• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

তন্দুর হাউজ

ভাস্কর মজুমদার দু-প্লেট স্পেশাল বিরিয়ানি, স্যালাড আর দুটো ফ্রেশ লাইম সোডা৷ ছোট্ট চিরকুটের মতো কাগজে লেখা রেস্তোরাঁর হিসেব৷ ও এটা ফেলে দিতে বলেছিল৷ অন্য জিনিসগুলোর মতো এই এক চিলতে কাগজের স্মৃতিটাও ও রাখতে চায়নি৷ আমি প্রায় লুকিয়ে রাখার মত আমার পুরনো মানিব্যাগটায় এটা রেখে দিয়েছিলাম৷ আমাদের শেষ দেখা হবার চিহ্ন৷ অভিজ্ঞান৷ মোবাইলের ছবিগুলো ও নিজের

ভাস্কর মজুমদার

দু-প্লেট স্পেশাল বিরিয়ানি, স্যালাড আর দুটো ফ্রেশ লাইম সোডা৷ ছোট্ট চিরকুটের মতো কাগজে লেখা রেস্তোরাঁর হিসেব৷ ও এটা ফেলে দিতে বলেছিল৷ অন্য জিনিসগুলোর মতো এই এক চিলতে কাগজের স্মৃতিটাও ও রাখতে চায়নি৷ আমি প্রায় লুকিয়ে রাখার মত আমার পুরনো মানিব্যাগটায় এটা রেখে দিয়েছিলাম৷ আমাদের শেষ দেখা হবার চিহ্ন৷ অভিজ্ঞান৷ মোবাইলের ছবিগুলো ও নিজের হাতেই ডিলিট করেছিল৷ আমি না করিনি৷ কোনও প্রতিবাদের মধ্যে যাইনি, বলিনি আমার মোবাইল তুমি ধরবে কেন? আরও কিছু মাস আগে হলে হয়তো ছিনিয়ে নিতাম, হাসতে হাসতে খিমচে দিতাম৷ ও নিজেও খিলখিলিয়ে উঠতো আর আমার ঘরের ছোট খাটটায় একটা হাতাহাতি চলতো কিছুক্ষণ৷ তখন দুজনেরই হয়তো গায়ে কোনও পোশাক নেই! তন্দুর হাউজের মুখটায় নোংরা বাজার৷ ভেতরে ঢুকলে যে নানা রঙের আলো, বাইরেটা দেখলে আন্দাজ করা যায় না৷ বেশিরভাগ সন্ধেতেই ঘুরেফিরে আমরা ওখানে গিয়ে পৌঁছতাম৷ ওর খিদে পেত খুব৷ বাড়িতে হয়তো সেদিন অনেক সকালে বেরিয়েছে, ভালো করে খেতে পারেনি৷ ওর খিদে-খিদে মুখটা দেখলে আমার মায়া হতো৷ ঘন ঘন দেখা হতো বলে রিসেপশনের ছেলেটা নিজে থেকেই এক টুকরো কাগজ হাসিমুখে এগিয়ে দিয়ে বলত— ‘দু’জন তো?’ হ্যাঁ দু’জন৷ দু’জনই৷ খুব ভালো ছিলাম৷ আনন্দে ছিলাম৷ কিন্ত্ত ও থাকতে চাইল না৷ নিশ্চয়ই কোনও খামতি ছিল আমার মধ্যে৷ ও তো এই প্রথম নয়৷ আমার সঙ্গে কেই বা থাকতে চেয়েছে৷ মা ছেড়ে চলে গেল কোন ছোটোবেলায় আর ফার্স্ট ইয়ারে যখন, বাবা মারা গেল৷ এই-ই আমার ভবিতব্য৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা বিশাল আয়না আছে৷ মুশকিল হলো এ আয়নায় যে-কোনও ছবিই ঝাপসা আসে৷ এতো বড় রেস্তোরাঁ আর এই আয়নাটা পরিষ্কার করা হয় না— এটা অবিশ্বাস্য৷ আমি আর ও বেশ কয়েকবার এটার সামনে দাঁড়িয়েছি ঝাপসা ছবি তুলতে৷ প্রতিবার ওর ইচ্ছাতেই৷ ও আমার থেকে বেশ খানিকটা লম্বা আর ছিলাটান ধনুকের মতো তরতরে, সুঠাম শরীর৷ আমি সে তুলনায় কুৎসিত৷ আমার ভুঁড়ি আছে৷ মাথায় অল্প টাক৷ আমার পোশাকেও