• facebook
  • twitter
Friday, 25 April, 2025

হয় খেলো, না হলে জায়গা ছাড়ো

তিলক সেই ম্যাচে খেলতে না পারলেও পরের ম্যাচেই রানে ফিরেছেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ২৯ বলে ৫৬ রান করেছেন। চারটি চার এবং চারটি ছক্কা মেরেছেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

চিত্রপট ১: টস জিতে দিল্লি ক্যাপিটালসের অধিনায়ক অক্ষর প্যাটেল বল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শুরু থেকে ফিল সল্ট যে ভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন, তাতে বিপদ হতেই পারত। হল না বিরাট কোহলির ভুলে। সল্ট এক্সট্রা কভারের দিকে বল মেরে রান নেওয়ার জন্য এগিয়েছিলেন। কোহলি প্রথমে সেই ডাকা সাড়া দিলেও মাঝপথ থেকে সল্টকে ফিরতে বলেন। কিন্তু পা পিছলে সল্ট পড়ে যান। তাঁর পক্ষে ফেরা সম্ভব হয়নি। যে ব্যাটার প্রথম ৪ ওভারে ৬২ রান তুলে দিয়েছিলেন, সেই সল্ট আউট হতেই ধাক্কা খায় দল। পরের দু’ওভারে মাত্র ২ রান উঠল। গোটা ব্যাটিং ধাক্কা খেল সেখানেই। কোহলি বুঝতে পেরেছিলেন রান নিতে গেলে তিনি আউট হতে পারেন, সেই কারণেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সল্টকে। নিজের উইকেট বাঁচাতে গিয়েই কি দলের বিপদ ডেকে আনলেন?

চিত্রপট ২: ঘরের পরিবেশ, বিশেষ করে পিচ নিয়ে ইতিমধ্যেই নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন অজিঙ্ক রাহানে। ইডেনে লখনউ সুপার জায়ান্টসের কাছে হারের পর কেকেআর অধিনায়ক জানিয়েছিলেন, আইপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ জানাবেন তিনি। অথচ দু’দিন পরেই অন্য সুর শোনা গেল দলের সহ-অধিনায়ক বেঙ্কটেশ আয়ারের গলায়। জানালেন, চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে সব পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। তবে কি কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়কের মধ্যে কি মতের মিল হচ্ছে না? নইলে কেন দু’রকম কথা বলছেন তাঁরা?
চিত্রপট ৩: প্রথম বার আইপিএলে খেলতে নেমেই সফল প্রিয়াংশ আর্য। অন্যতম চমক হয়ে উঠেছেন তিনি। চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে মাত্র ৩৯ বলে শতরান করেছেন তিনি। অথচ তার আগের দুই ম্যাচে রান পাননি তিনি। রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন। প্রিয়াংশের এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছেন দু’জন। প্রিয়াংশই সে কথা জানিয়েছেন। আইপিএল অভিষেকে গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে ২৩ বলে ৪৭ রান করেছিলেন প্রিয়াংশ। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে রান পাননি তিনি। লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে ৮ ও রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে শূন্য রানে আউট হন। কিন্তু তার পরেও তাঁর উপর ভরসা দেখিয়েছেন পঞ্জাবের কোচ রিকি পন্টিং ও অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ার। এই দু’জনের পরামর্শ মেনেই সফল হয়েছেন প্রিয়াংশ।

তিনটি চিত্রপটেই একটি বিষয় স্পষ্ট এবং সেটা হল সাফল্য পেতে সবটা উজাড় করে দিতে হবে,এবং সে ব্যাপারে সবাই নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ক্রিকেট যত বাণিজ্যিক হচ্ছে, তত এই বার্তা প্রকট হয়ে উঠছে যে সাফল্য চাই – যে কোনও মূল্যে। আইপিএল মানেই কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। ক্রিকেটারেরা যেমন কোটি কোটি টাকা পাচ্ছেন, তেমনই দলমালিকেরা বিনিয়োগ করছেন। সব ব্যবসায়ীই লাভ করতে চান। আর ক্রিকেটে যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা চান জিততে। সেখানে কোনও দেশপ্রেম নেই, কোনও ব্যক্তিপুজো নেই। আছে শুধু জেতার লক্ষ্য। আর সেই কারণেই কখনও মাঠেই ভর্ৎসনা করা হয় অধিনায়ককে, আবার কখনও আউট না হলেও তুলে নেওয়া হয় মন্থর ব্যাটিং করা ব্যাটারকে। সবই জেতার কথা ভেবে।

মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বনাম সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ম্যাচে দেখা গেল আউট না হওয়া সত্ত্বেও তিলক ভার্মাকে তুলে নিল মুম্বই। ভারতীয় ক্রিকেটে উঠতি তারকাদের মধ্যে অন্যতম তিলক। দেশের জার্সিতে ইতিমধ্যেই ২৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। দু’টি আন্তর্জাতিক শতরানের মালিক। চারটি এক দিনের ম্যাচও খেলেছেন। এমন এক জন ক্রিকেটার ২৩ বলে ২৫ রান করেছেন বলে তুলে নেওয়া হল আউট না হওয়া সত্ত্বেও। আইপিএলে যদিও ‘রিটায়ার্ড আউট’ নতুন নয়। এর আগে রবিচন্দ্রন অশ্বিন (রাজস্থান রয়্যালস, ২০২২), অথর্ব তাইডে (পঞ্জাব কিংস, ২০২৩) এবং সাই সুদর্শনকেও (গুজরাত টাইটান্স, ২০২৩) মন্থর ইনিংসের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকায় এ বার জুড়ল তিলকের নাম। চেন্নাই সুপার কিংস ডেভন কনওয়েকে একটি ম্যাচে ‘রিটায়ার্ড আউট’ করে। তাঁর বদলে রবীন্দ্র জাডেজাকে নামানো হয়। যদিও শোনা গিয়েছে কনওয়ে নিজেই উঠে যেতে চেয়েছিলেন। সেই কারণ যদিও স্পষ্ট নয়।

