সুরের আকাশে মঙ্গলবারই খসে পড়েছিল ‘সন্ধ্যাতারা’। সেই রাতেই ফের হল নক্ষত্রপতন। তাঁর গাওয়া গানের আর্জিকে না মেনে শেষ পর্যন্ত ‘আলবিদা’ বলতেই হল বাপ্পি লাহিড়িকে।
রবীন্দ্রসদন চত্বরে একইসঙ্গে ‘গীতশ্রী’ এবং ‘ডিস্কো কিং’–এর শ্রদ্ধাস্মরণে বুধবারটি হয়ে উঠল শুধুই গানের দিন। মিলে গেল বাংলা আর বলিউড।
হয়তো একই কথা দুই শিল্পীর কন্ঠের আর্জি— ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে আর’ কভি আলবিদা না কহেনা। তিলোত্তমা সাক্ষী রইল দুই প্রয়াত শিল্পীর শ্রদ্ধার্পণের।
অবস্ট্যাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬৯ বছর বয়সেই চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন বাপ্পি লাহিড়ি মঙ্গলবার রাতেই জুহুর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এই গায়ক ও সুরকার।
সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ির মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শোকবার্তায় মমতা লিখেছেন, ‘কিংবদন্তি সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী বাপী লাহিড়ি (অলোকেশ লাহিড়ির) প্রয়াণে আমি গভীর শোকপ্রকাশ করছি।
উত্তরবঙ্গের সন্তান আমাদের বাপি লাহিড়ি অসামান্য প্রতিভা ও কঠেআর পরিশ্রমে সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সাঙ্গীতিক অবদানর মাধ্যমে আমাদের গর্বিত করেছেন।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অবিস্মরণীয় সুরের জাদুতে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। হিন্দি, বাংলা ছাড়াও তেলুগু তামিল কন্নড়সহ বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ২০১২ সালে বিশেষ চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০১৫ সালে’ স্পেশাল লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড’, ২০১৬ সালে ‘মহানায়ক সম্মান’ এবং ২০১৭ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান প্রদান করে।
তাঁর মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতের অপুরণীয় ক্ষতি হল। আমি বাপী লাহিড়ির পরিবার পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।
বুধবার রবীন্দ্রসদনের একতারা মঞ্চে (মুক্ত মঞ্চ) রাজ্য সরকার বাপ্পি লাহিড়ির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করা হয়েছিল।
এদিন বিকেলে বাপ্পি লাহিড়িকে পুষ্পস্তবকে শেষ শ্রদ্ধা জানান মমতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে ছিলেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ মন্ত্রী।
রবীন্দ্রসদনের একতারা মঞ্চে এদিন প্রয়াত শিল্পীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শিল্পী থেকে সাধারণ মানুষ।
এসেছিলেন অনসূয়া মুখোপাধ্যায়, বিক্রম ঘোষের মতো শিল্পীরা। আর এসেছিলেন অগণিত সাধারণ মানুষ, যাঁদের মনে বাজছিল সেই সুর–ইয়াদ আ রাহা অ্যায়, তেরা প্যার।
সত্যিই বলিউডের বাসিন্দা হলে কী হবে, এই বাংলার প্রতি ছিল তাঁর অকুন্ঠ ভালোবাসা। তাই এই বাংলার বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষজন বাপ্পি লাহিড়ির সঙ্গে আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছেন।
আশির দশকের সেই “ডিস্কো দিওয়ানি ‘বাংলার মিঠুন চক্রবর্তী কিংবা কলকাতাকে ভালোবেসে এখানেই থেকে যাওয়া’ কোই ইয়া নাচে নাচে গানের রক কুইন ঊষা উত্থপ-দুজনেই আপামর বাঙালিকে আজও নাচিয়ে দিতে পারেন বাপ্পি লাহিড়ির সুরে।
অন্যদিকে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত কিংবা অনসূয়া মুখোপাধ্যায়ের মতো নবীন প্রতিভাকে দিয়ে গাইয়ে নেওয়ার কৃতিত্বও বাপ্পি লাহিড়ির। বাপ্পি লাহিড়ির সাঙ্গীতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল তবলার বোলে।
এদিনের বাপ্পি লাহিড়ির স্মৃতিচারণ করেছেন বিক্রম ঘোষ, দেবজ্যোতি মিশ্র, জিৎ প্রমুখ সুরের কারবারি। কিছুদিন আগেও ‘সা রে গা মা’ রিয়েলিটি শো এর ফাইনাল মঞ্চে এসেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি।
খেলার মাঠ, ভোটের লড়াই, উত্তরবঙ্গের মৎসপ্রেম, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো ডিস্কো ড্যান্সারকে আলো দেখানো থেকে, একাধিক বাংলা সিনেমায় বাপ্পি লাহিড়ি চিরকাল বাঙালিকেই বলে এসেছেন ‘আমি চিরদিন তোমারই তো থাকব।’