কোনও যত্ন নেই৷ কিন্ত্ত আয়নার সামনে কীভাবে দাঁড়িয়ে কোনদিকে তাকিয়ে ছবি তুললে ছবিটা সুন্দর হবে ওর জানা নেই৷ আমি শিখিয়ে দিই ওকে৷ ওর ধন্যবাদমাখা হাসিটা আমায় মাতাল করে দেয়৷ শুধু মাতাল নয়, হয়তো পাগলও হয়ে গিয়েছিলাম৷ আঁকার টিউশনি করে আমার গ্রাসাচ্ছাদন চলে৷ কতো আর রোজগার করি৷ আঁকানো তো পড়াবার মতো নয়৷ পড়ানোর টিউশনিতে যা পাওয়া যায় তার থেকে অনেক কম পয়সা আঁকানোয়৷ মধ্যে আবার স্কুলের চাপে, বাইরে ঘুরতে যাবার তাড়নায় ছেলেমেয়েরা কামাই করে৷ এমন অনেকবার হয়, যে মাসটা তারা আসে না সে মাসের মাইনেটা দেয় না৷ স্কুল কলেজে কি তারা এমন করতে পারে? কিন্ত্ত আমার সঙ্গে করে৷ আমি কিছু বলতে পারি না৷ টেনেটুনে কোনও মতে চালিয়েনি৷ বাড়ি ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, নিজের খাওয়া দাওয়া আর এতদিন ও ছিল৷ ও নেইও অনেকগুলো মাস হয়ে গেল৷ এক বছরের ওপর প্রায়৷ ও একটা নতুন ফোন কিনেছিল৷ সেটার ইএমআই-টা আমি চালাতাম৷ মাসে সাড়ে সাতশো টাকা৷ কি আশ্চর্য! ওর থাকা আর মোবাইলের ইএমআই দুটো যেন একসঙ্গে মিটে গেছে৷ একদিন খুব রেগে গিয়েছিলাম৷ সরস্বতী পুজোর দিন৷ আমার বাড়িতে ছোটো করে একটু আয়োজন করি৷ দুপুরে খিচুড়ি রাঁধি নিজেই৷ কিছু ছাত্রছাত্রী আসে, প্রসাদ খায়৷ তাদের স্কুল-কলেজ সেরেই আসে৷ আমি চেয়েছিলাম ও থাকুক সকালের দিকটা৷ কিন্ত্ত বাবু সকাল থেকে আমার ফোনই ধরলো না৷ বুঝেছিলাম ওই মেয়েটার সাথে হয়তো বেরিয়েছে৷ রোগা, গায়ে-পড়া মেয়ে৷ দেখলেই মনে হয় চরিত্রহীন৷ আমার রাগ হতো না যদি না ও দুপুরের পর থেকে আমার ফোনটা কাটতে শুরু করতো৷ মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল আমার৷ মনে হচ্ছিল দুটোকে সামনে পেলে খুন করে দেবো৷ মেয়েটাকে আগে৷ ছুরি দিয়ে কেটে বহু টুকরো করবো মেয়েটাকে৷ বিকেল পড়ে আসার আগে হঠাৎ ওর হোয়াটস্যাপ— তুমি ফোন করেছিলে? সরি, সাউথসিটি মলে ছিলাম৷ এতো ভিড় এখানে শুনতে পাইনি৷ কিছু বলার ছিল? —তোমায় আর কিচ্ছু বলার নেই আমার৷ আমি আজ থেকে মরে গেছি তোমার জন্যে৷ আর ফোন করবে না আমায়৷ আমি বললাম ঠিকই কিন্ত্ত ও শুনল না৷ তারপরে প্রতি মিনিটে ফোন করে যেতে থাকলো৷ আমি বেশ কয়েকবার তুললাম না, ফোন সাইলেন্ট করে রাখলাম৷ ও মেসেজ করে, হোয়াটস্যাপ করে বারবার বলে গেল, প্লিজ ক্ষমা করে দাও, একটু দেখা করো প্লিজ৷ তোমার বাড়ি গেলে তুমি চেঁচামেচি করবে, প্লিজ গড়িয়া মেট্রো এসো৷ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ৷ তুমি যতোক্ষণ না আসবে আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো৷ থাকুক৷ ভেবেছিলাম দাঁড়িয়ে থাকলেই বেশ হবে৷ আমার জেদ ও জানে না৷ কিন্ত্ত নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না৷ আমি যখন গড়িয়া মেট্রো পৌঁছলাম তখন সাড়ে সাতটা৷ সিঁড়ির কাছটায় ও দাঁড়িয়ে৷ ক্লান্ত, বিধস্ত৷ হাসছে৷ রাগ ভাঙাতে ও আমায় রিকশায় চড়িয়ে ফ্লোটিং মার্কেটের দিকে নিয়ে গেল৷ আমি কক্ষনো সেখানে আগে যাইনি৷ একটা জলাশয়ের ওপর মঞ্চের মত কাঠামো আর তার মধ্যে বাজার, দোকান এমনকি সেলুন পর্যন্ত৷ দু-এক হাত দূরে দূরে টিউব লাইটের আলো৷ মায়াবী পরিবেশ৷ আমরা ঘুরলাম৷ ও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাইছিল৷ আমায় শান্ত করতে চাইছিল, কিন্ত্ত আমি তখনও নাছোড়বান্দা৷ সেই ভাসমান বাজার থেকে আমায় বের করে উলটো দিকের একটা বড় পার্কে নিয়ে যেতে চাইল ও৷ রাস্তায় ভিড় তখন৷ স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদেরই ভিড়৷ রাস্তা পার হয়ে পার্কে বসবো৷ ওখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়৷ ও কিন্ত্ত আমার কাছ থেকে টাকা চাইল না, রিকশায় আসার ভাড়াটাও ওই-ই দিয়েছে৷ ও টিকিট কাটার অফিসটার দিকে এগিয়ে গেল৷ কিন্ত্ত সেদিন পার্কে প্রবেশের সময় ততোক্ষণে পেরিয়ে গিয়েছে৷ এরকমই একদিন ওদের বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিল৷ সাধারণ বিহারি পরিবার৷ বাঁশদ্রোণীর সেই কতো ভেতরে! আমি টালিগঞ্জে এত বছর আছি কখনও জানতাম না এই জায়গাগুলো সত্যিই আছে৷ রাস্তা মাটির৷ অনুন্নত পাড়া-গাঁয়ের মত চেহারা জায়গাটার৷ ওদের অবশ্য নিজেদের পাকা বাড়ি৷ ঘর একটা, রান্নাঘর আর বাথরুম৷ ঘরের বেশিরভাগটাই জুড়ে রয়েছে বিরাট খাট আর রক্ত-রঙের একটা ফ্রিজ৷ এ-রং আমার খুব প্রিয় ছিল এক সময়৷ কলেজে পড়াকালীন খুব ছবি আঁকতাম এই রঙে৷ ঘরে রং বলতে এদের এটুকুই৷ বাকিটুকুর গায়ে কোনও রং নেই৷ হয়নি৷ ওর বাবা কারো বাড়ির ড্রাইভারি করেন৷ তিনটে পেট চালাতে হয়৷ দিদির বিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্ত্ত এখনও সেখান থেকে নানা আদেশ আসতে থাকে৷ ওর মা-বাবা মাঝে মাঝে এসবে দিশেহারা হয়ে যান৷ মা-বাবার কাছে ও আমায় ‘স্যার’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয় অথচ আমি কোনোদিনই ওকে পড়াইনি কিংবা আঁকা শেখাইনি৷ ফেসবুকে আমাদের পরিচয়৷ আমার লেখা পড়ে নিজেই মেসেঞ্জারে পিং করেছিল৷ বিহারি হলেও ওর পড়াশোনা বাংলায় আর সে-কারণেই আমার লেখা পড়তে পেরেছিল৷ নানারকম কথা হতে থাকতো, সঙ্গে গুড মর্নিং-গুড নাইট তো ছিলই, যেমন থাকে৷ তারপর কবে থেকে ঘনিষ্ঠতা হল, এতো ঘনিষ্ঠতা যে দুপুরের পর দুপুর ওর কেটে গেল আমার বাড়িতে, রাসবিহারী থেকে গড়িয়াহাট কত গল্প করতে করতে হাঁটতাম দুজনে, সিনেমা দেখতে যেতাম, মিউজিয়াম, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কতো ছবির প্রদর্শনী অ্যাকাডেমি-সিমাতে আর মাঝে মাঝে তন্দুর হাউজ তো ছিলই৷ সেদিন ওর বাবা বলেছিলেন, কলকাতায় ছেলের কিছু হচ্ছে না আর কিছু মাস দেখে ছেলেকে উনি দিল্লি পাঠিয়ে দেবেন৷ ওখানে অনেক আত্মীয়স্বজন আছে, বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত— কোথাও না কোথাও কিছু একটা হয়ে যাবেই৷ ছেলেকে উনি ড্রাইভারি করতে দেবেন না৷ ওর চলে যাওয়াকে আমি পাত্তা দিইনি৷ দিল্লি আর কতদূর৷ যাওয়া-আসা থাকবেই৷ কিন্ত্ত এটুকু দূরত্বেও যে আমি প্রতি সন্ধ্যায় একটু একটু করে মরতে থাকবো আর ও ফোন করবে না, সেটা আমি তখন বুঝতে পারিনি৷ সত্যিই পারিনি৷ সন্ধ্যাবেলাগুলো বুকটা ভারী হয়ে আসে, আমি রাসবিহারী থেকে লেক মার্কেট যাবার রাস্তাটায় উসকোখুসকো ঘুরে বেড়াই আর মাঝে মাঝে যে রেস্তোরাঁটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই তার নাম তন্দুর হাউজ৷ দিল্লি চলে গিয়ে ইস্তক ও আর ফোন করেনি৷ একবারও না৷ বছর খানেক তো হয়ে গেলই৷ ও ফেসবুকে আমায় ব্লক করে দিয়েছে৷ হোয়াটস্যাপ-স্টেটাসটাও দেখা যায় না৷ তবে নম্বরটা এখনও ব্যবহার করছে৷ পুরনো নম্বরটাই৷ আমি মাঝে মাঝে অন্য নম্বর থেকে ফোন করে দেখেছি৷ ওই-ই ধরে৷ ওর কণ্ঠস্বর তো আর আমি ভুলব না৷ ও সব কিছুই করছে৷ শুধু প্রয়োজন বোধ করছে না আমায় ফোন করবার৷ এতোটা না করলেও পারে৷ ও যেভাবে সবকিছু ভুলে যেতে, মুছে ফেলতে বলেছিল আমি বাধ্য ছেলের মতো সেসব করেছি৷ ওর অন্যথা করিনি৷ খুব ক্ষতি হতো সৌজন্যের যোগাযোগটুকু রাখলে? সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়, সারিয়ে দেয় বলে৷ আমাকে তবে কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে? রাসবিহারীর মোড়টা সবসময়ই কর্মব্যস্ত৷ একটা প্রবল হুড়োহুড়ির ভাব৷ ফুটপাথটা আর মানুষের হাঁটার জন্য অবশিষ্ট নেই৷ ফোন-মোবাইলের দোকান আর ফল-পাকুড়ের পশরা৷ সবকিছু পেরিয়ে আমি এগিয়ে যাই, নাকে এসে লাগে গভীর আঁশটে গন্ধ৷ পাশেই লেক মার্কেট বাজার৷ হাওয়ায় একটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে ভাব৷ আজ একটা আকাশিরঙা কুর্তা পরেছি সেই প্রথমদিনের মতো৷ দরজা পেরিয়ে দাঁড়াতেই চেনা ছেলেটি৷ আমি আঙুল দিয়ে এক দেখালাম, সে চিরকুটটা এগিয়ে দিল৷ সাজানো, আলোকিত