ঘুরে দাঁড়ানাের লক্ষে আগামীর কথা মাথায় রেখে জেলা ধরে ধরে বৈঠক করছে তৃণমূল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে হুগলি এবং নদিয়া জেলার সাংগঠনিক বৈঠক করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমাে। এবার তারই অঙ্গ হিসেবে আজ, শুক্রবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে মমতা।
এদিনের বৈঠকের বিশেষত্ব হল, একেবারে তৃণমূল স্তরের নেতাদেরকে এই বৈঠকে আহ্বান জানানাে হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য ঘটনা। গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান, শাসকদলের অঞ্চল সভাপতি, ব্লক ও পুরসভার সভাপতি, জেলা পরিষদের সদস্য, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও সহ সভাপতি, পুরসভার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, বিধায়ক ও সাংসদদেরও এই বৈঠকে ডাকা হয়েছে।
প্রথমে ঠিক ছিল একেবারে অঞ্চল থেকে জেলা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করবেন তৃণমূল সুপ্রিমাে। পরে অবশ্য দলের শীর্ষস্তর থেকে সাংসদ ও বিধায়কদের এই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। শাসকদলের জেলা সভাপতি ও সেই সঙ্গে অন্যান্য শাখা সংগঠনের জেলা সভাপতিরাও এই বৈঠকে থাকছেন। সব মিলিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রায় ৬০০ ছােট-বড় নেতা এই বৈঠকে হাজির থাকবেন বলে শাসকদল সূত্রে জানা গিয়েছে।
এধরনের বৈঠক নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। কারণ, এর আগে যত বৈঠক হয়েছে, সেই বৈঠকে ব্লক এবং পঞ্চায়েত সমিতির স্তরে থাকা নেতাদের দেখা গিয়েছে। কিন্তু অঞ্চলভিত্তিক নেতাদের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে, যা অতীতে কখনও হয়নি।
লােকসভা নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুইয়াকে বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষ ৮৭ হাজারেরও বেশি ভােটে পরাজিত করেছেন। একমাত্র খড়গপুর গ্রামীণ বিধানসভা বাদে অন্য কোনও বিধানসভাতে তৃণমূল জয়ী হতে পারেনি। খড়গপুর শহর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল পিছিয়ে গিয়েছে ৪৫ হাজারেরও বেশি ভােটে।
মানস ভুইয়া ২০১৪ লােকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থী সন্ধ্যা রায়ের চেয়ে বেশি ভােট পেয়েও পরাজিত হয়েছেন। কারণ, বামেদের ৩ লক্ষেরও বেশি ভােট চলে গিয়েছে বিজেপি’র দখলে। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের ২৫ হাজারেরও বেশি ভােট গিয়েছে বিজেপি’র ঝুলিতে। বামেরা নিজেদের ভােট ধরে রাখতে না পারায় তৃণমূলের ভরাডুবি সম্ভব হয়েছে।
মানস ভুইয়ার মতাে হেভিওয়েট প্রার্থী পিছিয়ে পড়তে পারেন, এতটা ভাবেনি তৃণমূল। কিন্তু নির্বাচন যতই সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে, ততই পিছিয়ে পড়েছেন মানসবাবু।
মেদিনীপুর লােকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের এই পরাজয়ের নেপথ্যে ঠিক কি কি কারণ রয়েছে তা এতদিন চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে দল। বামেদের ভােট বিজেপি’তে শিফট হয়ে যাওয়া ছাড়াও সাংগঠনিক দুর্বলতা দলের কোথায় কোথায় রয়েছে, কেন এত উন্নয়ন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বিজেপি’কে বেছে নিল, তা নিয়ে বুথভিত্তিক সমীক্ষা করেছে তৃণমূল।
ইতিমধ্যে এই জেলায় দলের পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শুভেন্দু অধিকারীকে। লােকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরে পরেই তৃণমূল ছেড়ে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিজেপি’তে যােগদানের হিড়িক পড়ে যায়। শাসকদলের নেতা কর্মীদের ঘর-ছাড়া পর্যন্ত হতে হয়েছে।
দলীয় নেতা-কর্মীদের মনােবল অটুট রাখতে তৃণমূল সুপ্রিমাের নির্দেশে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বেশ কয়েকটি ব্লকে শুভেন্দু অধিকারী যান। রাতারাতি তৃণমূলের বেশ কয়েকটি দলীয় কার্যালয় বিজেপি’র দখলে চলে যায়।
শুভেন্দু মাঠে নেমে সেই পার্টি অফিস ফের তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে দলত্যাগী তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতাকে দলে নিয়ে এসে রাজনৈতিকভাবে বিজেপি’কে বার্তা দেন এই নেতা। কিন্তু লােকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভােটব্যাঙ্কে যে ক্ষয় দেখা গিয়েছে সেই ক্ষয়পূরণ কিভাবে সম্ভব তার দিকনির্দেশ করতে এদিনের বৈঠক অন্য মাত্রা পাবে এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
এদিনের বৈঠক থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সংগঠনে সাংগঠনিক রদবদলের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হচ্ছে। আগামী ২১ জুলাই তৃণমূল কংগ্রেসের শহিদ দিবস রয়েছে। এই শহিদ দিবসে ব্যাপক জনসমাগম করে বিরােধীদের বার্তা দিতে চায় তৃণমূল।
কিন্তু তার আগে সংগঠনকে চাঙ্গা করতে শুরু হয়েছে তৃণমূলের জনসংযােগ যাত্রা। শুধুমাত্র মেদিনীপুর শহরে বসে নয়, বুথস্তরে গিয়ে যাতে নেতারা জনসংযােগ বৃদ্ধি করেন তার ওপর এদিনের বৈঠক থেকে বিশেষ বার্তা দিতে পারেন তৃণমূল সুপ্রিমাে এমনটাই শােনা যাচ্ছে।
কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি যদি প্রত্যেকটি বিধানসভায় গিয়ে সভা করতে পারেন তাহলে জেলাস্তরের নেতারা কেন ব্লকে যাবেন না, এই নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দলকে চাঙ্গা করতে বুথস্তর পর্যন্ত সংগঠনকে চাঙ্গা করাই যে তৃণমূল সুপ্রিমাের লক্ষ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবারের বৈঠক নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী অঞ্চল প্রধানরা। কারণ, এর আগে তাঁরা বিভিন্ন জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ শুনেছেন। কিন্তু এবারই প্রথম তাঁরা তৃণমূল সুপ্রিমাের মুখােমুখি হচ্ছেন। ইতিমধ্যে বুথভিত্তিক দল কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তার তথ্য জমা পড়েছে শাসকদলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সির কাছে।
কেন বিজেপি’র রণকৌশলকে ছাপিয়ে যেতে পারল না তৃণমূল তা নিয়েও আলােচনা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কাটমানি, অবৈধ বালিখাদান ছাড়া স্থানীয় স্তরের বহু ইস্যু এবার শাসকদলকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের ভােটব্যাঙ্কে বসন্ত এনেছে।
বিজেপি একা একা নয় কিংবা নিজেদের পকেটের লােক দিয়ে রাজনীতি না করে সংগঠনকে সামনে রেখে একটা টোটাল টিম হিসেবে যাতে নেতারা দলের কাজে যুক্ত হন সেই নির্দেশ দেওয়ারও সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে।
সব মিলিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সাংগঠনিক বৈঠককে ঘিরে তৃণমূল স্তরের নেতাদের মধ্যে উত্তেজনার পারা যথেষ্ট রয়েছে। সেই সঙ্গে সাংগঠনিক রদবদল হয় কি না তা নিয়েও কৌতুহল কোনও অংশে কম নয়।