সমাজ বসু
সাবান দিয়ে ভালো করে হাতদুটো ধুয়ে ফেললো দিবাকর৷ ছুটির আগে এটা নিয়মমাফিক কাজ৷ আজ শনিবার৷ সাপ্তাহিক বেতনের দিন৷ সপ্তাহের শেষে টাকাটা পেলে ভালোই লাগে৷ সারা মাস অপেক্ষা করতে হয় না৷ নিয়মটা মালিক বিজয় মজুমদারই স্থির করেছেন৷ সে ছাড়া আরো দুজন কর্মচারী আছে৷ আজ বেতন নিয়ে সবারই চারটেয় ছুটি৷
টাকাটা মানিব্যাগে ভরতে গিয়ে এক টুকরো কাগজে চোখ পড়ল দিবাকরের৷ কাগজটা বের করে নিলো৷ ছেলেটা রাতে শোবার আগে লিখে জামার পকেটে ভরে দিয়েছে৷ কাল দোল৷ আমার জন্য বড় একটা পিচকিরি আনবে৷ ভুলে যেও না কিন্ত্ত৷ মনে মনে হেসে ফেলে দিবাকর৷ ছেলেও জানে তার ভুলো মনের কথা৷
পেট্রল ডিজেলের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি৷ তাই রাস্তায় বাসের সংখ্যা কম৷ ঠায় দাঁডি়য়ে থাকে এসডি ফোর বাসের অপেক্ষায়৷ কিছুক্ষণ পর তার বাস এলো৷ বাসটায় গেটের কাছে সামান্য ভীড়৷ ভেতরটা ফাঁকাই৷ এখন বেশি ভীডে়ও ভয়৷ তবু উঠে পড়ল৷
বুকপকেট থেকে দশটা টাকা বের করে টিকিট কেটে নিলো দিবাকর৷ প্রাইভেট বাসের এই এক রোগ৷ চালাবার নাম নেই৷ প্যাসেঞ্জার তুলছে তো তুলছেই৷ আধ ঘন্টার রাস্তা এক ঘন্টায় শেষ হলো৷
মানিব্যাগটা নিয়ে অগাধ জলে পড়লো কাতুন৷ মানিব্যাগ খুলতেই বাঁ দিকে একটা ছোট্ট ছেলের ছবি৷ তারই ছেলের বয়সী হবে৷ ছেলেটাই একটা টুকরো কাগজে বাবাকে পিচকিরি আনার কথা লিখে দিয়েছে৷ বাসে ওঠার মুখেই ব্যাগটা প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে তুলে নিয়েছে৷ ভদ্রলোক ঘুণাক্ষরেও টের পাননি৷ কাতুনের মনে হলো, টের পেলে ভালোই হতো৷ হয়ত গালিগালাজ আর মার পড়তো৷ কিন্ত্ত এইরকম বিবেকের দংশন থেকে তো রেহাই পেতো৷ ভদ্রলোকের মুখটা ভেসে ওঠে তার চোখে৷ ছেলেটাকে মুখ দেখাবে কোন্ লজ্জায়? পরক্ষণেই নিজের ছেলের কথা মনে পডে়৷ সেও বারবার বলেছে, একটা পিচকিরি নিয়ে এসো৷
অনেকক্ষণ হাতড়ানোর পর নাম ঠিকানা লেখা একটা কাগজ খুঁজে পেলো কাতুন৷ কিছুটা স্বস্তি পেলো সে৷ মানিব্যাগের টাকায় একজোড়া ভালো পিচকিরি কিনে পাঠকপাড়ার বাসে উঠে পড়লো কাতুন৷
বাস থেকে নেমে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর চব্বিশ নম্বর বাডি়তে পৌঁছে গেলো সে৷
দরজা খুলতেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি৷
— আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না৷
— আপনি আমায় চিনবেন না৷ আমি কাতুন রায়৷ গোবিন্দ নস্কর রোডেই থাকি৷ আপনিই তো দিবাকর মান্না৷
— কি ব্যাপার? কেন এসেছেন বলুন৷
— না, আমার একটা প্রয়োজনে এসেছি৷ আসলে আমার ছেলে আর আপনার ছেলে খুব ভালো বন্ধু৷ একই ক্লাসে, একই সেকশনে পডে়৷ ছেলেটাই গল্প করে৷ আপনার ছেলে নাকি তাকে প্রায়ই ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়৷ কাল ওর জন্মদিন তার ওপর দোল৷ তাই সে তার বন্ধুর জন্য এই উপহার পাঠিয়েছে৷ এই বলে একটা সুদৃশ্য রঙিন পিচকিরি তুলে দেয় দিবাকর মান্নার হাতে৷
পিচকিরির নাম শুনতেই দিবাকরের ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে৷ বাবাই পিচকিরিটা তুলে দেয় ছেলের হাতে৷
— তোর বন্ধু কাল তার জন্মদিনের উপহার পাঠিয়েছে৷
— কি সুন্দর পিচকিরিটা৷ আঙ্কেল, সোহমকে বোলো আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷ আমি খুব খুশি হয়েছি৷ কাতুন বুঝল, এই ছোট্ট ছেলেটার প্রিয় বন্ধুর নাম সোহম৷
— তোমার পছন্দ হলে সোহমও খুশি হবে৷ কাল এটা দিয়ে হৈ হৈ করে রঙ খেলবে, কেমন! ধরা পড়ার ভয়ে কাতুন আর দাঁড়াতেই চায় না৷
— এবার আমি চলি, দিবাকর বাবু৷ আমার ছেলেটাও আবার পিচকিরির অপেক্ষায় বসে আছে৷ দোল তো ওদেরই৷ ওরাই তো মজা করবে৷ তাই না?
— একদিন ছেলেকে নিয়ে আসবেন৷ বাডি় তো চিনেই গেলেন৷
— হ্যা, নিশ্চয়ই আসব৷
রাস্তায় পা রেখে পাখির পালকের মত এক নরম সুখে কাতুনের মনটা ভরে গেল৷ আগাগোড়া নিজেকে মিথ্যের মোড়কে রেখে সে আর এক বাবার সম্মান রেখে গেল৷ তাঁর মনে হলো, কাল সকালে দোলের রঙ আরো রঙিন হবে৷ তারই মত ছেলের সঙ্গে রঙখেলায় মেতে উঠবে আর এক বাবাও৷ একজন মানুষের টাকা হারানোর দুঃখ কিছুটা হলেও কমবে৷
আগামীকাল দোল পূর্ণিমা৷ আকাশটা জোছনায় ভেসে যাচ্ছে৷ ঝলমলে আকাশে চোখ রাখে কাতুন৷ মনে মনে বলে, হে ঈশ্বর যতই কঠিন সময় আসুক আমি যেন তোমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি৷ আদর্শ থেকে সরে না আসি৷