• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

আন্তর্জাতিক মাইক্রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কলকাতা নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র প্রেমীদের এক নতুন দিশারী

কলকাতায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক মাইক্রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং সেই বিষয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম আই এম এফ এফ কলকাতার চেয়ার পার্সন  নীলাঞ্জন ভৌমিকের।

কলকাতায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক মাইক্রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং সেই বিষয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম আই এম এফ এফ কলকাতার চেয়ার পার্সন  নীলাঞ্জন ভৌমিকের। একান্ত আলোচনায় কিছু বিষয়ে কথা হয় যা নিম্নরূপ।

১. ফিল্মের প্রতি আপনার আগ্রহটা কিভাবে জন্মাল?

ফিল্ম ডিরেকশনে আপনার ঝোঁকটা কিভাবে তৈরি হল? মানে কিভাবে এই বিষয়ে ইন্সপায়ার্ড হলেন?

ছোটবেলা থেকেই জলপাইগুড়ি সিনে সোসাইটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম, বিবিধ আন্তর্জাতিক ছবি তখন থেকেই দেখার অভ্যেস। হাঙ্গেরী, ইতালী, ফ্রান্স ও রাশিয়ান মুভি প্রচুর দেখতাম। সব যে বুঝতাম এমন নয়, কিন্তু দেখতাম প্রচুর। সোসাইটির উইক-এন্ড ফিল্ম শো গুলিতে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক বাদেও কুরুশাওয়া (সেভেন সামুরাই), আইজেন্সটাইন (নানুক অফ দ্য নর্থ), দেসিকা (বাইসাইকেল থিভস), বার্গম্যান (দ্য সাইলেন্স), ফেলিনি (ক্যাসানোভা), গোদার (ক্র্যামার ভার্সাস ক্র্যামার) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফিল্ম ডিরেক্টররা মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। হয়তো সেখান থেকেই শুরু।

ডিরেকশন নিয়ে একটু বিশদে পড়াশোনাটা শুরু হয়েছিল দুহাজার সালের দিকে। ঐ সময়ে কলকাতায় প্রথম ইন্টারনেট চালু করেন বিদেশ সঞ্চার নিগম লিমিটেড। আমি ছিলাম ওঁনাদের সপ্তম ডায়াল-আপ ক্লায়েন্ট। একটা ঢাউস সাদা ডেস্কটপ নিয়ে সারাদিন অফিস করে এসে, রাতের পর রাত জেগে পড়তাম। বেশ কিছু বছর। অবশ্য অন্যান্য বই ও পত্রপত্রিকাও পড়তাম। পরে, প্রফেশন্যাল ট্রেনিং-ও নিয়েছি। এস আর এফ টি আই- এর পাশেই থাকি বলে, শুরুর দিকে ওঁনাদের ফ্যাকাল্টিদের কাছ থেকেও প্রচুর সাহায্য পেয়েছি।
তারপর যা হয়, ঝোঁক তো ছিলই … ধীরে ধীরে নেশা ধরে গেল। ফিল্ম অ্যাডিকশান যাকে বলে।

২. মাইক্রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করার আইডিয়া কিভাবে? কেন এলো? কোন ভাবনা থেকে এই জার্নিটা শুরু করেছিলেন?

সত্যি কথা বলতে কি, একটা বেদনাবোধ থেকে। একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগী হিসেবে বেস্ট রানার আপ ফিল্ম পুরস্কার পেয়েছিলাম। নামটা একটু শেষের দিকে ডাকা হয়। পুরস্কার আর শংসাপত্র নিতে গিয়ে দেখি মাত্র ১২ জন দর্শকাসনে বসে আছেন। কেউ হাততালি দেননি। এমনকি আমার সতীর্থ ফিল্মকাররাও আমাকে উৎসাহীত করার জন্য, অপেক্ষা করার সৌজন্য দেখাননি। ভীষণ খারাপ লেগেছিল ভেতর থেকে। সেটাই হয়তো পরবর্ত্তীতে জেদে রূপান্তরিত হয়েছে।

আসলে প্রতিটি ছোটছবি নির্মাতাই এক একজন শিল্পী। তাঁরাই চলচ্চিত্র শিল্পের প্রকৃ্ত সাধক, যাঁদের আর্টফর্মের প্রকাশভঙ্গীতে কোন বাণিজ্যিক আপোষ প্রয়োজন হয়না। ফর্ম ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসার মত সাহস যাঁদের থাকে, তাঁদের একটা স্বাভিমান থাকা উচিৎ। আর সেই সঙ্গে সতীর্থ শিল্পী ও তাঁর কাজের প্রতি সম্মানবোধ।

৩. কতদিন যাবৎ এই ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হয়েছে?

এটা চতুর্থ বছর।

৪. কেমন ফিড ব্যাক পেয়েছেন?

সেভাবে ফিড আর করাতে পারলাম কোথায় বলুন, যে ব্যাক পাওয়ার প্রত্যাশা করব। তবে হ্যাঁ, কেউ ইঁট পাটকেল ছোঁড়েননি, লাঠি নিয়ে তেড়ে আসেননি, এটুকু বলতে পারি। তবে আমাদের সামাজিক বিহেভিয়ার‍্যাল প্যাটার্ন যেরকম দ্রুতহারে বদলাচ্ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে এরকমটা হলেও অবাক হব না।
ভালোবাসেন অনেকে, স্বার্থহীন ভাবে … এটুকু বুঝতে পারি।

৫. ফেস্টিভ্যালের পেছনে যে ভাবনা,লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই, অগ্রগতির হারও প্রশংসনীয়। তবে এখনো অনেকদূর যেতে হবে। মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ। দেখা যাক, জীবন কতটা সুযোগ দেয়।

৬. এই অরগানাইজেশানের ফাউন্ডার হিসেবে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়েছে বা হয়ে থাকে?

