ভবানীপুরে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতবেন, এ নিয়ে কোনও সংশয় ছিল ন তবে কত ভোটের ব্যবধানে জিতবেন, তা নিয়ে তৃণমূলে হিসেবনিকেশ চলছিল। প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল হারকেন, একথা অজানা ছিল না গেরুয়া শিবিরের নেতাদের। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারবেন, সেটাই ছিল দেখার।
বলাবাহুল্য, লড়াই তো দূরের কথা, ৩০ হাজারের গন্ডিও পেরোতে পারেননি প্রিয়াঙ্কা। ভবানীপুরের সবকটি ওয়ার্ডে জয় পেয়েছে মমতা। আসলে এটা ছিল মমতার নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। অতীতের জয়ের ব্যবধানকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই।
সেই লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসলেন বাংলার ‘ঘরের মেয়ে’। রাজ্য তো বটেই, উপনির্বাচনের দিন ঘোষণার পর থেকে গোটা দেশের নজর ছিল ভবানীপুরের দিকে। কারণ, এখনে প্রার্থী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার কী করবেন তৃণমুল নেত্রী? এই জয় কি জাতীয় রাজনীতিতে নতুন কোনও মাত্রা যুক্ত করবে?
ভবানীপুরে যুদ্ধজয়ের পর ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনকেই তিনি পাখির চোখ করবেন, এই কেন্দ্রে ভোটপ্রচারের সময় তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। একেবারে শেষ পর্বে নিজের কেন্দ্রে এক নির্বাচনী সভায় মমতা বলেছিলেন, ‘ভবানীপুর থেকে জিতে ভারতের জন্য লড়াই লড়তে হবে।
ভবানীপুরে জেতার পর আমরা অন্য রাজ্যেও যাব। বিজেপি শাসিত রাজ্যে কেউ থাকতে পারে না এদের দেশছাড়া করতেই হবে। বিজেপিকে দেশছাড়া করবই।’ লড়াই যতই কঠিন হোক না কেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে কী করে হারাতে হয়, নিজের রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বারবার তার প্রমাণ দিয়েছেন মমতা। ১৯৮৪-তে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।
২০১১ সালে তৃণমূল যখন রাজ্যে ক্ষমতায় আসে, তখনও তৃণমূল নেত্রী লোকসভার সদস্য ছিলেন। পরে উপনির্বাচনে ভবানীপুরকেই তাঁর কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন মমতা। সেবারই প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই। তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সিপিএমের নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। সদ্য ক্ষমতা হারানো সিপিএম প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়েছেন মমতা।
মমতা পেয়েছিলেন ৭৩,৬৩৫ ভোট। আর নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোট ১৯,৪২২। ৫৪,২১৩ ভোটে জয় তৃণমূল নেত্রীর। সেবার মমতার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ভবানীপুরের ৭৭.৪৬ শতাংশ মানুষ। আর নন্দিনী পেয়েছিলেন মাত্র ২০.৪৩ শতাংশ ভোট। ২০১৬ তেও ভবানীপুরেই প্রার্থী হন মমতা।
সেবার তিনি পেয়েছিলেন ৬৫,৫২০ ভোট শতকরা হিসেবে ৪৮,৫৩ শতাংশ আর কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন ৪০,২১৯ টি ভোট। ২৫,৩০১ ভোটে জয়ী হন মমতা। বিজেপির টিকিটে ভোটে দাঁড়ানো নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্রকুমার বসু পেয়েছিলেন ২৬,২৯৯ ভোট। শতকরা হিসেবে ১৯.৪৮ শতাংশ।
২০২১ এর বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রাম থেকে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন মমতা ভবানীপুরে প্রার্থী হন প্রবীণ তৃণমূল নেতা শোভনদের চট্টোপাধ্যায়। শোভনদেবের পক্ষে ভোট পড়ে ৭৩,৫০৫ টি। আর বিজেপি প্রার্থী অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ পেয়েছিলেন ৪৪,৭৮৬ টি ভোট। প্রায় ২৯ হাজার ভোটে জয়ী হন শোভনদেব। শতাংশের হিসেবে তৃণমূল ৫৭.৭১ শতাংশ এবং বিজেপি পায় ৩৫.১৬ শতাংশ ভোট।
এবার দেখা যাক লোকসভাভিত্তিক ফলাফল ২০১৪ সালে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন সুব্রত বক্সী সেবার বিধানসভাভিত্তিক ফলাফলে ভবানীপুর কেন্দ্রে বিজেপির থেকে ১৭৬ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন সুব্রত।
২০১৪ তে ভবানীপুর বিধানসভায় তৃণমুল ৪৭,২৮০ ভোট পেয়েছিল। বিজেপি পেয়েছিল ৪৭,৪৫৬ টি ভোট। এছাড়া কংগ্রেস ১৫,৪৮৪ এবং সিপিএম ২১,৯৫৪ টি ভোট পেয়েছিল।
গত লোকসভা অর্থাৎ ২০১৯ এর নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হন মালা রায়। ভবানপুরে এগিয়ে থাকলেও, ভবানীপুরে বিজেপির সঙ্গে ভোটের ফারাক ছিল মাত্র ৩,১৬৮ এ তো গেল ভবানীপুরের ভোটের হিসাব।
তবে এই ভোটের ভল জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় মমতার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিল। আগামী লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বাংলার দিদিকেই মুখ করতে চাইছে তৃণমূল। লেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতাও শুরু হয়ে গিয়েছে ঘাসফুল শিবিরি।
বর্তমান শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কী করে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে পারেন, এই প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। তাই একাধিক রাজ্যে বিশেষত ছোট ছোট রাজ্যে ক্ষমতা বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এর মধ্যে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে গোয়াও। গোয়ার প্রাক্তন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে তৃণমুলে যোগ দিয়েছেন। ত্রিপুরায় শুধু কংগ্রেসে ভাঙন নয়, আগামী দনে তৃণমূলে ভিড়তে চলেছো বিজেপির বহু নেতা। ঘাসফুলে যোগ দিয়েছেন অসমর কংগ্রেস নেত্রী সুস্মিতা দে।
মেঘালয়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন, এমনটাই রাজনৈতিক মহলের খবর পাশাপাশ শরদ পাওয়ার, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অখিলেশ যাদব সহ বিরোধী নেতারাও মমতার পাশে রয়েছেন। অর্থাৎ সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছেন মমতা।