সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়
নেপাল ও ভারতের সীমানায় ছোট্ট একটি পাহাডি় জনবসতি টুমলিং — যেখানে সবুজ উপত্যকা, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাঠের ছোট ছোট বাডি়, ছোট্ট মনেস্ট্রি আর নীল আকাশে তুলোর মতো মেঘ… হঠাৎ করে জীবনে নেমে আসা যেন এক মেঘ-পরিদের দেশ৷ মানেভঞ্জন থেকে ৩৬৩৬ মিটার উচ্চতায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু, পাহাড়প্রেমী মানুষের কাছে এক লোভনীয় ডেস্টিনেশন৷ যাঁরা ট্রেকিং পছন্দ করেন, সিঙ্গলীলা জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে চলে যাওয়া ট্রেক রুটটি তাদের কাছে আদর্শ৷ মানেভাঞ্জন থেকে অনুমতি পত্র নিয়ে, ব্রিটিশ আমলের ভিনটেজ ল্যান্ডরোভার করে আমরা প্রথমে এলাম ছবির মতোই সুন্দর চিত্রেতে৷ চোখের সামনে এখানে হিমালয়ের শুভ্রকান্তি রূপ৷ পাহাড় যে কত উদার, কত সহনশীল, কত শান্ত তা এখানে আসলে বোঝা যায়৷ আরো সাত কিমি চলার পর এল মেঘমা, নেপাল-ভারত দুই দেশের সীমারেখা এখানে মিশেছে৷ এ যেন মেঘেদের বাডি়৷ সামনেই একটি মনেস্ট্রি, হাওয়ায় রঙিন কাপড়ের উপর লেখা তিব্বতি মন্ত্র….‘ওম মনি পদ্মে হম্’৷ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে দূরের পাহাড়৷ পথের দুধারে ঘন শ্যাওলার আস্তরণে ঢাকা পাইন বনের আবডাল৷ মেঘমা থেক ডানদিকে ২ কিমি পর ভারত সীমান্তে টংলু আর বাঁ দিকে নেপাল সীমান্ত ধরে চার কিমি এগোলেই টুমলিং৷
দশ হাজার ফিট উপরে টংলু থেকে পরিস্কার দিনে আকাশ জোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার প্যানোরামিক ভিউ হাতছানি দেয়৷ ঠান্ডার সাথে এখানে উপরি পাওনা হাড়কাঁপানো হাওয়া৷ ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর মনভোলানো সূর্যোদয় দেখতে গেলে একটা রাত থাকতেই হবে টংলুতে৷ থাকার জন্য এখানকার জি.টি.এর ট্রেকার্স হাট সবচেয়ে ভালো৷ টংলু থেকে গাড়ির রাস্তা নেমে গেছে দুই কিলোমিটার দূরের টুমলিংয়ে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯৭০ মি. প্রায় ৯৬০০ ফুট উঁচুতে হিমালয়ের কোলে সান্দাকফু যাওয়ার পথে অপার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অবস্থান করছে এই ছোট্ট জনপদ টুমলিং৷ হাত বাড়ালেই যেন মেঘ ছোঁয়া যায় এখানে, স্বপ্ন যেন অপলক দৃষ্টিতে এখানেই থেমে আছে আদি-অনন্তকাল ধরে৷
চারপাশে লাল-গোলাপি থোকা থোকা রডোডেনড্রন আর সাদা ম্যাগনোলিয়া যেন মুগ্ধ ক্যানভাসে তুলির টান৷ দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকায় বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, আর চারদিক থেকে আগলে রাখা পর্বতশ্রেণী৷ সামনে তাকালেই দু’চোখ ভরে দেখতে পাওয়া যাবে প্রসারিত কাঞ্চনজঙ্ঘার অসীম, অপরূপ সৌন্দর্যকে৷ পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আভায় কাঞ্চনজঙ্ঘার শায়িত বুদ্ধের ঝলক দেখলে সত্যিই মন জুডি়য়ে যায়৷ আর সেইসঙ্গে বাড়তি পাওনা একই ফ্রেমে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের দেখা মেলা৷ মাথার উপর নীল আকাশ আর সারি সারি সবুজ পাইন গাছ.. সে এক রহস্যময় অনুভূতি৷ প্রিয়জনের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর জন্য এমন পরিবেশই তো মানুষ চায়৷ নেপাল সীমান্তে টুমলিং-এ যেতে ভিসা-পাসপোর্টের কাগুজে বাধা নেই, কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই৷
ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনার জন্য পর্যটনশিল্পকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই টুমলিংয়ের বসতি৷ এখানে বাড়ি বলতে হাতেগোনা বিশ-পঁচিশটা, তার মধ্যে ছ’-সাতটা হোমস্টে৷ টুমলিং এর জাতীয় সড়কটি বাদে সম্পূর্ণ বসতিটিই নেপালের অন্তর্গত৷ উঠেছি নীলা গুরুং এর হোম-স্টে তে৷ এ যেন মেঘের কোলে এক স্বপ্নের বাডি়৷ ডিসেম্বরের শেষ, টুমলিংয়ে তখন মাইনাস নয়৷ নীলা গুরুং এর নাম আমি আমার এক কলিগের মুখে শুনেছিলাম৷ টুমলিংয়ের সাথে জডি়য়ে থাকা পাহাডি়য়া এক সাধারণ মেয়ে, যে আজ একজন সফল বিজনেস ওম্যান৷ তাঁর ব্যাপারে জানার কৌতুহল হয়েছিল খুব৷ রাত প্রায় দশটা হবে৷ পাহাডে় যেন তখন নিঝুম রাত৷ বাইরের আলো-আঁধারিতে হোম স্টের জানলা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম পাহাড়ের কোলে দূরের জোনাকির মতো জেগে থাকা ছোট ছোট ঘর বাডি়গুলোকে৷ ঠান্ডায় সব টুরিস্টরাই তখন ঘরের ভেতর৷ হাত পা জমে যাচ্ছে আমার৷ নিভন্ত চুল্লির পাশে বসে আমি আর নীলাদি গল্প করছি৷ শুরুর গল্পটা জানতে চাইতেই নীলা গুরুং বলতে লাগলেন সময়টা ১৯৮৬ সাল৷ গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাডে় তখন আগুন জ্বলছে৷ ট্রেকিং শেষে এক বিদেশি ইটালিয়ান দম্পতি তাঁর বাডি়র সামনে৷ পায়ে চোট পেয়েছেন মহিলা৷ নীলাদি তাঁদের শুধু থাকতেই দেননি, সেবা করে ভালো করে তুলেছিলেন৷ ওই ইটালিয়ান মহিলাই নীলাদিকে হোম-স্টে করার পরামর্শ দেন৷ তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাননি নীলা গুরুং৷ প্রায় দু কিলোমিটার এলাকায় পঞ্চাশ হাজার রডোডেনড্রনের চারা বসিয়ে রঙিন করে তুলেছেন তিনি৷ ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড টু্যর অপারেশন অ্যসোসিয়েশন তাঁকে এই ছোট্ট পাহাডি় এলাকাটিকে পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ করার জন্য সম্মান জানিয়েছে৷ খুব ভালো লাগছিল এমন একজন মানুষের সান্নিধ্যে এসে৷
পরেরদিন ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পাহাড় তার কাঞ্চন রূপে ঝলমলিয়ে উঠল৷ চোখের সামনে শায়িত বুদ্ধ৷ শ্বেতশুভ্র পর্বতের এ রূপের সাক্ষী হল এই দুটি চোখ৷ আকাশের রং বদলাচ্ছে৷ ধূসর, গোলাপি, লাল, কমলা আর সব শেষে নীল৷ দূরে কখনও সোনালি আবার কখনো রুপোলি আভা দেখা যাচ্ছে৷ একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ৷ কী অপূর্ব সেই দৃশ্য৷ একদিকের পাহাড়ে সূর্য উঠছে আর অন্য দিকের বরফের পাহাড়ে সেই আলো পড়ে ঝলমল করে উঠছে৷ নীল আকাশের মাঝে ভেসে উঠেছে রুপালি কাঞ্চনজঙঘা৷ পূর্ণাবয়ব শায়িত বুদ্ধ৷ সত্যি কী আশ্চর্য! মাথা, নাক, মুখ, শরীর, পা– সত্যি কেউ যেন শুয়ে আছে৷ তিনি বুদ্ধদেব কিনা জানা নেই৷ তবে এত শান্ত, সমাহিত ভঙ্গি কার হতে পারে৷ মনে হচ্ছে কেউ যেন দোয়াতে করে নীল কালি আকাশের গায়ে ঢেলে দিয়েছে, আর তার মাঝেই শুয়ে আছেন শ্বেতশুভ্রবসন কোনও এক যোগী পুরুষ, স্লিপিং বুদ্ধ৷
কীভাবে যাবেন: শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে ট্রেনে এনজেপি৷ এনজেপি থেকে মানেভাঞ্জন ৮৬ কিমি দূরত্ব, ৩-৪ ঘন্টা লাগবে৷ সেখান থেকে একমাত্র ওল্ড ল্যান্ড রোভারে চেপে টুমলিং যেতে সময় লাগবে ঘণ্টা দুয়েকের মত৷
কখন যাবেন: শীতে বরফ চাইলে সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর৷ ম্যাগনোলিয়া- রডোডেনড্রনের রঙে পাহাড়ি সবুজ দেখতে চাইলে অবশ্যই মার্চ-এপ্রিল৷
কোথায় থাকবেন: টুমলিং এ হোমস্টেগুলি হল- মাউন্টেন লজ, শিখর লজ (০৯১৪৮৮২৪২২৭), সৎকার লজ (৯৭৭৯৮১-৪৯২০৪৩০), সিদ্ধার্থ লজ (৯৪৩৩২৬৫৮০৬)৷