কেন হঠাৎ তুলে নেওয়া হল তিলককে? অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া বলেছেন, “আমাদের সেই সময় বড় শট দরকার ছিল। তিলক সেটা পারছিল না। কখনও কখনও এমন দিন আসে, যখন কিছুতেই বল ব্যাটে লাগে না।” অর্থাৎ, অধিনায়ক বুঝিয়ে দিলেন, রান পেলে দলে থাকো, না হলে জায়গা ছেড়ে দাও। যদিও অন্য একটি তথ্যও প্রকাশ্যে আসছে। ক্রিকবাজ় সূত্রে জানা গিয়েছে, তিলক ওই ম্যাচ খেলার জন্য পুরোপুরি ফিট ছিলেন না। সেটা যদিও অধিনায়ক হার্দিক বা কোচ মাহেলা জয়বর্ধনে বলেননি। কোচ বলেন, “আমার মনে হয়েছিল শেষ দিকে তরতাজা কাউকে প্রয়োজন। তিলকের সমস্যা হচ্ছিল। অবশ্যই ওকে বার করে আনাটা সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। কিন্তু আমাকে করতেই হত।”

ম্যাচের আগের দিন হাতের তালুতে চোট পেয়েছিলেন তিলক। ম্যাচ খেলা নিয়ে সংশয় ছিল। ম্যাচের দিন তিলক এবং রোহিত শর্মার শারীরিক পরীক্ষাও করানো হয়। রোহিতের হাঁটুতে চোট ছিল। সেই কারণে তাঁকে খেলানো হয়নি। তিলক খেলার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু রান তাড়া করতে নেমে তাঁকে সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। হয়তো সেই কারণেই তিলককে তুলে নিয়েছিলেন কোচ। বেশি ঝুঁকি নিতে চাননি। ফুটবলে দেখা যায় কোনও খেলোয়াড় চোট পেলে তাঁর জায়গায় অন্য এক জনকে নামিয়ে দিচ্ছেন কোচ। ক্রিকেট মাঠে সেই দৃশ্য বিরল।

কিন্তু মুম্বাই ইন্ডিয়ান দলের কোচ জয়বর্ধনে সেই সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও বলা হচ্ছে, তিলককে যদি তুলে নেওয়াই হল তা হলে আরও আগে তোলা উচিত ছিল। যখন মুম্বইয়ের ১৮ বলে ৪০ রান বাকি ছিল, সেই সময় তুললে অন্তত নতুন ব্যাটার কিছুটা সময় পেতেন। প্রশ্ন উঠছে তিলকের বদলে নামানো মিচেল স্যান্টনারকে নিয়েও। ব্যাটার হিসাবে অবশ্যই স্যান্টনারের থেকে অনেক ভাল তিলক। তা হলে কেন এমন এক জনকে ব্যাট করতে নামানো হল। ২০২২ সালে রাজস্থান রয়্যালস প্রথম বার আইপিএলে ‘রিটায়ার্ড আউট’ নিয়ম ব্যবহার করেছিল। সেখানে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের জায়গায় নামানো হয়েছিল রিয়ান পরাগকে। তিনি নেমেই ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। রাজস্থান ম্যাচটা ৩ রানে জিতে গিয়েছিল। রিয়ানের ৪ বলে ৮ রানের ইনিংস কাজে লেগেছিল। কিন্তু মুম্বইয়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

তিলক সেই ম্যাচে খেলতে না পারলেও পরের ম্যাচেই রানে ফিরেছেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ২৯ বলে ৫৬ রান করেছেন। চারটি চার এবং চারটি ছক্কা মেরেছেন। যা দেখে মনে হয়েছে, লখনউয়ের বিরুদ্ধে তাঁকে মাঠে রেখে দিলে হয়তো মুম্বই জিততেও পারত। কারণ সেই ম্যাচে মাত্র ১২ রানে হেরেছিল তারা।

কারণ যাই হোক, একটা কথা পরিষ্কার করে দিয়েছে আইপিএল। ভারতের জার্সি পরে খেলতে নামলে যেভাবে গোটা দেশ একজন ক্রিকেটারের জন্য গলা ফাটায়, আইপিএলে সেটা হবে না। এখানে টিকে থাকতে হলে প্রতি ম্যাচে রান করতে হবে, উইকেট নিতে হবে। না হলে বসে যেতে হবে। কোটিপতি লিগে কোটি-কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ একজনকে সামলাতে না হলেও টিকে থাকার চাপটা অনেক বেশি। এখানে ক্রিকেট কম,ব্যবসা বেশি। এই ক্রিকেট প্রায় দুই দশক ধরে জমিয়ে চলছে। নতুন ক্রিকেটার উঠছেন, কিন্ত খেলার জাতটা মরে যাচ্ছে।তাতে দর্শকদের কোনও হেলদোল নেই।কারণ ক্রিকেটে শিল্প এখন মৃত, এখন শুধুই বিনোদন। বিনোদন দীর্ঘজীবী হোক।