ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হননের স্মৃতি।এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত না হলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এত বড় একটা ঝােড়াে হাওয়া দেখা দিত কিনা সন্দেহের বিষয়।সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের শতবার্ষিকী সদ্য পুর্ণ হল।ভারতবাসী মাত্রেই সেই দিনে হত হাজার হাজার নিরীহ জালিয়ানওয়ালাবাগের মানুষদের জানাবে সেলাম,সেলাম।
সেদিন ছিল পাঞ্জাবিদের নতুন বছরের প্রথম দিন।নববর্ষ।১৯১৯ সাল।১৩ই এপ্রিল।একদিকে সেদিনটি ছিল নববর্ষের বৈশাখী পালনের আনন্দ।অন্যদিকে সেই আনন্দের দিনে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ারও ছিল দিন।অমৃতসর শহর এই দুইয়ে মিলে উত্তাল।জমায়েত হবার মতাে শহরের বড় পার্ক জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রশস্ত অঙ্গন।প্রবেশ পথ ও নির্গমনের পথ একটাই।সেই বাগে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মিলিত হয়েছে বৈশাখীর আনন্দে সর্বজনের সঙ্গে মিলিত হতে আর রাওলাট আইনের প্রতিবাদ করতে।
রাওলাট আইনের বিরােধিতায় ক্রুদ্ধ ইংরেশ শাসক।শহরের প্রশাসক রেজিনাল্ড ডায়ার রাওলাট আইনবিরােধীদের দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা দিতে তৎপর।তাই তার পরের ঘটনা ইতিহাস।সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের জমায়েত হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরীহ প্রতিবাদী মানুষের উপর নেমে এল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি।সেই নিরীহ মানুষগুলো পালাবার পথ পেল না।কারণ সেই বাগে প্রবেশের ও নিষ্ক্রমণের পথ একটাই।অনেক নিরীহ মানুষ তাই পালাতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেল।অন্যরা ডায়ারের সেনাদের ছোড়া ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে দেশমাতৃকার চরণতলে প্রাণ দিল।
পাঞ্জাবে হঠাৎ করে কিন্তু সেইদিন রাজনৈতিক হাওয়া গরম হয়নি।সেই ১৯১৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর ইংরেজ সরকার Rowlatt (Sedition)Committee গঠন করেছিল।স্বদেশি আন্দোলনকে দমন করার জন্য কঠিন আইনকানুন তৈরি করাই ছিল এই কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য।এদিকে গান্ধিজি সত্যাগ্রহের সূচনা করতে চম্পারণে পৌছে যান তার আগেই ৮ই নভেম্বর।এদিকে মন্টেগু ইংলন্ডের হাউস অব কমন্সের প্রতিনিধি দলকে নিয়ে ভারতে পৌছান ১৯১৭ সালের ১১ই নভেম্বর।মন্টেণ্ডকে ভারতে পাঠানাে হয়েছিল ভারতের তৎকালীন স্বদেশি আন্দোলনজনিত পরিস্থিতির পর্যালোচনা করার জন্য।মন্টেগুর ভারত পর্যালােচনার সময় বরাদ্দ ছিল সাড়ে পাঁচ মাস।মন্টেগু সর্বপ্রথমে দেখা করেছিলেন ‘এলাহাবাদ লিডার’ পত্রিকার সম্পাদক চিন্তামণির সঙ্গে।তারপরে দিল্লিতে এসে দেশের রাষ্ট্রনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে একে একে সাক্ষাৎ করেন।মন্টেগু কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন ৮ই ডিসেম্বর ১৯১৭ তারিখে।রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখেন ও নানা বিষয়ে কথা বলেন।তাঁর মন্তব্য,“Rabindranat,the poet,has come out as a politician because of the horror of the internees”। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মন্টেগুর দেখা করার দুদিন পরে ১০ই ডিসেম্বর ভারতের ইংরেজ শাসক ভাইসরয় ঘোষণা করেন Rowlatt(Sedition)Committee।ইংরেজ শাসনের কী দারুণ দ্বিচারিতা!একদিকে মন্টেগুর আলােচনা, অন্যদিকে দমনের কামান শানানাে।
