ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে চাষিদের দুর্দশা চরমে। গত পাঁচ বছরে চাষিদের ঋণ মকুবের দাবি, আত্মহত্যা, ফসলের উচিত দামের মতাে বিষয়ে দেশে আন্দোলন হয়েছে যথেষ্ট। গত পাঁচ বছরে কৃষির সমৃদ্ধির হারও একেবারে তলানিতে। তার উপর গত পাঁচ বছরে খরার প্রকোপ কমেনি। এ বছরও অদ্যবধি খরার কবলে দেশের ৪৫ শতাংশ এলাকা।
এমতাবস্থায় গত ২০শে জুন সংসদের যৌথ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ২০২২-এর মধ্যে দেশে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে বলে ঘােষণা করলেন। একই ঘােষণা গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে করে চলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও কৃষির সমৃদ্ধির হার গড়ে তিন শতাংশ ছাড়ায়নি।
এছাড়া রাষ্ট্রপতি ওইদিন আরও ঘােষণা করলেন কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আগামী কয়েক বছরে ঢালা হবে ২৫ লক্ষ কোটি টাকা। ফসল মজুতের অসুবিধা মেটাতে প্রত্যেক গ্রামের কাছে হিমঘর, গুদাম তৈরির জন্য কার্যকরী হবে গ্রামীণ ভাণ্ডারণ প্রকল্প।
২০২২-এর মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ ছাড়াও আরও যে লক্ষ্যমাত্রা রাষ্ট্রপতি গত ২০ জুন সংসদের যৌথ অধিবেশনে ঘােষণা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে সব গরিবের জন্য পাকা বাড়ি, সব গরিবের জন্য নির্মল জ্বালানি সব গরিবের জন্য চিকিৎসা। সড়কে যুক্ত সব গ্রাম, দূষণমুক্ত গঙ্গার অবাধ প্রবাহ, দেশীয় প্রযুক্তিতে মহাকাশযাত্রা ইত্যাদি প্রকল্পসমূহ।
এখানেই অবশ্যই উল্লেখ্য যে ২০১৪-তে ক্ষমতায় এসে প্রথম ৫ বছরে যে প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের ওয়াদা করেছিলেন তার অনেকগুলি কার্যত সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যেমন স্মার্ট সিটি প্রকল্প, ওয়াই ফাই প্রকল্প, গ্রামগুলিকে শহরায়নের প্রকল্প, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নারীদের সংরক্ষণ প্রকল্প ইত্যাদি।
তাই গত ২০ জুন রাষ্ট্রপতি সংসদে ২০২২-এর মধ্যে যে প্রকল্পগুলির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছেন তা আগামী মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রায় পৌছনাে কার্যত অসম্ভব। প্রথম পাঁচ বছরের অনেকগুলির যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল তার সিংহভাগই অর্জন করা যায়নি।
প্রথমবার ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছরের মধ্যে দুই অঙ্কের সমদ্ধির মাত্রার যে ঢক্কানিনাদ উচ্চারিত হয়েছিল গত অর্থবর্ষেই বৃদ্ধির হার নেমে গেছে মোদি জমানার প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে সব থেকে নীচে (৬.৮ শতাংশ)। ওই বছরের শেষ ত্রৈমাসিকে চিনের কাছে হাতছাড়া দ্রুততম বৃদ্ধির তকমাও।
কাজের সুযােগ তৈরির সংখ্যাও প্রয়ােজনের তুলনায় নস্যি। মোদি ওয়াদা করেছিলেন বছরে ২ কোটি চাকরির। পক্ষান্তরে ২০১৭-১৮ সালে মোদির আমলে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। ভারতের খুচরাে বাজারে তেলের দাম, ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় টাকার দাম সম্পর্কে গত পাঁচ বছরের মোদির ওয়াদার প্রতিফলন হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো।
এটা ঘটনা যে ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় টাকার মুদ্রা সম্পর্কে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই চরম ব্যঙ্গাত্মক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম সম্পর্কে। মোদির প্রথম পাঁচ বছরে যেহেতু ভারতের খুচরা বাজারে তেলে দাম ও ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় টাকার দাম তার ওয়াদার থেকে অনেক নীচে, তাই একই ব্যঙ্গাত্মক শব্দ হজম করতে হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে।
প্রথম পাঁচ বছরে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র যে স্বপ্ন ফেরি করেছিলেন তা কার্যত সম্পূর্ণ ব্যর্থ। গত পাচ বছরে কলকারখানার উৎপাদন ঝিমিয়ে। বেসরকারি বিনিয়োগও কার্যত তলানিতে। তাই শিল্পে সমৃদ্ধিও তলানিতে। দেশে শিল্পে উন্নয়নের যে ওয়াদা তিনি গত পাঁচ বছরে করেছিলেন তা কার্যত স্তব্ধ।
রফতানি ক্ষেত্রে ওয়াদাও ব্যর্থ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে একটি অর্থবর্ষেও ২০১৩ অর্থবছরের রফতানির লক্ষ্যমাত্রায় পৌছনাে যায়নি। বর্তমানে বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে শুল্ক যুদ্ধের ফলে আগামী দিনে ভারতের রফতানি আরও ঘােরালাে হবার সম্ভাবনা।
গত পাঁচ বছরে মোদির সিংহভাগ ওয়াদা কার্যত ব্যর্থ। এমনকী অর্থনীতির সমৃদ্ধি গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবথেকে নীচে। এমতাবস্থায় ২০২২-এর মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াও রাষ্ট্রপতি ২০২৪-এর মধ্যে ভারতের অর্থনীতির মাপ ৫ লক্ষ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল অর্থনীতির সামগ্রিক অবনমনের এই চরম মুহর্তে অর্থনীতিকে চাঙা করতে বিপুল সরকারি বিনিয়ােগের প্রয়ােজন, তা আসবে কোথা থেকে?
একদিকে বেসরকারি বিনিয়ােগ কার্যত তলানিতে, অন্যদিকে সরকারি বিনিয়ােগ প্রতি বছর রাজকোষ ঘাটতির অর্ধেকেরও অনেক নীচে। হলে সার্বিক সামাজিক ও পরিকাঠামােগত উন্নয়নের অর্থ আসবে কোথা থেকে? অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক চাহিদা ঘাটতির জন্য উৎপাদন ও বিনিয়ােগের প্রসার ঘটাতে কর ছাঁটাইয়ের দাবি শিল্পপতিদের।
এমতাবস্থায় ২০২২-এর মধ্যে ও ২০২৪-এর মধ্যে মোদির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা গত পাঁচ বছরের মতাে একটি বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে কি? ভারতের জনগণ লক্ষ্যমাত্রার প্রকৃত বাস্তবায়ন চায়।