রনজিৎ দাস: আর্থিক দুর্নীতি থেকে স্বজন-পোষণে ভারতীয় ফুটবল জর্জরিত হয়ে উঠেছে৷ এর পাশাপাশি ভারতীয় ফুটবল দলের জঘন্য পারফরম্যান্সে ফুটবলপ্রেমীরা হতাশ হয়ে পড়ছে৷ প্রথমে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কল্যান চৌবে ও কোষাধ্যক্ষ অজয় কিপার বিরুদ্ধে ফেডারেশনের এটিম কার্ড নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে৷ অন্ধ্রপ্রদেশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রাক্তন সভাপতি গোপাল কে কে প্রথম এ বিষয়ে ফেডারেশনের দৃষ্টি আকর্ষন করেন৷ পরবর্তী সময়ে ফেডারেশনের প্রাক্তন লিগ্যাল হেড নীলাঞ্জন ভট্রাচার্যও নিজেই ফেডারেশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে এএফসির কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন৷ এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের এথিক্স কমিটি এনিয়ে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে চেয়েছে৷ উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে এএফসি থেকে ফিফা পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে৷ দীর্ঘদিন ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে আদালতে কেস চলেছে৷ যা বিশ্বফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ভালোভাবে নেয়নি৷ আবারও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে কোর্ট নিযুক্ত আইনজীবীই ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন৷ মাত্র দেড়বছর আগেই কোর্টের অধীনে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন হয়েছে৷ বাঙালি ফুটবলার ও রাজনীতিবিদ কল্যান চৌবে গুজরাট ফুটবল ফেডারেশনের প্রতিনিধি হয়ে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হোন৷ ঘটা করে ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সাজি প্রভাকরনকে নিযুক্ত করা হয়৷ কিন্ত্ত কিছুদিনের মধ্যেই ফেডারেশনের সাথে তার মতবিরোধ ঘটে এবং বিশ্বাসভঙ্গের কারন দেখিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল সাজি প্রভাকরনকে নির্বাসিত করা হয়৷ এই নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে পর্যন্ত মামলা গড়ায়৷ ফেডারেশনের নির্বাসনের উপর সাজি প্রভাকরন কোর্ট থেকে স্হগিতাদেশ নিয়ে আসেন৷ যদিওবা ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এম সত্যনারায়ণ ফেডারেশনের কার্যকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন৷ অর্থাৎ ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন সেই কোর্ট কাছারির মধ্যে পড়ে গেল৷ যা ফিফা কখনও ভালো চোখে দেখেনা৷ এই ডামাডোলের মধ্যে এআইএফএফের কার্যকারী সদস্য তথা ফেডারেশনের কম্পিটিশন কমিটির চেয়ারপারসন গোয়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন৷ তার বিরুদ্ধে গোয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান মহিলা লিগ-২তে অংশগ্রহণকারী দুজন মহিলা ফুটবলার শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ এনেছেন৷
ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হয়ে কল্যান চৌবে চুড়ান্ত ব্যর্থ প্রশাসক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে ফেলেছেন৷ রাজনৈতিক মঞ্চে চরম ব্যর্থতার পর ফুটবল খেলার মঞ্চে নিজেকে হাস্যস্পদ করে ফেলেছে৷ যখনই কোনো অভিযোগ ওঠে আসছে,তখন ৩ বা ৫-জনের তদন্ত কমিটি করে একেরপর এক বিষয় ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ ফুটবলকে ঘিরে তার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে৷ গতবছর জাতীয় পর্যায়ের সন্তোষ ট্রফির সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলা বিদেশের মাটিতে নিয়ে গেলেন৷ আবার এবছর সেই সন্তোষ ট্রফির খেলা দেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনলেন৷ এই বিদেশ ও দেশের মাটিতে সন্তোষ ট্রফির টানাটানিতে, ২০২৭র এশিয়ান কাপ ভারতে করার দাবি ফেডারেশন তুলে নেয়৷ যা নিয়ে ইতিমধ্যে ফেডারেশনের বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রশ্ন উঠেছে৷