একটা এতবড় উৎসব কোন সেরকম বড় স্পন্সর ছাড়া আইনসঙ্গত ভাবে অরগ্যানাইজ করতে গেলে যা যা অসুবিধে হতে পারে মূলতঃ সেইগুলোই আর কি ! বাইরে থেকে আমাকে চ্যালেঞ্জ আর কে-ই বা করবেন ? সেরকম সৎ, কর্মনিষ্ঠ মেরুদন্ডওয়ালা কোন যোগ্য প্রতিপক্ষ আমার নজরে পড়েনি। পড়লে খুশী হতাম।
আমাদের নিজেদের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে আগামীতে উত্তরোত্তর আরো ভাল পারফর্ম করাটাই আমাদের কাছে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি।

৭. এই ফেস্টিভ্যালের চেয়ারপার্সন হিসেবে শর্টফিল্ম মেকারদের উদ্দেশ্যে আপনি কি বার্তা দিতে চান?

দুটি।
এক) যদি চেয়ার পার্সন হ’তে হয়, তাহলে মনে রাখতে হবে যে চেয়ারেরও চারটে পায়া হয় আর সেই পায়াগুলি মজবুত হওয়াটা ভীষণ জরুরী। তাই বেসিক জায়গাগুলিতে অবশ্যই নজর রাখা ও যত্নবান হওয়া দরকার। কি ফিল্মে কি জীবনে। এসব জায়গায় আপোষ করলে চলেনা।

দুই) আধুনিক ডিজিট্যাল প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে সিনেমা বানানোর প্রকরণপদ্ধতি আজ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। ডিজিট্যাল মনিটারাইজিং-এর সাহায্যে এডিটিং ও অন্যান্য সংযোজনের সময় নানা ভাবে রাশ শটস্ দেখা সম্ভব হচ্ছে। ফিল্মের বদলে ডিজিট্যাল মাইক্রোকার্ডের ব্যবহার, এনজি শটে ফিল্ম নষ্টের অহেতুক অর্থ অপচয়কে অবলুপ্ত করেছে। এসব কিছুর ফলে, চলচ্চিত্রে এ্যামেচাররা ঢোকার খোলা রাস্তার খোঁজ পেয়েছে। কোনো শিল্পই নতুন বিকাশের পথ পায় না, যদি তাতে এ্যামেচার বা এভ্যান্ট গার্ড কাজ করার সুযোগ না পায়। নতুন গল্পকাররা যদি উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে সমগ্র শিল্পেরই আশু মঙ্গল। আর ঠিক এই জায়গাতেই, বাংলা অণু ছবি তথা ক্ষুদ্র চলচ্চিত্র শিল্পে ভালো গ্রহণযোগ্য ছোট গল্পের অভিঘাত ক্রমশঃ আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

আরো নতুন নতুন, ভালো ভালো ছোটছবি তৈরী হোক, আরো সৃজনশীল মানুষ ছবি বানানোতে মেতে উঠুক, এটাই চাইব।

৮. বিগত বছরগুলোতে কেমন সাড়া পেয়েছেন?

গত বছর ১১২ টি ছবি অংশগ্রহণ করেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন কোণ থেকে। এবছর এসেছে ৯৪ টি ছবি। সংখ্যায় একটু কম হলেও অংশগ্রহণকারী দেশের আনুপাতিক হার অনেক বেড়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস, ইউ কে, ইরান, সৌদি আরব, স্পেন, সিঙ্গাপুর, রাশিয়ান ফেডারেশান, ইতালী, ফ্রান্স, কোরিয়া, ইজরায়েল, আয়ার্ল্যান্ড, মলদোভা, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া এবং ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের নানান পরিচালকের বিবিধ জঁরার ৯৪ টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। চূড়ান্ত পর্বের বাছাই প্রক্রিয়া চলছে। আশা করা যায়, ফেস্টিভ্যালে নমিনেশান পাওয়া প্রদর্শনযোগ্য ছবির সংখ্যা অন্ততঃ ষাটোর্ধ্ব হবে। কোভিদের মতন ধ্বংসাত্মক অতিমারী পিছু তাড়া করে না বেড়ালে ফেস্টিভ্যালের অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে হাজার দর্শকাসনওয়ালা অডিটোরিয়ামও হয়ত ভরে যেত, কিন্তু নানান প্রোটোকলের বিধিনিষেধে কিছুটা আটকে যাচ্ছি। দেখা যাক আগামী দিনগুলি আমাদের জন্য কি নিয়ে আসে।

৯. ফেস্টিভ্যাল সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে তোলার ক্ষেত্রে আপনি কি বলবেন?

নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা দিয়ে যাঁরাই কাজ করেন, তাঁদের চারপাশটা এমনিতেই সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়ে ওঠে। অণুছবির প্রতিটি সদস্যের চোখেও স্বপ্ন আছে। সুন্দর হয়ে ওঠাটা আর কী এমন বেশী কথা ? নিজেদের কাজ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারলে নিশ্চয়ই কলকাতা আন্তর্জাতিক অণুছবি চলচ্চিত্র উৎসব সফল হবে। সেই সঙ্গে সে তার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যেও অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে এই প্রত্যাশা রাখি।