• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

ছায়াবিচার বা কল্পবিচার

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ ১০ বছর কারাবাসের পরে মাওবাদী কমিউনিস্ট বলে কথিত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ৮০% বিকলাঙ্গ জি এম সাইবাবাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ গত ৫ মার্চ৷ এর পরে হয়ত মামলা সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়াবে৷ কিন্ত্ত মুক্তি পেলেও কি স্বস্তিতে থাকবেন গণতন্ত্রের এই নাগরিক? ছায়াবিচার চলতে থাকবে৷ ব্রিটিশ আমলের দেশদ্রোহিতার

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

দীর্ঘ ১০ বছর কারাবাসের পরে মাওবাদী কমিউনিস্ট বলে কথিত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ৮০% বিকলাঙ্গ জি এম সাইবাবাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ গত ৫ মার্চ৷ এর পরে হয়ত মামলা সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়াবে৷ কিন্ত্ত মুক্তি পেলেও কি স্বস্তিতে থাকবেন গণতন্ত্রের এই নাগরিক? ছায়াবিচার চলতে থাকবে৷ ব্রিটিশ আমলের দেশদ্রোহিতার আইন এখনও বলবত আছে এবং স্বাধীনতার পরেও তার অপব্যবহার করে চলেছে স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সমস্ত নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার৷ আইনানুযায়ী পদক্ষেপের পাশাপাশি চলতে থাকে ছায়াবিচার৷ এই ছায়াবিচার লক্ষ্য-ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ফোনে হুমকি দিয়ে, পরিবারের লোককে হেনস্থা করে বা সামাজিক মাধ্যম সহ সমস্ত মাধ্যমের সাহায্যে অপপ্রচার করে চলতে থাকে৷

গত ৬ মার্চের এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সাইবাবা নাকি মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অনুরাধা গান্ধির (সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে অনুরাধা ধান্ডে) নামে এক প্যানেল তৈরি করে খবরের শিরোনামে আসেন৷ এইবার একটু নিজের কথায় আসি৷ আমি অনুরাধা গান্ধি সম্বন্ধে জানতে পারি সাংবাদিক-লেখক রাহুল পন্ডিতা’র লেখা ‘হেলো বস্তার’ গ্রন্থে৷ এক বর্ণময় চরিত্র, যিনি মাওবাদীর পরিচয় ছাড়াও বিশেষভাবে খ্যাত ছিলেন মহারাষ্ট্রের খরাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এবং নাগপুর লাগোয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনে এক মুখ্য ভূমিকা নেওয়ার জন্য৷ তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য পরিচিতি এক নারীবাদী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে৷ তাঁর লেখা সংকলন গ্রন্থ ‘স্ক্রিপ্টিং দি চেঞ্জ’ (মৃতু্যর পরে প্রকাশিত) নারীবাদের উপর এক অসাধারণ গ্রন্থ যা বিদেশ থেকেও প্রকাশিত হয়েছে৷ কিন্ত্ত কায়েমি স্বার্থের কাছে তিনি পরিচিত একমাত্র মাওবাদী রূপে এবং তাঁর সঙ্গে কোনও সংস্রব থাকা মানে দেশদ্রোহিতা৷ তাই ঘটেছে সাইবাবার ক্ষেত্রে৷ অনুরাধার নামে প্যানেল প্রসঙ্গে আমি বলতে পারি যে, অনুরাধা প্রায় বিনা চিকিৎসায় ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ায় মারা যান ২০০৮ সালের ১২ এপ্রিল৷ তাঁর মৃতু্যর পরে দিল্লি জেএনইউ-তে ‘কমরেড অনুরাধা মেমোরিয়াল কমিটি’ প্রতিষ্ঠা হয় এবং সেই কমিটির তরফ থেকে একটি স্মারক পুস্তিকা ‘রিমেম্বারিং কমরেড অনুরাধা’৷ ‘রিমেম্বারিং এ বিউটিফুল লাইফ’ প্রকাশ করা হয় ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট৷ প্রকাশক হিসেবে নাম দেওয়া আছে জেএনইউ-এর ‘স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড এস্থেটিকস’-এর অধ্যাপক এইচ এস শিবপ্রকাশ-এর৷ কমিটির সদস্যদের মধ্যে সাইবাবার নাম নেই৷ তিনি এর পরে জেএনইউ-এ আসেন এবং ২০১৩ সালে সেখান থেকে পিএইচডি পান৷ এক মৃত ব্যক্তির সঙ্গে এইরকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যোগাযোগের ঘটনা বা তাঁর নামে কুৎসা ছড়ানো নতুন নয়৷ নতুন করে কোনও প্যানেল একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করার কোনও প্রশ্ন আসে না৷ দ্বিতীয় অভিযোগ তিনি ২০১০ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরাধার স্মৃতিতে এক বক্তৃতার আয়োজন করেন৷ যেখানে একটি স্মৃতি কমিটিই রয়েছে সেখানে এককভাবে তিনি কীভাবে অভিযুক্ত হন৷

