সম্পূর্ণ হল বৃত্ত। কানপুরের গ্যাংস্টার বিকাশ দুবে’কে ধরতে গিয়ে গুলিবৃষ্টির মুখে পড়তে হয়েছিল একদল পুলিশকর্মীকে। বিকাশকে ধরতে যাওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছিল ৮ পুলিশকর্মী-অফিসারের মৃত্যুর বিনিময়ে। ৮-এর বদলে আপাতত ৫। ইতিমধ্যে বিকাশের পাঁচ সহযোগীর মৃত্যু হয়েছে এনকাউন্টারে। সঙ্গীদের মতো তারও যে পরিণতি এমন হতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল বিকাশের। সেই আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল।
শুক্রবার বিকাশ দুবের এনকাউন্টারের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল কানপুরের গ্যাংস্টারের অধ্যায়। বিকাশ নিহত হলেও এই অধ্যায় যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে না তা অবশ্য বিরোধী দলগুলির শীর্ষ নেতাদের প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট। ভুয়ো সংঘর্ষের ইঙ্গিত দিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি উঠেছে বিরোধীদের পক্ষ থেকে। যোগীর রাজ্যে বিকাশ খতম হলেও যারা বিকাশকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেছে তাদের কি হবে। এরকম একাধিক প্রশ্নকে সামনে রেখে বিকাশের এনকাউন্টার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
পুলিশের এনকাউন্টারে বিকাশ দুবে’র মৃত্যু নিয়ে নানা ব্যাখ্যা উঠে এসেছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশকর্তাদের মুখ থেকে। এই পুলিশ কর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ৮ পুলিশকর্মী খুনের ঘটনায় জড়িত বিকাশের কঠোরতম সাজা দ্রুত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ৮টি প্রশ্নে উঠে এসেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।
প্রথম প্রশ্ন: কিভাবে বিকাশ তার গাড়ি উল্টে যাওয়ার পরেও চার পুলিশকর্মীকে এড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল? কিভাবেই বা পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিল সে?
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দাবি: দুর্ঘটনায় গাড়ি উল্টে চার জওয়ান জখম হন। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিকাশ।
তাহলে প্রশ্ন এখানে, কিভাবে অক্ষত থাকল বিকাশ?
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে বলছেন, গুলির আওয়াজ অনেকে শুনেছেন। কিন্তু গাড়ি যে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছে তেমন প্রত্যক্ষদর্শী কোথায়? কনভয়ের অন্য গাড়ি পুলিশকর্মীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ২০০ মিটার চলে গেল। এই নিয়েও রহস্য। কেউ কিছু দেখল না। এও কি সম্ভব? ৫২ বছরের বিকাশের পায়ে জখম ছিল। ফলে সে কিভাবে দৌড়ে পালাল, তা নিয়েও প্রশ্ন। এই প্রশ্ন উসকে দিয়েছেন পুলিশেরই প্রাক্তন ডিজি এন সি আস্থানা। এদিন টুইটে বলেছেন, চারদিকে তো ফাঁকা মাঠ। বোকাসোকা কোনও মোটা লোক এক্ষেত্রে কোথায় পালানোর ঝুঁকি নেবে?
প্রশ্ন দুই: গাড়ি উল্টে গেল, তাও গাড়ি অক্ষত?
পুলিশের দাবি: বৃষ্টিভেজা পথে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস আস্থানা প্রশ্ন তোলেন, ‘গল্পটা বেশ ভয়ানক। গাড়িটা তো দেখছি সুবিধামতো জায়গায় শোয়ানো আছে। চারটি দরজা বন্ধ। রাস্তার হালও ঠিকঠাক। এত মলায়েমভাবে গাড়ি উল্টে যাওয়া কেউ কখনও দেখেছেন? ওই সাদা গাড়ির একটি মাত্র জানলার কাচ ভেঙেছে। বৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোনও গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে এত কম ক্ষয়ক্ষতি কি সম্ভব?
প্রশ্ন তিন: আত্মসমর্পণ করেছিল। তাও কেন পালানোর চেষ্টা? মধ্যপ্রদেশের পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের পরে ভিড়ের মধ্যে বিকাশ নিজেকে পরিচয় দিয়েছিল ‘কানপুরওয়ালা’ বলে। এখানেও আস্থানার প্রশ্ন, বিকাশের যদি পালানোর মতলব থাকে, তবে সে কেন গিয়েছিল মন্দিরে পুজো দিতে। কারণ, গত এক সপ্তাহে তার পাঁচজন সহযোগীর কি পরিণতি হয়েছিল তা তার অজানা নয়।
প্রশ্ন চার: বিকাশ দুবে যে একাউন্টার হতে পারে তার ইঙ্গিত মিলেছিল এক পুলিশ অফিসারের মন্তব্যে। বৃহস্পতিবার এক ভিডিওতে উজ্জয়িনীর এক পুলিশ অফিসারের মন্তব্য এখন ভাইরাল। ওই অফিসারকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আশা করব বিকাশ শেষ পর্যন্ত কানপুর পৌছবে না। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতে সুপ্রিম কোর্টে ধৃত
বিকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করানোর জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিকাশের গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যের এনকাউন্টারের ঘটনারও সিবিআই তদন্তের আর্জি জানানো হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেই আবেদনের শুনানির আগেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বেছে নিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশ?
প্রশ্ন পাঁচ: গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই কেন গাড়ি বদল? এনকাউন্টারের ঘণ্টা তিনেক আগে যে গাড়িটিকে দুর্ঘটনাগ্রস্ত দেখানো হয়েছে তাতে ছিল না বিকাশ। ভোর চারটে নাগাদ টোলপ্লাজার সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, উজ্জয়িনী থেকে কানপুরগামী পুলিশ কনভয়ের অন্য একটি এসইউভি’তে ছিল বিকাশ। মাঝরাস্তাতেই তাহলে গাড়ি বদল হয়েছিল। উজ্জয়িনী থেকে ৬৫০ কিলোমিটার রাস্তা ইসইউভি’তে বিকাশকে আনা হয়েছিল বলে জানাচ্ছে ওই কনভয়ে আসা সাংবাদিকরা। আর সেই গাড়ি বদলানো হয় গন্তব্যে পৌঁছনোর মাত্র কয়েক কিলোমিটার আগে।
পুলিশের দাবি: নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক সময় এভাবে গাড়ি বদলে আনা হয় অপরাধীকে। কারণ, আশঙ্কা ছিল বিকাশের গ্যাংয়ের অন্য অপরাধীরা তাকে ছিনিয়ে নিতে পারে।
প্রশ্ন ছয়: সাংবাদিকদের কেন আটকানো হল? পুলিশ কনভয়ের পিছু নিয়েছিল উজ্জয়িনী থেকেই সাংবাদিকরা। কিন্তু ভোর সাড়ে ৬টা নাগাদ কানপুর জেলার সীমানায় সাংবাদিকদের গাড়িগুলো আটকে দেয় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। আর তার আধ ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক কিলোমিটার দূরে হয় এনকাউন্টার। এনিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশ্ন সাত: সামনে থেকে তিনটি গুলি কেন? বিকাশের কোমর, হাত এবং বুকে তিনটি গুলিই বলছে এই ঘটনা সাজানো পুলিশ সংঘর্ষের তথ্য। এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞদের এমনটাই ধারণা। খুব সামনে থেকেই এই গুলি চালানো হয়েছে।
পুলিশের ব্যাখ্যা: প্রথমে বিকাশকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে তা না শুনে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে সে জখম হয়। সেকারণে মুখোমুখি লড়াই হয়। এর ফলেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে বিকাশ।
প্রশ্ন আট: কেন হাতকড়া ছিল না? গত তিন দশক ধরে কমপক্ষে ৬০টি অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল বিকাশ। এর মধ্যে থানায় ঢুকে প্রতিমন্ত্রীর স্তরের এক রাজনৈতিক নেতাকে খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিকাশ হাইকোর্টের নির্দেশে জামিনও পেয়েছিল। তৈরি করেছিল বড় গ্যাং। অপরাধ জগতের সঙ্গে তার সহবাস। কিন্তু ৮ পুলিশকর্মীকে খুনের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশকে। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই, এমন এক অপরাধীকে আনার সময় কেন হাতকড়া পরানো হয়নি? অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, শুধু হাতকড়া নয়, পলাতক বা ভয়ঙ্কর অপরাধী বা জঙ্গিদের কোথায় নিয়ে যেতে হলে গাড়ি করে প্রয়োজনে পায়ে শিকল পরানো হয়। এক্ষেত্রে কোনওটাই করা হল না কেন?
বিকাশ খতম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেক প্রশ্নের উত্তর অধরা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিশিষ্ট আইনজীবী কপিল সিব্বল টুইট করে বলেছে, ‘বিকাশ দুবে যে এনকাউন্টার হতে পারে এর সম্ভাবনা আঁচ করা গিয়েছিল। বিকাশের সঙ্গে কিছু ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের যোগাযোগের প্রমাণ লোপাট করতে এই ষড়যন্ত্র। পুলিশ-অপরাধী যোগাযোগের তদন্তের জন্য কমিশন গড়া প্রয়োজন।
গত বছর তেলেঙ্গানায় গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় পুলিশ চার অভিযুক্তকে এনকাউন্টার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশেরই যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিকাশ খতমের ঘটনায়ও নিয়মনীতি মেনে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের নির্দেশ দিয়েছেন তদন্তের। এখন সবাই অপেক্ষা করছে রিপোর্টের। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত বিকাশ অধ্যায় কোন দিকে গড়ায়।