ্যে রাজনৈতিক পালা বদলের দু’বছর আগে ২০০৯ সাল থেকেই বীরভূম জেলার দু’টি লোকসভা আসন বীরভূম ও বোলপুরে সিপিএমের ভোটধ্বস ত্বরান্বিত হয়েছে৷ আবার বাম তথা সিপিএম যতো বেশি করে ক্ষুয়িষ্ণু কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাতের পথে হেঁটেছে ততোই বিরক্ত বামেদের একটা ভোট ‘রামের ঘরে’ গিয়ে বিজেপির হাতকে শক্ত করেছে৷ একদা বাম তথা সিপিএমের শক্ত পুরুষ জ্যোতি বসু কলকাতার ব্রিগেডে ‘সাম্প্রাদায়িক শক্তি’ বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরে আহ্লাদিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে বামশক্তির কফিনে যে পেরেক ঠুকেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে আর বামেরা তথা সিপিএম রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে আর মেরুদণ্ডে জোর নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি৷ সেই একই অবস্থা কংগ্রেসেরও৷ তাই এবারের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসকে ভরসা করতে হচ্ছে নিজেদের উপরেই ভরসা হারানো সিপিএমের উপরে৷
জেলা বীরভূমের বীরভূম ও বোলপুর, এই দু’টি আসনেই অতীতের মতো এবারও সিপিএম প্রার্থী দেবার কথা ভাবতে শুরু করে৷ কিন্ত্ত কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের কোনও সমীকরণ তৈরী না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাম তথা সিপিএমের মুষ্টিমেয় কর্মীরা বিরক্ত হয়ে বসে যেতে শুরু করেন৷ মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ জোটের সুবিধা পেতে তড়িঘড়ি একদা প্রণব মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়কে নিজের মেরুদণ্ডের জোরে জিতিয়ে সংসদে পাঠানো প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীর জেলা মুর্শিদাবাদে নিজের প্রার্থীপদ চূড়ান্ত করে সেদিকে পা বাড়ান৷ আর এই প্রেক্ষাপটে বীরভূমে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত না হওয়া সত্বেও জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্রের এক সময়ের কংগ্রেস বিধায়ক রামপুরহাটের মিল্টন রশিদ নিজেকে স্বঘোষিত বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হিসেবে দেওয়াল লিখন শুরু করে দেন৷ বসে থাকেননি নলহাটির সিপিএম নেতা আব্দুল করিম৷ তিনিও নিজেকে বাম-কংগ্রেস জোটের বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে দেওয়াল লিখন শুরু করে দেন৷ এমন কী তিনি জানিয়েও দেন যে, এই কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে আমার নামই উঠেছিলো এবং তিনি এমনও মন্তব্য করেন যে, কংগ্রেস যদি বীরভূম কেন্দ্রে প্রার্থী দেয় তাহলে একটা সম্ভাবনাময় আসন জোটের পক্ষ থেকে হারাতে হবে৷ সিউড়িতে সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্য্যকান্ত মিশ্র দলের জেলা সম্পাদক গৌতম ঘোষ, দলের রাজ্য কমিটির মহিলা সদস্যা বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে জোটের প্রার্থী শ্যামলী প্রধান, দলের পলিটবু্যরো সদস্য প্রাক্তন সাংসদ ডা. রামচন্দ্র ডোমকে পাশে বসিয়ে জানিয়ে দেন যে, বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়া সত্বেও তাদের জেতার সম্ভাবনাময় বীরভূম লোকসভা আসনটিতে তাঁরা কংগ্রেসের মিল্টন রশিদকে জোটের প্রার্থী হিসেবে মেনে নিচ্ছেন৷ এই পরিস্থিতিতে জেলা কংগ্রেসের অভ্যন্তরিন বিবাদ-ক্ষত বাইরে চলে আসে৷ দলীয় প্রার্থীকেই তাঁরা মানেন না বলে জেলা কংগ্রেস পদাধিকারীদের বড় অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন৷ বিষয়টি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী ও দলের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাগড়েকে জানিয়ে দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি মৃণাল বসু, প্রাক্তন জেলা সভাপতি সঞ্জয় অধিকারী, তিন প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য অপূর্ব চৌধুরী, সত্যব্রত ভট্টাচার্য, রথীন সেন, জেলা কমিটির সদস্য বিবেক সাউ ও দেবকুমার দত্তকে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কার করেছেন৷ বহিষ্কৃতরা বলছেন, প্রদেশ কংগ্রেসের কোনও এক্তিয়ার নেই তাঁদের বহিষ্কার করার৷ আমরা মিল্টন রশিদকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নিয়ে ভোট করতে পারবো না৷ প্রয়োজনে বহরমপুর যাবো অধীররঞ্জন চৌধুরীর ভোট করতে৷