এর পরে আসি কয়েক মাস আগে ঘটা এক কাহিনিতে৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা অভিযোগ আনেন যে, মৃত প্রত্নতাত্ত্বিক ভেরিয়ার এলউইন উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে বিশেষ ভূমিকা নেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরু৷ আসল ঘটনা বলার আগেই জানাই যে, এই ভেরিয়ার এলউইন সম্বন্ধে আমি জানতে পারি রামচন্দ্র গুহ-র লেখা ‘স্যাভেজিং দি সিভিলাইজড’ গ্রন্থ থেকে৷ পরে আমি এই ব্যক্তির সম্বন্ধে অনুসন্ধান করি৷ ব্রিটিশ এই প্রত্নতাত্ত্বিক ভারতে ১৯২৭ সালে ‘খ্রিস্ট সেবা সংঘ’-এর হয়ে কাজ করতে এসে বস্তার অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে গবেষণামূলক কাজ করেন এবং তার পাশাপাশি বন্ধু শামরাও হিভালের সহযোগিতায় আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষামূলক এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজে নিজেকে নিবেদিত করেন৷ দীর্ঘ প্রায় দুই দশক আদিবাসীদের মধে কাজ করে তিনি অনেক উপজাতিদের লোকসংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবন বিষয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচনা করেন৷ নির্বিঘ্নে কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি পরিবারের সঙ্গে সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন করেন এবং খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করেন আনুষ্ঠানিকভাবে৷ তখনও তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে যাননি৷

স্বাধীনতালাভের পরে অধুনা অরুণাচল রাজ্যের অসংখ্য উপজাতিকে সংহত করতে তাঁকে সেই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন নেহরু৷ কিন্ত্ত কার্যত সেখানে ভেরিয়ার প্রশাসনিক কাজেও বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন৷ দেশত্যাগের আগে শেষ তিন দশক ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে প্রশাসনিক অধিকার কায়েম করার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্ত্ত সেই কাজ অসমাপ্ত ছিল৷ বস্ত্তত, এই অঞ্চল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে দক্ষিণ তিব্বতের অধীনে থাকলেও, তিব্বতি প্রশাসন লক্ষ্যণীয় ছিল না৷

তবে ব্যবসায়িক এবং সাংস্কৃতিক লেনদেন ছিল তিব্বতেরই সঙ্গে৷ এই অঞ্চলের অসংখ্য উপজাতির মধ্যে সংহতি আনেন ভেরিয়াল এলউইন৷ এই উদ্দেশ্যে তাঁর পরামর্শে নেহরু ‘ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ফ্রন্টিয়ার সার্ভিস’ গঠন করেন এবং এদের হাত ধরেই তাওয়াং মঠের অধিকার ভারতের হাতে চলে আসে৷ চিন স্বাধীন হওয়ার আগেই এই কাজ সম্পন্ন করার ফলে অরুণাচলের উপর চিনের দাবি জোরালো হতে পারছে না৷ বস্ত্তত ‘নেফা’র কারিগর রূপে ভেরিয়ারকে অভিহিত করা হয়৷ এই অঞ্চলে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন উপজাতির সংস্কৃতি সংকলিত করে ভেরিয়ার ১৯৫৭ সালে প্রকাশ করেন তাঁর গ্রন্থ ‘এ ফিলসফি ফর নেফা’৷ এতে এক সৎ দায়িত্ববান মানুষ হিসাবে এই অঞ্চলের উপজাতি মানুষের বিষয়ে তাঁর গভীর উপলব্ধি লিপিবদ্ধ আছে, যা এখনও অরুণাচলের প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে এক নীতিনির্দেশিকা হিসাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে৷

ভেরিয়ারের জীবন এবং কর্মকাণ্ডের সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেল তা থেকে কি তাঁর বিরুদ্ধে নেহরুর সাহায্য নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের উপজাতিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ আরোপ করা যায়, যিনি অনেক আগেই খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করেছেন? বরং ভেরিয়ার নেফা অঞ্চলের আদিবাসীদের নিবিড়ভাবে সংহত করেছিলেন বলেই উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে একমাত্র অরুণাচল প্রদেশে জঙ্গিবাদ তুলনামূলকভাবে কম৷

ভেরিয়ার এলউইন এবং অনুরাধা গান্ধি দুজনেই বস্তার এলাকায় থেকেছিলেন জীবনের কিছুকাল, ভিন্ন উদ্দেশ্যে৷ তাই এই দুই চরিত্র নিয়ে আমি ‘বস্তার পথিক ঃ ভেরিয়ার এলউইন এবং অনুরাধা গান্ধি’ গ্রন্থ লিখি ২০২২ সালে৷ সেই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন অনুরাধার স্বামী কোবাদ গান্ধি৷ তিনিও এক মাওবাদী মার্কসবাদী ছিলেন এবং স্ত্রীর মৃতু্যর পরে তিহার জেলে ১০ বছর কারাবাসের পরে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পান৷ কারাবাসের কাহিনি সম্বলিত তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘ফ্রাকচারড ফ্রিডম’ বহুল সমাদৃত৷ আমার গ্রন্থ লিখতে গিয়ে আমি ভেরিয়ার এলউইন সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য পেলেও অনুরাধা গান্ধির সম্বন্ধে বিশদ তথ্য পাইনি৷ পেতে পারতাম স্বামী বা তাঁর ভাই মুম্বইয়ের বিখ্যাত নাট্যকার নাট্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সুনীল শানবাদের কাছ থেকে৷ কিন্ত্ত কোবাদ গান্ধি আমাকে ভূমিকা লিখে দিলেও অনুরাধার সম্বন্ধে জানতে চাইলে মেইলে আমাকে লেখেন— ‘…the media conducted a media trial against me.’ তাই আমি কোবাদ বা সুনীলের কাছ থেকে বিশদ তথ্য পাইনি৷ অতএব বুঝতে পারছেন ‘মাধ্যম-প্রণোদিত বিচার’ সম্পর্কে, যার ভয় তখনও কোবাদের মনে আছে৷

সাইবাবার বিরুদ্ধেও এমন উদাহরণ আমি পেয়েছি৷ মৃতু্যর পরেও অনুরাধা গান্ধির নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে৷ সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ২৬ আগস্ট ২০২০ পোস্ট করা হয়েছে ঃ Free Professor G.N. Saibaba৷ (১) কে বা কারা এই পোস্ট করছেন? স্বামী জীবিত থাকতে অনুরাধা বা সাইবাবার অনুগামীরা এই কাজ করতে পারেন না বিশেষ করে যখন অনুরাধার সঙ্গে সাইবাবার সম্পর্ক সাইবাবার বিরুদ্ধে অভিযোগের একটি অংশ৷ আর সরকার পক্ষ কি এই ধরনের পোস্টের বিরুদ্ধে চুপ থাকবে, যেখানে ‘ডিজিটাল পারসোনাল ডাটা প্রোটেকশন বিল ২০২২’-এর মতো ভয়ঙ্কর আইন কিছুকাল আগে চালু করেছে সরকার৷ তাই বিচার চলাকালীন এবং বিচারের বাইরে, জীবিত থাকাকালীন বা মৃতু্যর পরেও বিশেষভাবে কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছায়াবিচার চলতে থাকবে৷ নাহলে নিও-গণতন্ত্র টিকবে কী করে?