সম্বুদ্ধ দত্ত
সত্যজিৎ রায়ের আগন্ত্তক সিনেমার উৎপল দত্তর মুখের সেই বিখ্যাত সংলাপ “ কুপমন্ডুক হয়না” আজও আমাকে তাডি়য়ে বেড়ায়৷ মন উতলা হয়ে উঠে৷ কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথায় “ উচাটন মন ঘরে রয়না” গানের লাইনের রেশ ধরেই বেডি়য়ে পড়লাম ঝর্ণার দেশ ঝাড়খণ্ডে৷ ঝাড়খণ্ড মানেই ঝর্ণা, জঙ্গলে মোড়া ছোট ছোট অনুচ্চ পাহাড়৷ বিস্তৃন্ন বনভুমি ভেদ করে উঁচু নিচু ঢেউ খেলিয়ে এগিয়ে চলা পিচের রাস্তা৷ ঠিক যেন সাদা পাডে়র কালো শাডি়৷ আশ্চর্য রকম এখানকার প্রাকৃতি ও পাহাড়গুলো শান্ত ও স্নিগ্ধ ৷ জঙ্গলের বর্মে আচ্ছাদিত৷ হিমালয়ের পর্বত শ্রেনীর মতো ভয়ঙ্কর ও দানবীয় রূপ এখানকার পাহাড় গুলোর মধ্যে নেই৷ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের রৌদ্র যেখানে সোনার বিচ্ছুরণ ঘটায়৷ সেখানে ছোটনাগপুরের মালভূমির রৌদ্র বিভূতিভূষণের বর্ণানার ঝাঁঝালো তামাটে৷ তবুও ছোটনাগপুরের মালভূমির আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন৷ ঝর্ণা যেন এই অঞ্চলের ঐশ্বর্য ও অলঙ্কার৷ জানা অজানা কত যে ঝর্ণা গোটা ঝাড়খন্ডের জঙ্গল ঘেরা পাহাডে়র অন্তরালে বয়ে চলেছে তার খবর আমরা ক’জনইবা রাখি৷ তবুও স্থানীয় কিছু মানুষের এবং বিশেষ করে দেবাঞ্জন বাবুর ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে অসাধারণ উপস্থাপনা দেখে সম্পুণ অপরিচিত কিছু ঝর্ণা দেখতে পৌঁছে গেলাম ঝাড়খন্ডে৷ সব থেকে অবাক হতে হল হোটেলের মালিক থেকে কর্মচারী এমনকি আমার মুখে শোনা ঝর্ণা গুলোর কথা আমাদের গাডি়র চালকও আগে কখনো শোনেনি জেনে৷ এবং আরও আশ্চর্য বিষয় আমরা এমন কিছু জায়গায় গিয়েছিলাম যেখানে চলমান দুরাভাষ এবং গুগুল মানচিত্রের অস্তিত্ব প্রর্যন্ত ধরা পরেনা৷
আমাদের গন্তব্য ছিল পেড়োয়াঘাঘ,পন্ডাপুন্ডী, পঞ্চঘাঘ ও হিরনী জলপ্রপাত৷ এই সব জলপ্রপাত গুলো খুঁটি জেলার মধ্যে রয়েছে৷
সকাল ৯টায় আমাদের যাত্রা শুরু হল ৷ রাঁচি শহর ছাডি়য়ে গাডি় এগিয়ে চলল খুঁটি জেলার দিকে৷ শহর ছাড়াতেই প্রকৃতির রঙ ও রূপ ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল৷ তপকারা থানা থেকে বাঁদিক গ্রামের রাস্তা ধরে এগোতেই মনে হল এক অন্য জগতে প্রবেশ করতে চলেছি৷ চারিদিকে শুধুই সবুজের সমারোহ৷ ঢেউ খেলানো মসৃন হালকা চড়াই উতরাই রাস্তা অতিক্রম করতে করতে এক সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম ৷ রাস্তার দুদিকেই ঘন শালের জঙ্গল৷ আশেপাশের পাহাড় গুলিও একেবারে ঠাসা জঙ্গলে মোরা৷ ঐ জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে দু’একটি ছোট আদিবাসী গ্রামের দেখা পেলেও একটা সময় পর জনবসতির চিহ্ন প্রর্যন্ত দেখা গেল না৷ একটা জায়গায় এসে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেল৷ এখানে একটা বোর্ডে পেড়োয়াঘাঘ এবং পন্ডাপুন্ডি জলপ্রপাতের দিক নির্দেশ করা রয়েছে৷ বাঁদিকের রাস্তা ধরে পেড়োয়াঘাঘের