• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

কর্পোরেট থাবায় পরিবেশ ধ্বংসের আশঙ্কায় তীব্র প্রতিবাদ লাদাখে

রক্তিম রায়চৌধুরী লা মানে গিরিপথ আর দাখ মানে দেশ, ঘন নীল আকাশের পটভূমিকায় ভেসে থাকা সাদা মেঘের সোনালি , হলুদ বাদামি রঙের পর্বতের সারির মাঝখান দিয়ে কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, আর তিব্বতের দিক থেকে অসংখ্য গিরিপথ এসে পৌঁছেছে লাদাখের নানা নদী উপত্যকায়৷ আর সেই গিরিপথগুলির দুপাশে পাহাড়ের গায়ে গায়ে অসংখ্য সাদা স্তুপ আর চোরতেন দেখে বোঝা

রক্তিম রায়চৌধুরী

লা মানে গিরিপথ আর দাখ মানে দেশ, ঘন নীল আকাশের পটভূমিকায় ভেসে থাকা সাদা মেঘের সোনালি , হলুদ বাদামি রঙের পর্বতের সারির মাঝখান দিয়ে কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, আর তিব্বতের দিক থেকে অসংখ্য গিরিপথ এসে পৌঁছেছে লাদাখের নানা নদী উপত্যকায়৷ আর সেই গিরিপথগুলির দুপাশে পাহাড়ের গায়ে গায়ে অসংখ্য সাদা স্তুপ আর চোরতেন দেখে বোঝা যায় মানুষের বাস– এমন দৃশ্যে গিরিপথের দেশ লাদাখ উজ্জ্বল৷ তাছাড়া অসংখ্য উচ্ছ্বল স্রোতধারা মিশে মিশে গড়ে ওঠা উজ্জ্বল নদীগুলি, পর্বতের গায়ে ঝুলে থাকা গুম্ফাগুলি, নীল জলের সুবিশাল হ্রদের বিস্তার আর সহজ সরল মানুষদের আতিথেয়তা লাদাখকে পর্যটক মহলে ক্রমে জনপ্রিয় করে তুলেছে৷

গত ১৮ই মার্চ-এর দৈনিক স্টেটসম্যান -এ একটি ফটো প্রকাশিত হয়েছে৷ তার নিচে ক্যাপশনে লেখা ছিল ‘ষষ্ঠ তফসিলে লাদাখ অঞ্চলের পরিবেশ নিরাপত্তার দাবিতে নাগপুরে মহিলাদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন সোনম ওয়াংচুক৷ – এএনআই’ ৷

সংবাদসংস্থা এএনআই গুরুত্ব সহকারে এই খবর পাঠালেও দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম গুরুত্বসহকারে তা প্রচার করছে না৷ তবে গত ২১ মার্চ দৈনিক স্টেটসম্যান-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ খবরটি চোখে পডে়ছে৷ এই খবরটি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে হলে জানতে হবে ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের সঙ্গে লাদাখ অঞ্চলের পরিবেশ নিরাপত্তার কী সম্পর্ক? আর বিক্ষোভের নেতা এই সোনম ওয়াংচুক কে? আমরা তো লাদাখের জনগণকে ভারতের সবচাইতে শান্ত জনগোষ্ঠী বলেই জানি৷ তাহলে লাদাখের মহিলারা নাগপুর এসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কেন? আর কেনই বা সোনম ওয়াংচুক খোলা আকাশের নিচে অনশনেঅনশনে বসেছেন?

এই ষষ্ঠ তফসিল, ভারতের সংবিধানের ২৪৪তম অনুচ্ছেদের অন্তর্গত, স্বশাসিত জেলা পরিষদ(এডিসি) নামে পরিচিত যা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের ব্যবস্থা করে৷ এই জেলা পরিষদগুলি রাষ্ট্রের মতো কিছু কাজ করতে পারে যেহেতু তাদের কর আরোপ, বন ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে৷ মূলত, তারা একটি রাজ্যের মধ্যে থেকে আইনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের কিছু পরিমাপ ব্যবহার করে৷

উল্লেখযোগ্যভাবে, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য আইনসভা প্রণীত আইনগুলি এই অঞ্চলগুলিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রযোজ্য হয় না, তবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাজ্যপালকে অবহিত করতে হয়৷ সেজন্যেই কর্পোরেট মাফিয়াদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাতে ‘জলবায়ু অনশন’-এ বসা পরিবেশবিদরা সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল প্রয়োগের মাধ্যমে লাদাখের পরিবেশ নিরাপত্তার দাবিতে অনড়৷ কারণ তাঁরা দেখেছেন এই কর্পোরেট মাফিয়ারাই হাসদেওয়ের জঙ্গল ধ্বংস করেছে, সেখানে মানুষ-হাতি সমীকরণ দ্রুত বদলাচ্ছে, জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়েছে৷ আর এর ফলে মাটির নীচে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের হাত ধরে সমাজ সত্যি সত্যি কতটা এগোয়, মানুষ কতটা সভ্য হয় – সেসব প্রশ্ন ইতিউতি উঠতে শুরু করেছে৷ সর্বগ্রাসী উন্নয়নের অজুহাতে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিধনের এইসব কর্মকাণ্ড দুরন্ত গতিতে এগোতে থাকলে কী নিদারুণ পরিণাম ডেকে আনে তা বিপর্যস্ত যোশীমঠ সহ উত্তরাখণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষজন, কুলু-মানালি-শিমলা সমেত পুরো হিমাচল প্রদেশের মানুষ হাডে় হাডে় টের পাচ্ছেন৷ সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মীয়মাণ উত্তর কাশীর সুড়ঙ্গ ভেঙেছে৷ আসাম ও উত্তরবঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় তুমুল বৃষ্টি, প্রবল বন্যা হচ্ছে৷ ব্রহ্মপুত্র, মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক বিপদসীমা পেরিয়ে যাওয়ায় উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশের জনগণের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত৷ উত্তরাখণ্ড থেকে হিমাচল পেরিয়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষ ভয়ঙ্কর রূপে আছডে় পডে়ছে সিকিমের উপরেও৷

অন্যদিকে মণিপুরের পাহাড়ে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে এই কর্পোরেট মাফিয়ারা৷ এদের অপরিণামদর্শী তথাকথিত উন্নয়নের ঠেলায় লাক্ষা দ্বীপের পরিবেশও আজ বিপদগ্রস্থ৷ আসলে প্রকৃতিকে তার নিজস্বতা রক্ষা করতে না দিলে আমাদের রেহাই নেই৷ বন্যায় ভেসে যেতে হবে, তাপপ্রবাহে দগ্ধ হতে হবে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যশস্যের ফলন কম হওয়ায় তীব্র খাদ্যসংকট ও জলসংকট দেখা দেবে৷ রুষ্ট প্রকৃতি এসব ঘটাতে শুরু করেছে৷ তবু বুলেট ট্রেনের গতিতে এগিয়ে চলেছে তথাকথিত উন্নয়ন, নগরায়ন, পুঁজির পুনরুৎপাদন, বাজার-ব্যবসা বাণিজ্য-মুনাফার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ৷ এইসব অমানবিক, অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপকে বাধাহীন মসৃণ সড়কে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যেতেই পরিবেশ আইনের পরিবর্তন করা হচ্ছে৷

ইলেক্টরাল বন্ডের কোটি কোটি টাকা শাসক দলকে কারা দিচ্ছে, সেই তালিকার নিরিখে এই পরিবর্তনগুলোকে যাচাই করলেই পাঠক নিশ্চিত হবেন যে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট ভজা রাজনীতির সঙ্গে আজকের পরিবেশ নীতি, মণিপুর ও কাশ্মীরে অস্থিরতা তৈরি, দেশজুডে় বিভেদ বিভাজন – সবকিছুই দক্ষ স্বৈরাচারী চাল৷ ফলে ইতিমধ্যেই লাদাখে তুষারপাত কমেছে, বৃষ্টিপাত ও ধস নামা বেড়েছে৷ অবিলম্বে না আটকালে গোটা দেশটাকেই তাঁরা ক্রমে ঘূণের মতো ভেতর থেকে ঝাঁঝরা করে দেবে৷

সোনম ওয়াংচুক নিজে একজন পরিবেশবিদ হলেও তাঁর বাবা সোনম ওয়াঙ্গিয়াল ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ৷ তিনিও লাদাখের স্বার্থে আমরণ অনশন করেছিলেন, ১৪ দিন অনশনের পর দিল্লি থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে তাঁর দাবিগুলি মেনে নিয়েছিলেন৷ পরে তিনি রাজ্য সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন৷ সোনম ওয়াংচুকও ১৯৮৮ সালে বিটেক পাশ করার পর লাদাখে স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট শুরু করেন৷ একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল সংস্কার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হলে, SECMOL সরকারি শিক্ষা বিভাগ এবং গ্রামের মানুষদের সাহায্যে ‘অপারেশন নিউ হোপ’ চালু করেন৷ ১৯৯৩ সালের জুন মাস থেকে ২০০৫-এর আগস্ট পর্যন্ত তিনি লাদাখের একমাত্র প্রিন্ট ম্যাগাজিন ‘লাদাখস মেলং’ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন৷ ২০০২- এ বেশ কিছু এনজিওকে সঙ্গে নিয়ে লাদাখ স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেন আর ২০০৫ পর্যন্ত এর কার্যনির্বাহী কমিটির সচিব ছিলেন৷ ২০০৭-২০১০, তিনি শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে ভারতের শিক্ষা মন্ত্রককে সাহায্য করে এমন একটি ডেনিশ এনজিও এমএস-এর শিক্ষা উপদেষ্টার কাজ করেছেন৷

২০০৯ সালে তিনি সংবাদ শিরোনামে আসেন, যখন তাঁর কর্মপদ্ধতি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা গল্প অনুসারে তৈরি রাজকুমার হিরওয়ানির ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমাটি জনপ্রিয় হয়৷ তাঁর ছায়ায় তৈরি ফুনসুখ ওয়াংডু চরিত্রে অভিনয় করেন আমির খান৷ তবে সোনম ওয়াংচুক সেই সিনেমা দেখে মুচকি হেসে বলেছেন যে তিনি ফুনসুখ ওয়াংডু নন৷

২০১৩ থেকে লাদাখের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ওয়াংচুক সুদূরপ্রসারী আধুনিক শিক্ষা, পরিবেশ এবং অর্থনীতি সংস্কারের লক্ষ্যে সমস্ত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকে ‘গ্রীন পার্টি লাদাখ’ নামক একটি ব্যানারে এনে ‘নিউ লাদাখ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন৷

সোনম ওয়াংচুক নিজেও নানা শিক্ষা সংস্কার, পর্যটন উন্নয়ন ও বরফের স্তুপ তৈরি করে কৃত্রিম হিমবাহ সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য দেশে ও বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন৷ বিশেষ করে সিকিম ও নেপালের মতো পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সৌর মাটির ভবন নির্মাণের নকশা ও নির্মাণ তদারকিতে সহায়তা করেন যাতে মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস শীতেও সৌরশক্তি চালিত স্কুলগুলি ছাত্রদের উষ্ণ রাখে৷ একই পদ্ধতিতে তিনি সৈনিকদের জন্য সৌরশক্তি চালিত বাসস্থান তৈরি করেন৷ এসব উদ্ভাবনের জন্য তিনি ২০১৮ সালে য়ারমন ম্যাগসেসে পুরস্কার ও সিম্বায়োসিস ইন্টারন্যাশনাল এর সম্মানসূচক ডি লিট সহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন৷

মনে পড়ছে ২০১৫ সালে, যখন একটি বিশাল ভূমিধস জাঁসকরে ফুগতাল নদী অবরুদ্ধ করে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ হ্রদ তৈরি করে ফেলে তখন ওয়াংচুক হ্রদ এবং জল নিষ্কাশনের জন্য একটি সাইফন কৌশল ব্যবহার করা আর নতুন হ্রদের পাশের পাহাড়ে ব্লাস্ট করার পরিবর্তে প্রান্তগুলি নিরাপদে কেটে ফেলার করার প্রস্তাব রেখেছিলেন৷ কিন্ত্ত তখনও প্রশাসন তাঁর পরামর্শ উপেক্ষা করে আর ব্লাস্টিং চালিয়ে যায়৷ ফলে ২০১৫-র ৭মে এই হ্রদের জল থেকে আকস্মিক বন্যায় ১২টি সেতু ভেসে যায়, অনেক এলাকার সর্বনাশ হয়৷

২০১৬ সালে ওয়াংচুক উচ্চ উচ্চতার হিমবাহের হ্রদে দুর্যোগ প্রশমনের জন্য বরফের স্তূপ কৌশল প্রয়োগ করা শুরু করেন৷ ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে উত্তর-পশ্চিম সিকিমের দক্ষিণ লোনাক হ্রদ বিপজ্জনক হয়ে ওঠায় সিকিম সরকার তাঁকে সাইফন কৌশল প্রয়োগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়৷ তখন তিনি ও তাঁর দল বৃষ্টি ও তুষারপাতের মধ্যে দুই সপ্তাহের ক্যাম্প করে, আর অন্যান্য ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত হ্রদটিকে নিরাপদ স্তরে নিষ্কাশনের জন্য একটি সিফনিং সিস্টেমের প্রথম ধাপ ইনস্টল করে আসেন৷ ২০১৬ সালের শেষের দিকে, তাঁর এই ধারণাটি সুইস আল্পস কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ সুইজারল্যান্ডের এনগাদিন উপত্যকার পন্ট্রেসিনার পৌরসভার প্রেসিডেন্ট ওয়াংচুককে তাঁদের শীতকালীন পর্যটন আকর্ষণে বরফের স্তূপ যোগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান৷ সে বছর অক্টোবরে, ওয়াংচুক এবং তাঁর দল সুইস অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে সুইস আল্পসে ইউরোপের প্রথম বরফের স্তুপ নির্মাণ করেন৷ এহেন ব্যক্তি যখন বলছেন যে, আজ কর্পোরেট থাবায় লাদাখের পরিবেশ চরম সঙ্কটের মুখোমুখি তখন সরকারের উচিত তাঁর কথা শোনা৷

৫ আগস্ট ২০১৯-এ যখন জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠন ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সোনম ওয়াংচুক সহ লাদাখ এবং কার্গিলের আপামর জনগণ সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন কারণ তাঁরা এটিকে নিজেদের দীর্ঘদিনের লালিত রাজ্যের দাবির লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ হিসাবে দেখেছিলেন৷ ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে বিজেপি লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভূক্ত করা, লাদাখ ও কার্গিল উপত্যকার জন্য দু’জন সংসদ আসন সৃষ্টির মতো লাদাখের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করে৷ কিন্ত্ত তারপর যখন লাদাখ একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে এবং নিজস্ব বিধানসভা ছাড়াই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়, তখন তাঁদের উৎসাহ কমে যায়৷ ১১ সেপ্টেম্বর২০১৯-এ অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল কমিশন ফর শিডিউলড ট্রাইবস(এনসিএসটি)-এর ১১৯তম সভায় লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়৷ এনসিএসটি এর জন্য চারটি কারণ উল্লেখ করেছে- ক্ষমতার গণতান্ত্রিক হস্তান্তর, এই অঞ্চলের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং প্রচার, জমির উপর কৃষি অধিকারের সুরক্ষা এবং অবশেষে, লাদাখের দ্রুত উন্নয়নের জন্য দ্রুত তহবিল পাঠানোর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা৷

কিন্ত্ত, এই সুপারিশ অনুমোদন না পাওয়ায়, ওয়াংচুককে নিয়ে লাদাখ অ্যাপেক্স বডি এবং কার্গিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স গতবছর থেকে একসঙ্গে আন্দোলন করছে৷ তাঁরা গতবছর ২৬শে জানুয়ারি লাদাখের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি তুলে ধরতে এবং ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে এর সুরক্ষার দাবিতে, খরদুংলা পাসে অনশন আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করেন৷ কিন্ত্ত, কর্তৃপক্ষ ওয়াংচুককে গৃহবন্দী করে বলে যে, মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় খরদুংলা উপবাসের জন্য অনুপযুক্ত৷ পুলিশ তাঁদের HIAL ক্যাম্পাসে আটক করে রাখলে, তাঁরা সেখানেই তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি ও অনশন পালন করেন৷ ৩ ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা লাদাখে সর্বাত্মক হরতাল আর জুনমাসে আবার ‘জলবায়ু উপবাস’ পালন করেন৷

এতেও কোন কাজ না হওয়ায় এবছর ৬ মার্চে ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ (লাদাখের মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশের বেশি) লেহ-তে তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, সংবিধানের ৬ষ্ঠ তফসিল প্রয়োগ করে লাদাখ এবং কার্গিল স্বায়ত্তশাসিত পরিষদকে সাংবিধানিক মর্যাদা, কর আরোপ এবং গ্রাম প্রশাসন এবং বন ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের অনুমতি, পরিবেশ সুরক্ষা, স্থানীয়দের জন্য চাকরি সংরক্ষণ এবং বৌদ্ধ-অধু্যষিত লেহ ও শিয়া-অধু্যষিত কার্গিলের জন্য দু’টি স্বতন্ত্র সংসদীয় আসনের দাবিতে জমায়েত হন৷ আলোচনার টেবিলে কেন্দ্রীয় সরকার অনুচ্ছেদ ৩৭১ অনুসারে বিশেষ বিধানগুলি প্রসারিত করার প্রস্তাব দেয়, কিন্ত্ত ষষ্ঠ তফসিলের দাবি মেনে নেয়নি৷ সেদিন থেকেই সোনম ওয়াংচুক আমরণ অনশন শুরু করেন৷

ঋণাত্মক তাপমানের জীবন ও প্রকৃতিকে সোনম ওয়াংচুক ও তাঁর সঙ্গীরা খুব ভালোভাবে চেনেন৷ সেজন্যই আজ লাদাখের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে সমর্থন করছেন৷ তাঁরা এখনও আশা করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে৷

৬ষ্ঠ তফসিল বা সমতুল কোনও রক্ষাকবচ না থাকলে লাদাখে কর্পোরেট মাফিয়াদের উন্নয়ন শুধু বড়ো বড়ো হোটেল, রিসর্ট আর আট লেনের মহাসড়কপথে সীমাবদ্ধ থাকবে না৷ ভূমিকম্পপ্রবণ লাদাখে বড়ো বড়ো খনি তৈরি করে খনিজ পদার্থ উত্তোলন শুরু করলে ইতিমধ্যেই বিশ্ব উষ্ণায়ণের কুফলে আক্রান্ত পরিবেশ আরও ক্ষতিগ্রস্থ হবে, বিপন্ন হবে তুষার চিতা, তিব্বতি এন্টেলোহ হরিণ, পাহাড়ি ছাগ্ল, ভেড়া, চমরীগাই, পিকা ইঁদুর ও পাহাড়ি মৌমাছি ও প্রজাপতির মতো অসংখ্য বিরল প্রজাতির প্রাণী ও জীববৈচিত্র, ফলে বিপন্ন হবে আমাদের ভবিষ্যৎ৷

সোনম ওয়াংচুক এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারীরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য গান্ধীবাদী পদ্ধতি অনুসরণ করছেন৷ ২১ দিনের অনশনের তৃতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে কোনও সমাধান দেখা যাচ্ছে না দেখে সুভদ্র লাদাখিদের চোয়াল ক্রমে আরও শক্ত হচ্ছে৷ তাই আক্ষরিক এবং রূপক উভয় অর্থেই ভারতের মুকুট লাদাখের আপামর জনগণের উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে সদর্থক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককেই নিতে হবে৷