• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

শহরের হাসপাতালের বন্ধ দরজার সামনে অসহায় রােগীদের ভিড়

অন্যদিন ওঁরাই তাদের রােগের জ্বালা কমিয়ে দেন। কিন্তু আজ জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদের আগুন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল অসুস্থ মানুষগুলাের রােগের জ্বালা।

এনআরএস হাসপাতালের বন্ধ দরজা (Photo: Kuntal Chakrabarty/IANS)

অন্যদিন ওঁরাই তাদের রােগের জ্বালা কমিয়ে দেন। কিন্তু আজ জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদের আগুন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল অসুস্থ মানুষগুলাের রােগের জ্বালা।

বুধবার রােগাক্রান্ত ছােট্ট শিশু থেকে অশক্ত বৃদ্ধ মানুষ– শহরের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের আউটডােরের বন্ধ দরজার সামনে ভিড় করে রইলেন অসহায় রােগী এবং তার আত্মীয় পরিজনরা। কারণ ডাক্তারদের অনির্দিষ্টকালের ধর্না-অবস্থানের জন্য অনেকেরই এদিন অ্যাডমিশন হল না হাসপাতালে।

কিন্তু ডাক্তারদের এই অবস্থানের জন্য তাে আর রােগীদের শারীরিক অবস্থা বদলাবে না। তাঁরা রােগী দেখা বন্ধ করলেও, বন্ধ হবে না ক্ষতস্থানের রক্তপাত, হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি, যন্ত্রণার অসহ্য কাতরানি। এমনকী যে থ্যালাসেমিয়া রােগীদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে বােতলবন্দি রক্তের মাধ্যমে কিংবা যে কেমােথেরাপি নেওয়া রােগীদের জীঘড়ির সময়টুকু মাপা থাকে ডাক্তারদের কেমাে ডােজের ঘন্টা মিনিটে অথবা যে ডায়ালিসিস নেওয়া রােগীদের রক্তস্রোত সচল হয়ে থাকে ডাক্তারদেরই হাতের সিরিঞ্জে– ধবার দিনভর তাঁদের জীবন হয়ে পড়ল সঙ্কটাপন্ন।

জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর নিগ্রহের প্রতিবাদে বুধবার জুনিয়র ডাক্তাররা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘটে বসেছেন। কোথাও কোথাও জুনিয়রদের সমর্থন জানিয়ে তাঁদের পাশে রয়েছেন সিনিয়র ডাক্তাররা। ফলে শহরের বহু সরকারি হাসপাতালে এদিন চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ রইল।

কিন্তু তাতে কী? রায়গঞ্জ থেকে আসা ছােট্ট একরত্তি শিশুটির পিঠের টিউমার ফেটে গলগল করে রক্ত বেরনাে যে বন্ধ হচ্ছিল না। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠা শিশুটির ছােট্ট নরম শরীরটাকে বুকে আগলে ধরে রাখা শিশুটির জ্যাঠামশাইয়ের জামা কাপড় ভেসে যাচ্ছে তাজা রক্তে। বালুরঘাট হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন শিশুটির মা। শিশুটির জন্মের পরই তাঁর টিউমারের চিকিৎসার জন্য প্রথমে মালদহ হাসপাতালে পাঠানাে হয়। সেখানে নিউরােসার্জিকাল বিভাগ না থাকায় কলকাতার এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় ছােট্ট ওই শিশুটিকে। তারপর দিনভর পিজি, চিত্তরঞ্জন শিশু হাসপাতাল, বিসি রায় হাসপাতালে ওই শিশুটিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন তার আত্মীয়জনেরা। সারাদিন শিশুটির অবিরাম রক্তক্ষরণের সাক্ষী রইল এই শহরের পথঘাট।

এনআরএস হাসপাতালের গেটের সামনে মেন গেটে ঝুলছে তালা। তার সামনে রােদে তেতে ওঠা ছাই রঙের গাড়িটা থেকে উকি দিচ্ছে অনেকগুলাে অসহায় মুখ। কারও চোখের কোণ কালি, কারও চুল গুছি পাতলা হয়ে এসেছে। এরা হল বাঁকুড়ার সারেঙ্গর বছর পাঁচেকের শিশু অরুণ্য সিংহ, সাত বছরের রুণু লােহার, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা চার বছরের নিশা কুমারী। একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ব্যবস্থাপনায় এরা নিয়মিত আসে এই হাসপাতালে কেমাে থেরাপি নিতে। কিন্তু এনআরএসে বন্ধ দরজার সামনে আজ মাথা কুটে গেল তাদের অসহায় ভবিষ্যৎ। দুপুরে রােদে কষ্ট হচ্ছিল ওদের। তাই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ওদের।

বালুরঘাট থেকে আসা থ্যালাসেমিয়া রােগী নুসরত মণ্ডলের বাবা ইসলাম মণ্ডলও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন তাঁর মেয়েকে। এনআরএস-এর সামনে গাছতলায় মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন সিরাজুল মণ্ডল। তার মেয়ে তুহিনা ভুল করে কীটনাশক খেয়ে ফেলেছিল। রবিবার রাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বর্তমানে তার চিকিৎসা যে আদৌ হচ্ছে কিনা তা বােঝা যাচ্ছে না।

এইভাবে এদিন বাহাত্তর বছরের শান্তিরানি চৌধুরীকেও ভাঙা হাত নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে বসেই যন্ত্রণাতে কাতরাতে হয়েছে। হলদিয়ার দুর্গাচক থেকে তিনি হাজার টাকা গাড়িভাড়া করে স্ত্রীকে দেখাতে এনেও ভর্তি করতে পারেননি অভিরাম বসাক।

আসন্নপ্রসবা থেকে মৃত্যু পথযাত্রী সবাইকে এদিন ডাক্তারদের এই অমানবিক অবস্থার জন্য হয়রানির শিকার হয়েছে। যে ডাক্তারদের মানবিকতার ওপর মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করে, এদিন সেই মানবিক মুখই পুড়ে গেল প্রতিবাদের আগুনে।