প্রবীর ঘোষাল
গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় ‘বিশ্বগুরু’ কি মুখ থুবড়ে পড়েছেন? গত সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে জি-২০ সামিটে কীর্তনিয়ার দল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে বেজায় ঢাকঢোল পিটিয়ে তুলে ধরেছিল৷ কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই প্রথম দেশে জি-সামিটের আয়োজন হয়েছিল৷ মোদিজি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের এক বিস্ময় সৃষ্টিকারী কর্ণধার, এমনটাই ছিল প্রচারের মূল সুর৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রের প্রতিভূরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসে হাসিমুখে ছবি তুলেছিলেন৷ বাহবাও দিয়েছিলেন তাঁকে৷ প্রশংসা ছিল দক্ষ প্রশাসক হিসেবেও৷
কিন্ত্ত ১৪০ কোটি মানুষের দেশে সাধারণ নির্বাচন আসতেই ‘বিশ্বগুরু’র সেই মুখোশ খুলে পড়েছে৷ আসলে মোদিজির নেতৃত্বে ভারতবর্ষে যে ‘অলিখিত জরুরি অবস্থা’ চলছে, সেটা টের পেয়ে গিয়েছে সারা বিশ্ব৷ আলো ঝলমলে, চোখ ধাঁধানো জি-সামিটের নেপথ্যে যে নিগূঢ় অন্ধকার রয়েছে, সেটাই যেন বে-আব্রু হয়ে পড়েছে৷ গণতন্ত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই৷ রাজনৈতিক হিসাবে বিরোধী শক্তিকে দমনপীড়নের ক্ষেত্রে উলঙ্গ হয়ে গিয়েছে দেশের শাসককুল৷ এটা সকলে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে৷
কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়াই নয়, একের পর এক বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র মুখ্যমন্ত্রীদের জেলে পাঠানো হচ্ছে৷ ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেনের পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ আর এই ঘটনাই গোটা দুনিয়ায় নিন্দার ঝড় তুলেছে৷ মোদির মুখ পুড়েছে৷ আমেরিকা, জার্মানির মতো দেশ বিজেপি সরকারের এই ধরনের স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে৷ তাতে বিপাকে পড়ে গিয়েছে পদ্ম শিবির৷ রাজনৈতিক মহলের খবর হল, ভোটের মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের এই ‘বাড়াবাড়ি’ নিয়ে ক্ষুব্ধ বিজেপির নিয়ন্ত্রক সংঘ পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও৷
তারা মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতি আসন্ন ভোটের আসরে দলের ভাবমূর্তি মলিন করছে৷ শুধুমাত্র ২ জন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতারই নয়, রোজ বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রী, এমনকি নির্বাচনের প্রার্থীদেরও ছেড়ে কথা বলছে না কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি৷ তাঁদের বাড়ি-অফিসে তল্লাশি চলছে৷ ডেকে পাঠানো হচ্ছে৷ ভারতবর্ষে এই ঘটনা নজিরবিহীন৷ গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ একবাক্যে স্বীকার করছেন, এ যেন স্বৈরাচারী শাসনের চরম নিদর্শন৷
১৮০টি দেশের মধ্যে গণতন্ত্রের বিচারে ভারত ছিল ১৬১ স্থানে৷ সেটা এখন শোচনীয় হয়ে নেমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮৷ আর গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা৷ মোদিজির রাজত্বে সেই প্রশ্নে দেশ এখন ১১১তম স্থানে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে৷ মুশকিলটা হল, রাজা যে উলঙ্গ, সেটা ক্ষমতার মোহে আাচ্ছন্ন বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে কেউই প্রকাশ্যে বলতে সাহস পাচ্ছেন না৷ তাঁরা ভয়েই তটস্থ৷ অপ্রিয় সত্য কথা বললে গর্দান যাওয়ার আতঙ্ক!
‘ইস বার চারশো পার’— স্লোগানের স্রষ্টারা জনতা-জনার্দনকে এত ভয় পাচ্ছেন কেন? বিজেপির মধ্যেই বলাবলি হচ্ছে, ১০ বচরের রাজত্বে মোদিজি অ্যান্ড কোম্পানি মানুষের কাছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের যেসব সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কোনওটাই পালন করতে পারেননি৷ ক্ষমতায় আসার আগে আম আদমিকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, দিল্লির মসনদ দখলে আসলে, গেরুয়া শিবিরের লক্ষ্যই হবে, সাধারণের জন্য রোটি-কাপড়া-মাকানের ব্যবস্থা করা! আর এখন সেসব কথা ভুলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাদের মুখে শোনা যায় না৷ তাই গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করে এগোতে চাইছে দেশের শাসক দল৷ এই সত্যটা এখন কেবল দেশে নয়, বিদেশের কাছেও ধরা পড়ে গিয়েছে৷