দিকে চলতে চলতে কখন যে পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছি খেয়াল করিনি৷ আমাদের গাডি় ছাড়া অন্য কোন গাডি় এই পথে দেখতে পেলাম না৷ অপরূপ এই জঙ্গলের শোভা৷ মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভিতর থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছিল৷ চারিদিক জনমানব শূন্য৷ কোথাও ঘন শালের জঙ্গল আবার কোথাও নাম না জানা অজানা অসংখ্য ছোট বড় বৃক্ষরাজি৷ বাতাসে অদ্ভুত মাতাল করা বুনো গন্ধ৷ জঙ্গলের এমন নিস্তব্ধ রূপ আগে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি ৷
এভাবেই চলতে চলতে এক সময় পেড়োয়াঘাঘের গর্জন কানে এলো৷ ঝর্ণার কাছাকাছি আসতেই দেখি বেশ কয়েকটা গাডি় সেখানে দাঁডি়য়ে৷ কয়েক দল স্থানীয় অল্পবয়সী ছেলে – মেয়ে এখানে পিকনিক করতে এসেছে৷ হঠাৎই ঝর্ণার দেখা পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ মন্ত্র মুগ্ধের মত সেদিকে তাকিয়ে রইলাম৷ কারো নদীর স্বচ্ছ জলধারা বিস্তৃন্ন এলাকা জুডে় ছডি়য়ে থাকা বিশাল বিশাল পাথরের উপর থেকে তীব্র বেগে নিচে আঁছডে় পডে় নদীতে বয়ে চলেছে৷ পেড়োয়াঘাঘের চারিদিক জঙ্গলময় পাহাড় দিয়ে ঘেরা৷ পাহাড় , জঙ্গল, ঝর্ণা সব মিলে পেড়োয়াঘাঘের কি অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন৷ মনে হচ্ছিল এক স্বপ্নের জগতে এসেছি৷ এখানকার নজর মিনারের উপর থেকে দূর দূরান্তে তাকলে মন মহিত হয়ে যায়৷ নজর মিনার থেকে নেমে কংক্রিটের সিরি ধরে একেবারে কারো নদীতে পৌঁছে গেলাম৷ শীতের সময় জলের ধারা স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কম৷ স্থানীয় দোকানিরা জানাল বর্ষার সময় এ নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারন করে ৷ বর্ষার গর্ভবতী কারো নদী থেকে সৃষ্টি ঝর্ণা গুলো প্রলয় নৃত্য করতে করতে ছুটে চলে৷ এত সুন্দরের মাঝেও নদীর পাশে চরুইভাতির তান্ডব দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ যেমনি লাউড স্পিকারের তীব্র শব্দ তেমনি চরুইভাতির পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্টর যথেচ্ছ ছড়াছডি়৷ জনবসতিহীন এমন স্নিগ্ধ পরিবেশের এই অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছি৷ জানিনা প্রকৃতি এই অত্যাচার কতদিন সইবে৷ তবে প্রকৃতির উপর এমন অত্যাচার চলতে থাকলে প্রকৃতিও কিন্ত্ত এক সময় প্রত্যাঘ্যাত করবে৷ এটাই কিন্ত্ত ভবিতব্য৷
পেড়োয়াঘাঘের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য পন্ডাপুন্ডীর দিকে রওনা দিলাম৷ পন্ডাপুন্ডীর পথও পেড়োয়াঘাঘের মতোই জঙ্গলাকীর্ণ৷ তবে এখানকার জঙ্গলের ঘনত্ব পেড়োয়াঘাঘের থেকেও বেশি৷ পথে কিছু বাঁদরের দাপাদাপি চোখে পড়ল৷ চোখে পড়ল না জানা বন্য ফুলের বাহার৷ এক সময় পিচের রাস্তা শেষে লাল মাটির পথ শুরু হল৷ আমি নিশ্চিত এমন মাটির পথের দু’ধারের বুনট জঙ্গল যে কোনও মানুষের মনে শিহরন তুলবে৷