পাল্লা দিয়ে ভারতীয় ফুটবলের পারফরম্যান্স তলানিতে নামচ্ছে৷ ভারতের থেকে ফিফা র্যাকিংয়ের ৫০ধাপ নীচের আফগানিস্তানের সাথে বিশ্বকাপের যোগ্যতা পর্বের ম্যাচ দুটিতে ভারতীয় ফুটবল দল জিততে পারেনি৷ ঘরের মাঠে নিজেদের সমর্থকদের সামনে ম্যাচ হারতে হয়েছে৷ ম্যাচ হারার পর ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে ‘চোর চোর’ স্লোগান উঠেছে৷ ভারতীয় দলের টিম বাসকে ঘিরে কোচ ইগর স্টিম্যাচের অপসারণের দাবি উঠেছে৷ এক্ষেত্রেও ৫জনের কমিটি করে সভাপতি কল্যান চৌবে তার দায় এড়াতে চাইছেন৷ প্রসঙ্গত বলা যায়, কোচ ইগর স্টিম্যাচ এশিয়ান কাপের মুলপর্বে খেলার প্রত্যাশায় যোগ্যতাপর্বে ভারতীয় দলের সাথে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একজন জোতিষী রেখেছিলেন৷ ভারতীয় ফুটবল দল সেই এশিয়ান কাপের মুলপর্বে খেললো৷ এবং ২৪দলের মধ্যে সবার শেষে নিজেদের স্থান দখল করলো৷ তিনটে ম্যাচ খেলে একটাও ম্যাচ তারা যেমন জিততে পারেনি, তেমন কোনো দলের বিরুদ্ধে একটা গোল করতে পারেনি৷ এশিয়ান কাপের পর বিশ্বকাপের যোগ্যতাপর্বে দুর্বল আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জিতে কোচ ইগর নিজেদের দলের দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্ত্ত দুর্বল আফগানিস্তান দল ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত থেকে,বা বলা ভালো ভারতকে হারিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে ফেডারেশনের অপদার্থতাকে দেখিয়ে দিল৷ এখন ভারতের থেকে ফিফা র্যাকিংয়ের ৩০ ধাপ নীচের কুয়েতের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতার জন্য জুন মাস অবধি কোচ ইগর স্টিম্যাচকে রেখে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে৷ বলা হচ্ছে এই মুহূর্তে ভারতীয় দলের কোচকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলে নাকি মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে৷ দেশের সন্মানের কথা না ভেবে কল্যান চৌবের পারিষদরা কেন ভারতীয় দলের কোচের সাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করেছেন–এনিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ সুকৌশলে ভারতীয় দলের বিশ্বকাপের তৃতীয় রাউন্ডে যাওয়ার আশ্বাসে ফেডারেশন ফুটবলপ্রেমীদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছে৷ বিশ্বকাপের ফরম্যাট অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে৷ এশিয়ান জোন থেকে ৮টা দল তো বটেই, ৯টা দলের বিশ্বকাপের মুলপর্বে খেলার সুযোগ আছে৷ সেই পরিকল্পনায় এএফসির বিশ্বকাপের যোগ্যতা পর্বের সূচী এমনভাবে করেছে যে ভারতের মত দলকে বিশ্বকাপের তৃতীয় রাউন্ড কেন, চতুর্থ রাউন্ড অবধি পৌঁছনো অসুবিধার নয়৷ তৃতীয় রাউন্ডে এশিয়ার ১৮টা দলের খেলার সুযোগ আছে৷ ভারতীয় দল কি এশিয়ার ১৮টা দলের মধ্যে পড়েনা? তাই তৃতীয় রাউন্ড অবধি পৌঁছনোর মধ্যে বিশেষ কৃতিত্ব কোথায়? এখন যেমন এশিয়ান কাপের মুলপর্বে ২৪টা দলের খেলার সুযোগ মেলে৷ তো ভারতের এশিয়ান কাপের মুলপর্বে খেলা কি বিশেষ কৃতিত্বের পর্যায়ে এখন পড়ে? এবার এশিয়ান কাপের ফাইনালে জর্ডন খেললো৷ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে যারা ৮৭নম্বরে ছিল৷ সেইসময় আমাদের র্যাকিং ১০২ ছিল৷ জর্ডনের মত দেশ উন্নতির পথে যেতে পারে,আর আমাদের অধঃপতন হয়ে চলছে৷ আসলে এশিয়ান কাপের মুলপর্ব বা বিশ্বকাপের তৃতীয় রাউন্ডে এশিয়া লেভেলে খেলটা বিশেষ কৃতিত্বের নয়৷ আমাদের দৃষ্টিপাত ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে৷ ভারতের মাটিতে দুর্বল দেশকে এনে টুর্নামেন্ট করার কুফল ভারতীয় দল হাতেনাতে পাচ্ছে৷ ভারতীয় ফুটবল অদক্ষ প্রশাসক ও রাজনীতির ঠেলায় ক্রমশঃ অন্ধকারের পথ চলে যাচ্ছে৷ কল্যান চৌবের সভাপতির পদে আসার পর এই অন্ধকার আরও দৃশ্য হচ্ছে৷ দিল্লির মাঠের ফুটবল খেলার গড়াপেটা কি ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের অন্ধকারেরই দিকনির্দেশ করছেনা?