বেসিনটা বাঁদিকে ফেলে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করি৷ খাওয়া শেষ করে আবার এই বেসিনের কাছেই আসতে হবে৷ সিঁড়িতে এক ধাপ উঠে অদ্ভুত লাগল যে ওই বড়ো আয়নাটা আর নেই৷ দেখে মনে হচ্ছে আয়নাটা সারাতে নিয়ে গেছে৷ সে আবার আসবে৷ নতুন আয়নাও আসতে পারে৷ এক টুকরো পুরনো বাংলা ছবির সাজসজ্জা, স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবির বাঁধানো কপি দেওয়ালে দেওয়ালে, জানলায় রাখা কেবল সাজানোর জন্য নকল বই আর মায়াময় আলোর সম্ভার৷ এই সেই তন্দুর হাউজ৷ লোকভর্তি এখন৷ যে ছেলেগুলো টাই পরে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে কোনার দিকে একটা টেবিলে বসতে নির্দেশ করলো হাসিমুখে৷ গিয়ে বসতেই জল চলে এলো আর সঙ্গে ছেলেটি নোট প্যাড আর পেন নিয়ে৷ সে অর্ডার নেবে৷ আমি জানিয়ে দিই এখানকার সেই বিখ্যাত স্পেশাল বিরিয়ানিটা দিতে সঙ্গে লিমকা একটা৷ সে সরে যেতে আমি অপেক্ষা করি৷ বহু কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে, কিছু পরিবার এদিক ওদিক টেবিল নিয়ে বসে আছে৷ কেউ একে অপরের ছবি তুলছে, সেলফি নিচ্ছে অবশ্যম্ভাবী৷ দগদগে ধোঁয়া-ওঠা একটা সিজলার এলো একটা টেবিলে৷ পুরো ঘর প্রায় ভরে গেল সেই ধোঁয়ায়৷ ধোঁয়ায় মাংস পোড়া গন্ধ৷ আমি দু-চুমুক জল খেলাম৷ খাবার এমন একটা জিনিস যে তার অপেক্ষা মনে হয় সব থেকে দীর্ঘ লাগে অথচ পাঁচ মিনিটও কাটেনি অর্ডার দিয়েছি৷ এখানে পেটভরে খেয়ে নিয়ে বাডি় ঢুকব৷ রাতে আর খাওয়ার ঝামেলা রাখব না৷ কেউ না থাকলে একা খাওয়ার অভ্যাস করতে হয়৷ নিজের জন্য পরিপাটি সাজতেও হয়৷ নিজের খেয়াল রাখতে হয়৷ গা থেকে আমার একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ নতুন কেনা পারফিউমটার সুগন্ধ৷ তন্দুর হাউজে এসি থাকলেও একটু গরম লাগছে৷ পরনের মোটা পাঞ্জাবিটার জন্য হতে পারে৷ পকেট থেকে রুমাল বার করে আমি মুখ মুছে নিই৷ তাতে মানিব্যাগটাও বেরিয়ে আসে৷ আমি মানিব্যাগ খুলি৷ টাকাগুলো গুছিয়ে রাখি৷ দুটো ডেবিট কার্ড— সেগুলোও৷ অন্য একটা জিনিস নজরে আসে৷ কিন্ত্ত সেটা তো পুরনো মানিব্যাগটায় ছিল, এখানে তো আসবার কথা নয়! যাই হোক, হয়তো আমিই রেখেছি কখনও৷ আমি সেই পুরনো বিলটা হাতে নিই৷ দু-প্লেট স্পেশাল বিরিয়ানি, স্যালাড আর দুটো ফ্রেশ লাইম সোডা৷ ছোট্ট চিরকুটের মত কাগজে লেখা৷ বিলের লেখাগুলো ঝাপসা হয়েছে৷ আমি দেখি আর তারপর ভালো করে কুচিয়ে ফেলে দিই টেবিলের পাশে থাকা নানা রঙের কারুকাজকরা বিনটার মধ্যে৷
টাই-পরা ছেলেটা মনে হয় খাবার নিয়ে এদিকেই আসছে৷