পেড়োয়াঘাঘের থেকে পন্ডাপুন্ডী যেতে সময় লাগল আধঘন্টা কাছাকাছি৷ মাটির পথ ধরে কিছুটা এগোতেই জঙ্গল শেষে একটা খাঁদের নিচে নেমে গেলাম৷ মাটির ঢালু পথ ধরে এগতেই বিষ্ময়ের অন্ত রইল না৷ এখানকার ঝর্ণা ও তাঁর পারিপার্শ্বকে প্রকৃতি অন্য সব ঝর্ণা গুলো থেকে সম্পুর্ণ আলাদা৷ পন্ডাপুন্ডী ঝর্ণাও কারো নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে৷ তবে আশ্চর্য ভাবে কারো নদীর এখানকার বিস্তৃন্ন অঞ্চল বালুকাময়৷ এই নদীতটে এলে মনে হয় কোন সমুদ্রতটে এসেছি৷ পন্ডাপুন্ডী ঝর্ণার বিশেষত্ব হল এই ঝর্ণার জলরাশি কিন্ত্ত পাহাডে়র উপর থেকে নিচে আঁছডে় পরছেনা৷ অদ্ভুত ভাবে পাহাডে়র মাঝের সরু একটা ফাঁকা অংশ থেকে দ্রুত বেগে ছুটে বেড়চ্ছে৷ কারো নদীর মাঝে বিশাল বিশাল বিভিন্ন আকারের পাথর নদীতে পডে় আছে৷ এমনই এক বিশাল পাথর দেখলে মনে হয় একটা বিশালাকার জলহস্তী বসে আছে৷
পাহাড়, ঝর্ণা,নদী, জঙ্গল এবং বালুতটের এমন বিরল মেলবন্ধন সম্ভবত ভূভারতে আর কোথাও নেই৷
পন্ডাপুন্ডী থেকে আমরা রওনা ছিলাম পঞ্চঘাঘ জলপ্রপাতের দিকে৷ পঞ্চঘাঘ ঝর্ণা হল বানাই নদীর পাঁচ ধারার সমষ্টি৷ এই ঝর্ণা একেবারে সমতলে বয়ে চলেছে৷ এই ঝর্ণার জলকে এক জায়গায় বেঁধে সুইমিং পুলের আকার দেওয়া হয়েছে৷ বানাই নদীর উপর ছোট ছোট কংক্রিটের সেতু পেরিয়ে চারদিকটা ঘুরতে বেশ লাগে৷
পঞ্চঘাঘে থাকতেই নজরে এল সূর্য পশ্চিম দিক ঢলতে শুরু করেছে৷ সুতরাং এখানে আর সময় নষ্ট না করে রওনা দিলাম এই সফরের শেষ গন্তব্যে, নাম হিরণী ঝর্ণা৷ পঞ্চঘাঘ থেকে হিরণীর দূরত্ব নেহাত কম নয়৷ হিরণীর কথা বলতে গেলে প্রথমেই হিরণীর যাওয়ার পথের কথা আলাদা ভাবে বলতে হয়৷ এই পথে জঙ্গলময় পাহাডে়র একের পর এক বাঁক অতিক্রম করতে করতে চোখ দুটো জুডি়য়ে যায়৷ হিরনীর পথ যেন জঙ্গলে পডে় থাকা কুন্ডলী পাকানো সাপ৷ চারিদিকের অসাধারণ প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে যখন হরণী পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় শেষের দিকে৷ অন্ধকার নেমে এসেছে৷ হিরণীর জলধারা পাহাডে়র বেশ উপর থেকে (১২০ থেকে ১২৫) গভীর খাদে এসে পডে়ছে৷ হিরণীর দুই পাহাডে়র মাঝের সেতুতে দাঁডি়য়ে হিরণীর দৃষ্টিনন্দন রূপ মনে রাখার মতো৷ হিরণী দেখে যখন রাচি শহরের দিকে ফিরছি তখন চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেছে ৷ সঞ্জুদা গাডি়র চালক (আমাদের নিকট আত্মীয় এবং যিনি পেশাদার চালক নয়) বলল, জঙ্গলের রাস্তায় আর দেরি নয় , তাড়াতাডি় ফিরতে হবে৷ সত্যই তো ফিরতে হবে৷ রাত ১০টার ট্রেন ৷
নিকষ কালো অন্ধকারে ঘন জঙ্গলে সাপের কুন্ডলীর মতো পাকানো রাস্তা ধরে রাঁচি শহরে ফিরে এলাম৷ সঙ্গে নিয়ে এলাম অপরিচিত ঝাড়খন্ডের অমূল্য স্মৃতি৷
(পরিশেষে জানাই, এই অপরিচিত ঝর্ণা ও বর্ষাস্নাত সবুজ জঙ্গলের পরিপূর্ণ রূপ দেখতে গেলে আসতে হবে বর্ষা শেষে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে )