বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় বৈঠক থেকে আভাস মিলেছে লকডাউনের সময়সীমা বৃদ্ধি করার পক্ষে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন একটানা ৪৯ দিন লকডাউন করতে পারলে ভালো হয়।
বুধবার নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, লকডাউনে মানুষের কষ্ট হলেও করোনা এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই বাজারে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, সজি, ওষুধ সবই পাওয়া যাচ্ছে, এই অবস্থায় যদি আমরা কষ্ট করেও যদি ১৫ মে পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে পারি, তাহলে ক্ষতি কি? যদিও লকডাউন বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। আমাদের যখন জানতে চাওয়া হবে তখন মতামত দেব। আপাতত আমরা পরিস্থিতির নজর রাখছি।
মুখ্যমন্ত্রীর এহেন বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়, করোনার সময়সীমা বৃদ্ধিতে তাঁর সায় রয়েছে। তবে মমতার কথায়, লকডাউনকে মানবিকভাবে দেখা উচিত। তাই লকডাউনে কড়াকড়ি হোক, বাড়াবাড়ি নয়। তবে লকডাউনের নিয়মশৃঙ্খলা বাজারে গেলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করা ইত্যাদি অবশ্যই মেনে চলতে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
এদিকে লকডাউনের মেয়াদবৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণ, ছাড় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটেয় চেম্বার অফ কমার্স, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প, হোটেল এবং পর্যটন শিল্পের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা জানান, করোনা মোকাবিলায় এ পর্যন্ত তিনটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে রাজ্যে। একটি লকডাউন নিয়ন্ত্রণ ও ছাড়ের বিষয়ে নজরদারি করবে। অন্যটি করোনায় অর্থনৈতিক সংস্কার দেখভাল করবে। আর একটি টাস্ক ফোর্স এনফোর্সমেন্ট বিভাগের সদস্যদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যাঁরা করোনা সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে তদন্ত এবং তার প্রতিবিধানের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।
মুখ্যমন্ত্রী বুধবার সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন, নিজামুদ্দিন জমায়েত নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। ১৩ মার্চ নিজামুদ্দিন জমায়েতের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্র। সেখানে অনেক বিদেশিও যোগ দিয়েছে। তাদের পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বিদেশ মন্ত্রকের কাছেই ছিল। আমাদের রাজ্যকে এই নিয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু জানানো হয়নি। অথচ তার বহু আগেই জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে কেরলে প্রথম করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছে। তার পরেও দিল্লিতে দাঙ্গা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে একটা বিপর্যয় হয়েছে।
লকডাউন চালু হওয়ার পর আজ থেকে দিন দশেক আগে যখন আমাদের কাছে তথ্য এসেছে প্রশাসন অত্যন্ত দায়িত্বশীলভাবে বিষয়টি দেখেছে। নিজামুদ্দিনে যোগ দেওয়া ১০৮ জন বিদেশিকে চিহ্নিত করে তাদের রাজারহাটের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রাখা হয়েছে। এরা মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের মানুষ। এই রাজ্য থেকেও ৬৯ জন নিজামুদ্দিন জমায়েতে গিয়েছিলেন। হজ কমিটির সহযোগিতায় তাদেরও রাজারহাটের হজ হাউসে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
নিজামুদ্দিন নিয়ে করোনাকে সাম্প্রদায়িক ইস্যু করে তোলা উচিত নয় বলে মনে করেন মমতা। কারণ রোগ কোনও ধর্ম, জাত, সম্প্রদায়কে দেখে আসে না। করোনা নিয়ে ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস’ নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা উচিত নয় বলেই মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী।
বুধবার সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যে এখনও পর্যন্ত করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। ৭১ জনের অ্যাকটিভ করোনার সংক্রমণ মিলেছে। এদের মধ্যে ৬১ জনই ১১’টি পরিবারের। রবিবার এনআরএস-এ করোনায় আক্রান্ত এক রোগির মৃত্যুর পরে সাবধানতা অবলম্বন করতে ওই হাসপাতালের যেসব ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছিল, তাদের সকলেরই রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
বর্তমানে এনআরএস-এর ৩০ জন ডাক্তার, ৫ জন নার্স, ৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী সকলেই বিপন্মুক্ত। এই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন, বেলেঘাটা আইডিতে যে ১৬ জন ভর্তি রয়েছেন তাদের মধ্যে ৩ জন সুস্থ হয়ে বুধবারই বাড়ি ফিরছে। আরও ২ জনের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে করোনা সংক্রমণের বেশিরভাগই হচ্ছে পরিবারিক সদস্যের পরস্পরের মধ্যে। তাই একই পরিবারে থাকলে ব্যবহারের জিনিস এমনকী বাসনপত্রও আলাদা রাখুন। সেইসঙ্গে মাস্ক ব্যবহার করা, বাজারে গেলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও জরুরি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাজার চালু আছে বলে ভিড় বাড়াবেন না। কিষাণ বাজারে বিক্রেতারা জিনিসপত্র বিক্রির সময় কিছুটা দূরে দূরে ইট পেতে রাখুন। এই সচেতনতার জন্য ক্লাব এবং এনজিওগুলিও এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানান মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন আশ্বস্ত করে বলেন, করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা তথাকথিত ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন যথেষ্টই মজুত রয়েছে রাজ্যে। দেশের পাঁচটি কোম্পানি এই ওষুধ তৈরি করে। এর মধ্যে গুজরাতের একটি কোম্পানিকে আমেরিকায় এই ওষধ সাপ্লাই করতে বলেছে কেন্দ্র। বুধবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মমতা জানান, কিছু কিছু ব্র্যান্ডেড ওষুধ হয়তো পাওয়া যাচ্ছে না। এই বিষয়ে মুখ্যসচিব তথা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন তিনি।
বুধবারের সাংবাদিক সম্মেলনে কোভিড পলিসির উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক ডা. অভিজিৎ চৌধুরী জানান, করোনার প্রতিষেধকের বিষয়ে হু’ যে স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল অনুযায়ী করোনায় সুস্থ ব্যক্তিদের রক্ত নিয়ে চিকিৎসার কাজে লাগানোর যে প্রতিবিধান দিয়েছে সেই গবেষণায় পিছিয়ে নেই এই রাজ্যের বিজ্ঞানীরাও।
অভিজিৎবাবু বলেন, করোনা মোকাবিলায় রাজ্য সরকার চিকিৎসা সরঞ্জাম যোগাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কোভিড হাসপাতালগুলিকেও চিকিৎসার উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই সুত্রে অভিজিৎবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে এসএসকেএম-এর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. ঢালি এবং তিনি আজই রওনা হচ্ছেন উত্তরবঙ্গে।
তিনি জানান, সফটওয়্যার দিয়ে করোনা আক্রান্তদের ট্র্যাকিং করার চেষ্টা চলছে। এদিন ডাক্তার সুকুমার মুখার্জিও বলেন, আমরা রিজিওনাল কোয়ারেন্টাইন বা জিওগ্রাফিক্যাল কোয়ারেন্টাইনের কথা ভাবছি। যেসব এলাকা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হবে সেখানকার আক্রান্তদের নজরবন্দি করে ছোট জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী আগেই জানিয়েছিলেন রাজ্যের সাতটি জায়গা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কোন সাতটি জায়গা তা অবশ্য গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থেই জানাতে চাননি মমতা। তবে বৃহস্পতিবার নবান্নে দুই চিকিৎসকদের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, হটস্পট এলাকায় বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ চালাতে সবরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য।