কিন্তু স্বদেশি আন্দোলন আরও উগ্ররূপ নিল।বছর গড়ালাে নানা আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে।১৯শে মার্চ ১৯১৮,গান্ধিজি তাঁর ‘সাধারণ হরতালের’ পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।তার দুই দিন পরে ২১শে মার্চ ১৯১৮ Rawlatt Act-Anarchical and Revolutionaries Crimes Act XI ভাইসরয়ের সম্মতি পেয়ে আইনে পরিণত হয়।৩০শে মার্চ এই আইনের বিরুদ্ধে দিলিতে পালিত হল হরতাল।৬ই এপ্রিল থেকে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারতে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হল।
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দুর্মর রূপ নিল অমৃতসরে।প্রত্যহ সেখানে বিক্ষোভ জমায়েত শােভাযাত্রা।১০ই এপ্রিল এই অমৃতসরের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পুলিশের অত্যাচার হিংস্র রূপ নিল।মারা গেল পাঁচজন ইংরেজ।পুড়ল বাড়িঘর একজন ইংরেজ মহিলাও নিহত হলেন এই আন্দোলনের জেরে ইংরেজ শাসক ক্রুদ্ধ।অবস্থা সরেজমিনে দেখতে পাঠানাে হল সৈন্যবাহিনীর চতুর্থ ব্রিগেডের কমান্ডার ডায়ারকে।ডায়ার এলেন অমৃতসরে।অমৃতসরে জমায়েত এবং শােভাযাত্রা নিষিদ্ধ হল।সেই সময়ে পাঞ্জাবের গভর্নর ছিলেন মাইকেল ও ডায়ার।কমান্ডার ডায়ারের দমনমূলক কার্যক্রমে গভর্নর ও ডায়ারেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল।ফলে দমন রূপ নিল সন্ত্রাসের।ডায়ার নিমর্ম হলেন।
এখন আমাদের আলােচ্য জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পটভূমি।পাঞ্জাবের মানুষ রাওলাট আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সারা ভারতের আন্দোলনের অংশীদার।পাঞ্জাবের সচেতন মানুষ ১৯১৭ সালে রাওলাট কমিটির গঠনের সময় থেকেই তার প্রতিবাদে মুখর।তারপর ১৯১৮ পেরিয়ে ১৯১৯ সালে যখন রাওলাট আইন বিধিবদ্ধ হল,ডাইসরয়ের সম্মতি পাবার পরে,তখন উত্তাল হল পাঞ্জাব।তারই প্রতিফলন অমৃতসরে।তারই প্রতিফলন জালিয়ানওয়ালাবাগের পার্কে।এই উত্তাল আন্দোলনই কমান্ডার ডায়ারকে ডেকে এনেছিল।ইংরেজ শাসন যে কত পৈশাচিক নৃশংসতা অবলীলাক্রমে নামিয়ে আনতে পারে নিরস্ত্র অসহায় মানুষের উপর তার স্বাক্ষর রেখে গেছে জালিয়ানওয়ালাবাগে ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯ সালে।শাসন ও শােষণের চাহিদা এত বেশি ছিল যে তার তুলনায় হাজার হাজার মানুষকে হুশিয়ারি দিয়ে অতর্কিতে ঝাকে ঝাকে গুলিবর্ষণ করে মেরে ফেলা সহজ।শােষণ শাসনের ইতিহাসে তাই পৃথিবীর ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড একটি একক এবং অদ্বিতীয় ঘটনা।সাম্রাজ্যবাদী শােষণের শাসনের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লেখা এই ইতিহাস।তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে এই মর্মান্তিক ঘটনা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি দিশারী সংকেত।কেননা এই ঘটনা থেকে সকলে জানতে পেরেছে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ ভারত লুণ্ঠনের জন্য কী পরিমাণে অত্যাচার নামিয়ে আনতে পারে সাধারণ মানুষের উপর।তাই শতবর্ষেও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড আমাদের স্মরণীয়,সকল সচেতন মানবতাবাদী বিশ্বের মানুষের স্মরণীয়।
এবারে আমরা দেখব এই হত্যাকাণ্ড পরাধীন ভারতের বুকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাঝ দরিয়ায় কী প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল প্রথমে,সেই বৈখাশীর দিনে নববর্ষের দিনে পাঞ্জাবের মানুষ যখন আনন্দ উৎসব করছে তখন হঠাৎ করে এই ডায়ারের হত্যালীলা এক বিষাদের ছায়া ফেলে অমৃতসরের আকাশেবাতাসে।মুহূর্তের মধ্যে এই হত্যালীলার সংবাদ অমৃতসর শহরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে যায়।মানুষজন ছুটে আসে জালিয়ানওয়ালাবাগের চত্বরে।কেউ বলে আমার বাবা কোথায় ? কেউ খোঁজ করে তার ছেলেকে।কেউ বলে,আমার মেয়ে কোথায়?কেউ খোঁজে তার হারানাে মাকে।চারিদিকে যখন খোঁজাখুঁজি চলছে তখন ডায়ারের অনুচররা ট্রাকে করে মৃতদেহ পাচার করতে ব্যস্ত।