• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

পুণ্যতীর্থ সোমসার

প্রীতম সেনগুপ্ত সোমসার৷ বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত এক প্রত্যন্ত গ্রাম৷ সারা পশ্চিমবাংলায় এমন অনেক গ্রামই রয়েছে৷ কিন্ত্ত সোমসারকে সেই অর্থে গতানুগতিক একটি গ্রাম ভাবলে ভুল হবে৷ গ্রামটিতে রয়েছে সোমেশ্বর শিব মন্দির৷ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা  দামোদর নদের একেবারে পাশে৷ এই সোমেশ্বর শিবের নাম অনুসারেই এই গ্রামের নাম সোমসার৷ রয়েছে চাঁদপাল বণিকের প্রাসাদোপম অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ৷ উল্লেখ্য

প্রীতম সেনগুপ্ত
সোমসার৷ বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত এক প্রত্যন্ত গ্রাম৷ সারা পশ্চিমবাংলায় এমন অনেক গ্রামই রয়েছে৷ কিন্ত্ত সোমসারকে সেই অর্থে গতানুগতিক একটি গ্রাম ভাবলে ভুল হবে৷ গ্রামটিতে রয়েছে সোমেশ্বর শিব মন্দির৷ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা  দামোদর নদের একেবারে পাশে৷ এই সোমেশ্বর শিবের নাম অনুসারেই এই গ্রামের নাম সোমসার৷ রয়েছে চাঁদপাল বণিকের প্রাসাদোপম অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ৷ উল্লেখ্য এই চাঁদপাল বণিকের নামানুসারেই কলকাতায় গঙ্গার চাঁদপাল ঘাট৷
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই গ্রাম রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বাদশ সঙ্ঘগুরু স্বামী ভূতেশানন্দজীর জন্মস্থান হিসেবে৷ এইখানেই রয়েছে তাঁর জন্মভিটা৷ আর এই স্থানটিতেই বর্তমানে অতি মনোরম পরিবেশে গডে় উঠেছে রামকৃষ্ণ মিশন, যেটির বেলুড় মঠের অধীনস্থ কেন্দ্র রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে৷ এই গডে় ওঠার বিষয়ে কিছু কথা বললেন এই মিশনের বর্তমান অধ্যক্ষ পূজনীয় স্বামী অমলাত্মানন্দজী মহারাজ৷ মহারাজ জানান, ‘রামকৃষ্ণ মঠ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের দ্বাদশ অধ্যক্ষ স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজের পুণ্য জন্মস্থান এটি৷ যখন মহারাজ সঙ্ঘাধ্যক্ষ হন, তখন তাঁর জীবনপঞ্জী খবরের কাগজে বেরিয়েছিল৷ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ইত্যাদি৷ সেইসময় মহারাজের প্রিয় শিষ্য ও অনুরাগীবৃন্দ সোমসার বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পডে়ন৷ এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ডা: গৌর দাস৷ অকৃতদার এই মানুষটি পেশায় একজন চিকিৎসক৷ মহারাজ জীবিত থাকাকালীন এখানে ডা: দাস আসতে শুরু করেন৷ স্বয়ং মহারাজও এখানে একবার আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন৷ দশ বছর বয়সে এখান থেকে কলকাতায় চলে যান, তারপর কখনও আর আসেন নি৷ পূজ্যপাদ মহারাজের কিন্ত্ত এখানে আর আসা হয়ে ওঠেনি৷ মহারাজের শরীর চলে যায় ১৯৯৮ সালের অগাস্ট মাসে৷ সেই বছরেই পূজনীয় স্বামী গহনানন্দজী মহারাজ, সঙ্ঘের তৎকালীন অন্যতম সহ সঙ্ঘাধ্যক্ষ, এখানে এসে মহারাজের জন্মস্থানের উপরে একটি টিনের চালাতে মন্দির স্থাপন করেন৷ ভূতেশানন্দজী ছিলেন উচ্চকোটির সাধু, তাঁর আধ্যাত্মিকতার প্রভাবে ডা: গৌর দাসসহ আরও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা মহারাজের অনুগামী ও শিষ্য ছিলেন, আস্তে আস্তে এখানকার উন্নয়ন ঘটাতে থাকলেন৷ প্রথমে পূজনীয় মহারাজের পূর্বপুরুষের পরিবারের লোকজনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন অর্থ প্রদান করে৷ এরপর দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে শুরু করে কোচিং সেন্টার ইত্যাদি বিভিন্ন পরিষেবা দানে সচেষ্ট হন৷ এখানকার শিশুদের কীভাবে পুষ্টি দেওয়া যায়, গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো সেইসব বিষয়ে তাঁরা বিশেষভাবে প্রয়াসী হন৷ এইভাবেই শুরু হল৷
সেই ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২১ সাল অবধি তাঁরা কলকাতা থেকে এসে এই আশ্রমটি পরিচালনা করেছেন এবং বিভিন্নভাবে মানুষকে পরিষেবা দিয়েছেন৷ ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর ডা: গৌর দাসসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আশ্রমটি বেলুড় মঠকে হস্তান্তর করেন৷ বেলুড় মঠ এটি অধিগ্রহণ করে রামকৃষ্ণ মিশন সোমাসারে রূপান্তরিত করে৷ সেইসময় উপস্থিত ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম সহাধ্যক্ষ পূজনীয় শ্রীমৎ স্বামী গৌতমানন্দজী মহারাজ৷ গৌতমানন্দজী মহারাজ কর্তৃক এই বিষয় সম্পর্কিত দলিল সমূহ ডা: গৌর দাস আমার হাতে সমর্পণ করেন৷ রামকৃষ্ণ মিশনের নানা অ্যাক্টিভিটিজ শুরু হয়ে যায় এরপরে৷ অর্থাৎ একুশ সালের পর থেকেই আশ্রমের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলছে৷ প্রাইভেট আর অ্যাফিলিয়েটেডের মধ্যে অনেক তফাত৷ অনেক লিটিগেশন ছিল৷ এছাড়া সবগুলো নাম ট্রান্সফার করা, মিউটেশন করা এসব কাজও করতে হয়েছে সুষ্ঠুভাবে৷ আগে অফিস ছিল না, মঙ্কস কোয়ার্টার বলতে কয়েকটি মাত্র ঘর ছিল৷ জেনারেটর বসানোর কাজ হয়েছে, তারপরে ডাইনিং হলের কাজ৷ এখন বুক সেলসের কাজ চলছে, যা এখনও পর্যন্ত একটাও নেই৷ দুটো ইউনিটে আমাদের একটি কোচিং সেন্টার চলছে, ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর, যেখানে ১১৬ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে৷ এদের মধ্যে প্রায় চল্লিশ শতাংশ মুসলিম৷ এদের যাবতীয় যা কিছু প্রয়োজনীয় আমরা দিয়ে থাকি৷ জামাকাপড় থেকে শুরু করে স্টেশনারি সমস্ত কিছু, খাওয়াদাওয়া, পুজোর সময় পুজোর পোশাক, জুতো, ছাতা ইত্যাদি সবকিছুই আমরা দিই৷ এরজন্য বারো লক্ষ টাকা খরচ করি৷ এইসব ছেলেমেয়েদের ঠাকুর-মা-স্বামীজীর আদর্শে তৈরি করা হচ্ছে৷ এদের মধ্যে কয়েকজনও যদি দাঁডি়য়ে যায় তাহলে সমাজের, দেশের মঙ্গল৷
এছাড়া আমাদের দাতব্য চিকিৎসালয় আছে, এর একটা অসুবিধা হচ্ছে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল৷ এখানে গ্রামে আশেপাশে সেরকম ভালো ডাক্তার নেই৷ বর্ধমান থেকে অথবা কলকাতা থেকে নিয়ে আসি৷ নিয়ে এসে ক্যাম্প করাই, মাসে তিন-চারটে ক্যাম্প হয়৷ এখানে নিতাই প্রামাণিক নামে খুব ভালো একজন ডাক্তার আছেন, তিনি আসতে শুরু করেছেন৷ এক্স-রে, প্যাথলজি, ডেন্টাল বিভাগ আছে৷ কিন্ত্ত ডাক্তারের অভাবে পরিষেবা ধীর গতিতে চলছে৷ চেষ্টা থাকলেই তা ঠিক হয়ে যাবে আশা করি৷
একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করার যে ইন্দাসে আমাদের একটি নতুন সাব-সেন্টার হল সম্প্রতি৷ লীলাপ্রসঙ্গে উল্লিখিত গৌরী পণ্ডিতের ভিটায়৷ গৌরী পণ্ডিত বিরাট পণ্ডিত ছিলেন৷ রানি রাসমণির জামাই মথুরবাবু একবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন সব নামী পণ্ডিতদের ডেকে রামকৃষ্ণদেবকে (যাকে তিনি বাবা বলতেন) অবতার হিসেবে প্রচার করার৷ সেই উদ্দেশ্যে তিনি গৌরী পণ্ডিতকে চিঠি দিলেন – ‘আপনি আসুন৷ শুনেছি আপনি একজন বড় শাস্ত্রজ্ঞ, আপনি এসে সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের লক্ষণ দেখে তাঁকে অবতার বলে প্রচার করুন৷ শুধু অবতার নয় পুরুষ অবতার বরিষ্ঠ৷’ গৌরী পণ্ডিত আসেন এবং রামকৃষ্ণদেবকে দেখে তাঁকে বলেন, ‘আপনি অবতার নন, আপনি অবতারের উৎস৷ আপনার থেকেই সব অবতারের উদ্ভব৷’ গৌরী পণ্ডিতের সিদ্ধাই ছিল, তিনি বাঁ হাতে এক মণ কাঠ রেখে হোম করতে পারতেন৷ স্ত্রীকে জগদম্বা জ্ঞানে পূজা করতেন৷ দুর্গাপূজা করতেন৷ বড় সাধক ছিলেন৷ সিদ্ধাইয়ের বলে যখন যেখানে যেতেন ‘হা রে রে রে নিরালম্ব লম্বোদর…’ বলে এমন হুঙ্কার দিতেন যে সকলে কেঁচো হয়ে যেত৷ একবার দক্ষিণেশ্বরে এইরকম হুঙ্কার দিতে দিতে প্রবেশ করছেন, ঠাকুরও সেইরকম জোরে ‘হা রে রে রে নিরালম্ব লম্বোদর…’ বলে হুঙ্কার দিলেন৷ লোকজন ভাবল বুঝি ডাকাত পডে়ছে৷ তাড়াতাডি় সেখানে লাঠি নিয়ে ছুটে এসে দেখে এই অবস্থা! আসলে ঠাকুর তাঁর সিদ্ধাইটিকে নিয়ে নিলেন৷ শোনা যায় এরপর একবার গৌরী পণ্ডিত এসেছিলেন৷ তারপর তাঁকে আর পাওয়া যায় নি৷ তপস্যায় চলে যান৷ ইন্দাসে এই নবগঠিত সেন্টারে উন্নয়নের চেষ্টা চলছে৷ এর মাধ্যমে ভাবপ্রচার আরও প্রসারিত হবে৷ আমাদের প্রয়োজন ফাইনান্স৷ ঠাকুরের কাজ, নিশ্চয়ই এসে যাবে৷’
সোমসারে রয়েছে মিশনের চমৎকার অতিথি আবাস৷ আগে থেকে বুকিং করে সেখানে থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে নেওয়া যায়৷ পূজ্যপাদ ভূতেশানন্দজী মহারাজের পূর্বাশ্রমের পারিবারিক শিব মন্দির, জগদ্ধাত্রী মণ্ডপ রয়েছে মিশনের এলাকার ভিতরে৷ এছাড়া ভূতেশানন্দজীর ব্যবহূত নানা জিনিসপত্র নিয়ে মন্দিরের পাশে নির্মিত হয়েছে একটি সংগ্রহশালা৷ রয়েছে দু’টি বড় পুকুর৷ আর চমৎকার বাগান, যার সৌন্দর্য বিশেষ করে শীতকালে চাক্ষুষ করা যায়৷ আশ্রমের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ মনে প্রাণে শান্তি বয়ে আনে৷
সোমসার থেকে জয়রামবাটী খুব কাছে৷ গাডি়তে ঘন্টাখানেকের একটু বেশি সময় লাগে৷ যেহেতু জয়রামবাটী-কামারপুকুর পাশাপাশি দুটি জায়গা, ফলে কামারপুকুরও চলে যাওয়া যায়৷ এছাড়া সোমসারে আসেন মানুষ বর্ধমান থেকেও৷ বাসে কিংবা গাডি়তে৷ ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশেষ করে ঠাকুর-মা- স্বামীজীর ভক্ত ও অনুগামীরা অনায়াসেই এখন এই চার পুণ্যস্থানে একইসঙ্গে পরিভ্রমণ করতে পারেন৷ চারটি পুণ্যস্থান হল কামারপুকুর, জয়রামবাটী, ইন্দাস ও সোমসার৷