করােনার দ্বিতীয় ঢেউতে চিরদিনের মতাে নীরব হয়ে সাহিত্যের এক অমােঘ ‘শঙ্খ রব। ৮৯ বছর বয়সে প্রয়াণ ঘটল কবি শঙ্খ ঘােষের। হঠাৎই চুপ করে গেল তাঁর কবিতার মুহুর্ত বেশ কিছুদিন ধরেই সর্দি কাশিতে ভােগার পরে গত সপ্তাহেই করােনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘােষ।
এছাড়াও নানা বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন বাড়িতেই আইসােলেশনে ছিলেন। তার সঙ্গেই করােনা আক্রান্ত হয়েছে তার স্ত্রী। তার ছােট মেয়ের পরিবার এমনকী বাড়ির পরিচারিকারাও করােনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। করােনা রিপাের্ট পজেটিভ আসার পর থেকে বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল শঙ্খ ঘােষের।
বুধবার সকাল থেকেই অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমছিল। বুধবার সকাল সাড়ে এগারােটা নাগাদ ঘুমের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে। কোভিড সুরক্ষাবিধি মেনেই এদিন কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যান গুণমুগ্ধরা।
শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন পুর ও নগরােন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সাধন পাণ্ডে। কলকাতা পুলিশের তরফেও তাকে পুস্পার্ঘ্য দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। শঙ্খ ঘােষের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমবেদনা জানিয়ে ফোন করেছিলেন শঙ্খ ঘােষের মেয়েকে।
মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন গান স্যালুট দিয়ে পুর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হােক। কিন্তু গান স্যালুট পছন্দ করতেন না কবি শঙ্খ ঘােষ। এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘অন্ত নিয়ে এতটা ভেবাে। মৃত্যুপথে যেতে দাও মানুষের মতাে মতাে মর্যাদায় …।
তাই তার ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে তােপধ্বনি, গান স্যালুট ছাড়াই, কবির ‘শব্দ হীন হওয়ার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নিমতলা মহাশ্মশানে বুধবার বিকেলে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।
তাঁর পরিবারের মানুষজন আর অল্প কয়েক জুন সুহৃদ-পরিজনের উপস্থিতিতে। তখনও কানে বাজছিল তাঁর সেই লেখা কয়েকটা লাইন।’ গহ্বরে মিলিয়ে যায় স্বর। স্তব্ধ শ্বস। তারপর তিনি ফিরে তাকালেন আমাদের দিকে বললেন, এবার আসুন এক শতাব্দী আমরা নীরব হয়ে যাই।’
এমনভাবেই আমাদের শােকস্তব্ধ করে মহাপ্রস্থানের পথে রওনা দিলেন কিন্তু কবির যে মৃত্যু নেই। তাই তার শিব্দের পবিত্র শিখা অমর হয়ে রয়ে যাবে। তিনিই তাে শব্দ দিয়ে অন্তরের নীরবতাকে বাত্মায় করে তুলতে শিখিয়েছিলেন।
জীবনানন্দ পরবর্তী সুনীল, শক্তি, উৎপল, কিয়, শঙ্খ ঘােষ কৃত্তিবাস যুগের এই পাঞ্চজনের বাকিরা আগেই বিদায় নিয়েছিলেন। এবার পাঞ্চ জনের শেষ ‘শ’নাদ থেমে গেল। পূর্ব বাংলার বরিশালে জন্ম তার তাই সারাজীবন ওপার বাংলাতেই নিজের শিকড়ের সন্ধান করেছেন। তাঁর নিজের কথায় বহু বছর এই বাংলায় থাকলেও মনে মনে যেন কোথাও চির উদ্বাস্তু হয়ে রয়ে গিয়েছেন।
পনেরো-ষােলাে বছর বয়সে, স্বাধীনতার বর্ষে এই বাংলায় এসেছিলেন শঙ্খ ঘােষ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। যাদবপুর, দিল্লি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন।
পাশাপাশি চলেছে তার সৃজনশীল সাহিত্য রচনার কাজ। কবিতার পথে যেতে যেতে থেমেছেন গদ্য সাহিত্যের প্রান্তরে। সেখানেও বুনে দিয়েছেন সৃষ্টিবীজ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, ওকাম্পাের রবীন্দ্রনাথ, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, এ আমির আবরণ– ইত্যাদি একাধিক সাহিত্য রচনায় তিনি শব্দের ঈশ্বর, বােধের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৭৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে তার ‘বাবরের প্রার্থনা’। দুবার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় ‘রক্তকল্যাণ’ নাটকটি অনুবাদ করে দ্বিতীয় বার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ২০১১ সালে পেয়েছিলেন পদ্মভূষণ এছাড়াও পেয়েছেন দেশিকোত্তম, রবীন্দ্র পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান।
দীর্ঘ কর্মজীবনে নানান ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়ায় ‘রাইটার্স ওয়ার্কশপ’ এও সামিল হন। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় রাস্তাতে নেমেও পথ হাঁটেন, সরব হন শব্দের নিঃশব্দ তর্জনী তুলে।
শরীর শক্ত হলেও তার লেখনী ছিল সচল। বছর দুয়েক আগেও ‘মাটি’ নামে একটি কবিতায় কেন্দ্রীয় সরকারের সংশােধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে। গর্জে উঠেছিলেন। আজীবন তার শব্দের শান্ত অথচ দূরবাহী নিঘোষ তৈরি করেছে ‘শঙ্খনাদের মতাে। সেই ‘শঙ্খ’ এবার নীরব হল।