ইংরেজ সরকার ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের কথা যদি সংবাদমাধ্যমে ভারতময় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে তবে সর্বনাশী স্বদেশি আগুন জ্বলবে।পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষ ছিছিক্কার করবে।তাই সংবাদপত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ হল।পাঞ্জাবের বাইরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংবাদ মে মাসের গােড়াতে জানতে পেরেছিলেন দীনবন্ধু এন্ড্রুজ।তিনি এই ভয়াবহ নৃশংসতার সংবাদ জানিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে।
জালিয়ানওয়ালাবাগে এই নিদারুণ হত্যাকাণ্ডে বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিবরণ জানিয়েছিলেন গান্ধিজিকে।রবীন্দ্রনাথ গান্ধিজিকে অনুরােধ করেছিলেন পাঞ্জাবে যেতে।কিন্তু গান্ধিজি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবে রাজি হননি।বলেছিলেন, I do not want to embarrass the Government now’|গান্ধিজির এই মনােভাবে হতাশ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।কিন্তু তিনি সেখানেই থেমে থাকেননি।তিনি অন্যান্য জননেতাদের কাছেও আবেদন করেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে।এমনকী তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতেও গিয়েছিলেন একই আবেদন নিয়ে।কিন্তু গান্ধিজির মতােই দেশবন্ধু জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্দোলনে সামিল হতে রাজি হননি।এইভাবে আশাহত কবিগুরু কিন্তু শাসকের এতবড় অত্যাচারে নীরব হয়ে যাননি।তার বিবেক তাকে প্রতিবাদে মুখর হতে বলেছে।তাই তিনি ৩১শে মে ভাইসরয় চেমসফোর্ডকে জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠান।এই প্রতিবাদপত্রের মাধ্যমে যেমন প্রকাশিত হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্লীতি,অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানােতে তাঁর অদম্য সাহসিকতা,অন্যদিকে প্রকাশিত হয়েছে স্বদেশি নেতাদের অতিক্রম করে বিদেশি শাসককে রক্তচক্ষু প্রদর্শন সেই সঙ্গে তিনি ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করলেন,ফিরিয়ে দিলেন ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড খেতাব।ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে তাই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড যেমন এক চালিকাশক্তি তেমনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ ও নাইটহুড খেতাব বর্জন এক নতুন দিশা।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বের দাপটে পরবর্তীকালে গান্ধিজিকেও পাঞ্জাবের অমৃতসরে যেতে হয়েছিল।মুখর হতে হয়েছিল প্রতিবাদে।দেশবন্ধুকেও দেশমাতৃকার সেবায় এগিয়ে যেতে হয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগকে মন্ত্র করে।এই ঘটনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম,সাহসিকতা এবং দূরদৃষ্টি প্রমাণিত হয়।সেই সঙ্গে প্রকাশিত হয় দেশনেতাদের দিশাহীনতা এবং যথার্থ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা।রবীন্দ্রনাথ যেমন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সর্বভারতীয় পরিমণ্ডলে প্রতিবাদ করেছিলেন তেমনি প্রতিবাদ করেছিলেন স্বদেশিয়ানায় সক্রিয় একজন অধ্যাপক।সেই অধ্যাপক হচ্ছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।তিনি কেবল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি,প্রতিবাদ করেছিলেন রাওলাট আইনেরও।তাই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের শতবর্যে আমরা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কেও স্মরণ করব।
লেখক জাতীয় স্তরের এক শিক্ষক।