পড়াশোনায় মধ্যমেধার হওয়া কোনও সমস্যার নয়। কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে তা অর্থহীন। নিজে কী চাও, তা জানতে হবে, যাই করো না কেন, তাতে নিজের সেরাটা দিতে হবে। নিজের ঢাক নিজে পিটিও না বা কে কখন পিঠ চাপড়ে দিল, তার অপেক্ষা কোরো না। আশা হারালে চলবে না’ এই কথাগুলো এখনও কানে বাজছে হরিয়ানার চণ্ডীমন্দির ক্যান্টনমেন্টের আর্মি পাবলিক স্কুলের পড়ুয়াদের কানে।
তাঁদের পড়ে শুনিয়েছিলেন চার পাতার এক দীর্ঘ চিঠি। ভারতীয় সেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন বরুণ সিং, তাদের স্কুলেরই প্রাক্তনী, এই চিঠি লিখেছিলেন প্রিন্সিপাল প্রিন্সিপালকে। পড়ুয়াদের অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন তিনি।
ক্যাপ্টেন বরুণ সিং এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে। বুধবার তামিলনাড়ুর কুন্নুরে ঘটে যাওয়া মারাত্মক কপ্টার দুর্ঘটনায় একমাত্র বেঁচে আছেন তিনিই। ওই কপ্টারেই ছিলেন সস্ত্রীক সিডিএস বিপিন রাওয়াত-সহ মোট ১৪ জন। ১৩ জনই মারা গেছেন।
অবিশ্বাস্য এক অসম লড়াই লড়ছেন বরুণ একা গ্রুপ ক্যাপ্টেন বরুণ সিং এবছরই স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শৌর্য চক্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তেজস যুদ্ধবিমানকে অকল্পনীয় দক্ষতায় রক্ষার জন্য তিনি এই বিশেষ পদক পান।
ছাত্রজীবনে সাধারণ পড়ুয়া ছিলেন বরুণ। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা, জেদ এবং পরিশ্রম তাঁকে পৌঁছে দেয় এক অসাধারণ কাজের শিখরে। এ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে নিজের স্কুলের জন্য চিঠি লেখেন বরুণ।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন লিখেছিলেন, ‘আমি খুবই সাধারণ ছাত্র ছিলাম, কোনও রকমে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম টুয়েলভে। আমি খেলাধুলো বা অন্যান্য বিষয়েও তেমন তুখোড় ছিলাম না। কিন্তু আমার প্যাশন ছিল এয়ারপ্লেন নিয়ে। তবে এই নিয়ে যে আমি খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, তাও নয়।
আমি যেন কখনওই নিজে নিজেকে আরও ভাল জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম না কিন্তু আমি যখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হিসেবে সুযোগ পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, তার পরে আমি বুঝলাম, আমি আরও ভাল কিছু করতে পারতাম এতদিনে, মন দিয়ে যদি চেষ্টা করতাম।
এখান থেকেই আমার জীবনটা ঘুরে গেল। তা সে পার্সোনালি হোক বা প্রফেশনালি, আমি প্রতিটা কাজে নিজের সেরাটা দিতে শুরু করলাম। এই নতুন শুরুর দারুণ ফলও পেলাম হাতে হাতে।’
বরুণ সিংয়ের এই কথাগুলি যেন বহু ‘মধ্যমেধা’র ছাত্রছাত্রীদের কাছে দুরন্ত অনুপ্রেরণা। অনেকেই হয়তো ভাবে এই চরম প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় তারা সফল হবেনা, তাদের জন্যই যেন বরুণের এই চিঠি! ফ্লাইং
ইনস্ট্রাকটরদের বিশেষ কোর্সে তুখোড় দক্ষতার জন্য দুটি ট্রফি পেয়েছিলেন বরুণ। বিশেষ পাইলট ট্রেনিংয়ের পরে তেজস ওড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তার জেরেই পেয়েছেন শৌর্য চক্র পুরস্কার। শুধু তাই নয়, তিনি ইসরো-র ঐতিহাসিক গগনযান প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত প্রথম ১২জন সেনার তালিকাতেও ছিলেন।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ও বোধ থেকে লেখা সে চিঠির ছত্রে ছত্রে তিনি তাই বুঝিয়ে দিয়েছেন, আত্মবিশ্বাসই শেষ কথা তিনি বলেছেন, একটা সময়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মনে খুব বেশি চাপ পড়ে যায়। এই শিক্ষাব্যবস্থার পাকে পড়ে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
বিশেষ করে যারা একটু অন্যরকম, একটু ইন্ট্রোভার্ট, তারা যেন আরও পিছিয়ে যায়। তাদের জন্যই বরুণের এই চিঠি। তিনি সবশেষে লিখেছেন, ‘জীবনে তুমি কতটা সফল হবে, কী পাবে, তা ক্লাস টুয়েলভের বোর্ড পরীক্ষার নম্বর ঠিক করে না। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, নিজের কাজটা মন দিয়ে করে যাও কেবল।’