• facebook
  • twitter
Sunday, 27 April, 2025

নিমাই ভট্টাচার্য এক স্বাভিমানী সাহেবের নাম

নিমাই ভট্টাচার্য আমার মতো তরুণ লেখকের কাছে যেভাবে অকপটে তাঁর বইপ্রীতির কথা জানিয়েছিলেন, তাতে আমি তাঁর উচ্চতায় বিস্মিত হয়ে যাই। বড় তো সেই যে অনায়াসেই ছোট হতে পারে। অথচ এই নিমাই ভট্টাচার্যই স্বাভিমানে ন্যূনতম আঘাতেই জ্বলে উঠেছেন, নিমেষেই তর্ক জুড়ে দিয়েছেন।

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

সময়ের স্মৃতি বেয়ে কথারা আসা যাওয়া করে। কথার মধ্যেই থাকে না-বলা অন্তহীন কথা। সময় ফুরিয়ে যায়, কথাগুলি স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। জ্ঞান যেখানে সীমিত, কল্পনা সেখানে বল্গাহীন। কল্পনার ডানায় ভর করে সেই স্মৃতির দেশে যাত্রা হয়ে ওঠে অভিযান। সেই অভিযানে কথাসাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য(১৯৩১-২০২০)-কে আমার আবিষ্কার। পাঁচ বছর হল তিনি অগস্ত্যযাত্রায় রওনা (২৫ জুন) হয়েছেন। তাঁর প্রকাশের আকাশ আমার নামমাত্র জানা ছিল। সেও ছিল প্রয়োজনে প্রিয়জন হয়ে ওঠার মতো। পত্রউপন্যাসের উদাহরণ হিসাবে ‘মেমসাহেব’ নাম আসতেই তিনিও চলে আসেন। সঙ্গে উত্তম-সুচিত্রার জুটিও আবির্ভূত হয়। ‘মেমসাহেব’কে জেনে আমার সাহেবকে জানা। নিমাই ভট্টাচার্যের মধ্যে আমি একজন সাহেবকেই খুঁজে পেয়েছিলাম।

২০১৫-এর ৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন দিনহাটায় বয়েজ রিক্রিয়েশন ক্লাব আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে আমি নিমাই ভট্টাচার্যকে কাছে পেয়েছিলাম। অথচ মনে ছিল অসীম দূরত্ব। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন সে দেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর আগমন সংবাদের সঙ্গে নিমাই ভট্টাচার্যের আসার কথা জানতে পারি। আসলে সেবার সেই সম্মেলনে আমাকে প্রাবন্ধিক হিসাবে ‘হিতেন নাগ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪’র মনোনীত করা হয়। এজন্য উত্তেজনার বশে কে কে আসছেন তার খবর জানায় উৎসুক হয়ে পড়ি। ক্লাবের সম্পাদক গোকুল সরকার কলকাতা থেকে নিমাই ভট্টাচার্যের আসার কথা জানান। আমার লক্ষ্য ছিলেন আনিসুজ্জামান, উপলক্ষ্যে পেলাম তাঁকে। দীর্ঘ দেহী প্যান্টশার্টে সুশোভিত মানুষটির মধ্যে স্মার্টনেস যেন চুইয়ে পড়ছে। বয়সের ছাপ দেহের ভাষায় পড়েনি। শুধু তাই নয়, বয়স বাড়ানো বা ভারানোর যেমন আয়োজন নেই, বয়স কমানোরও তেমনি প্রয়াস নেই তাঁর। দাড়িগোঁফহীন মুখশ্রীতে আলোর ঝলক। যৌবনের ভালে রাজটীকা দিয়ে তাঁর অনায়াস বিচরণ। তাঁর সাহেবের মেজাজ, সাহেবিয়ানার মর্জি। অথচ মেলামেশায় অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য। অনুষ্ঠানে এসেও তাঁর আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগ না হলেও পরোক্ষে সংযোগ গড়ে উঠেছিল। সেকথায় এবার ফিরে আসি।

সেদিন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে আমাদের বরণ করা হয়। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানও সেই মঞ্চে। পুরস্কারপ্রাপক হিসাবে আমাকে কিছু বলতে হয়েছিল। আমি শুধু ঊনচল্লিশের স্বামী বিবেকানন্দ ও ছাপ্পান্ন’র বঙ্কিমচন্দ্রের পাগড়িশোভিত ব্যক্তিত্বের কথা তুলে ধরে তাঁদের পাকা চুল কীভাবে পাগড়ির আড়ালে সকলের অগোচরে ছিল, সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার পুরস্কারের অনুভূতি ব্যক্ত করি। সুগারের প্রতাপে ততদিনে আমার চুলেও পাক ধরেছে। সেই অকালপক্ব চুল ঢাকার জন্য সেই পুরস্কারটি যে আমার পাগড়ি হয়ে উঠেছে, সেকথাই আমি জানিয়ে দেই। সেখানে মধ্যমণি ছিলেন আনিসুজ্জামান। নিমাই ভট্টাচার্য সেভাবে আমার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ছিলেন না। পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। আবার আমার একটি বইও প্রকাশ করেন তিনি। আমার প্রবন্ধের অনুরাগী পাঠক তথা গবেষক কার্তিককুমার মণ্ডল ইতিমধ্যে আমার প্রবন্ধের একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিল এবং সেটি আনুষ্ঠানিক প্রকাশের তোড়জোড়ও শুরু হয়েছিল। আমি সেটিও সেই মঞ্চে আনিসুজ্জামানের হাতে প্রকাশের কথা কার্তিককে জানাই। আনিসুজ্জামান সানন্দে তা প্রকাশ করেন এবং আমার এরকম বয়সে কারও দ্বারা সম্পাদিত প্রবন্ধ-সংকলন বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অথচ সেই বই প্রকাশের পরে নিমাই ভট্টাচার্য আমাদের পিছনে পিছনে মঞ্চ থেকে নেমে এসে বইটির উদ্বোধকের কথায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি এক কপি ‘স্বপনকুমার মণ্ডল নির্বাচিত প্রবন্ধ-সংকলন’ চেয়ে নেন। এ যে আমার দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ হল সেদিন।

নিমাই ভট্টাচার্য আমার মতো তরুণ লেখকের কাছে যেভাবে অকপটে তাঁর বইপ্রীতির কথা জানিয়েছিলেন, তাতে আমি তাঁর উচ্চতায় বিস্মিত হয়ে যাই। বড় তো সেই যে অনায়াসেই ছোট হতে পারে। অথচ এই নিমাই ভট্টাচার্যই স্বাভিমানে ন্যূনতম আঘাতেই জ্বলে উঠেছেন, নিমেষেই তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। মাথা উঁচু করে আজীবন চলেছেন একাকী। শুধু তাই নয়, সেই মঞ্চে সভাপতিত্ব করার সময়েও তাঁর আলোচকের সচল ভূমিকা লক্ষ করেছি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে চেয়েছেন। সেই নিমাই ভট্টাচার্যই গোকুল সরকারের কাছে আমার মতো অখ্যাত লেখকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লম্বা রেসের ঘোড়া বলে মূল্যায়ন করেছেন। আপাতভাবে তাঁর সাহেবি মেজাজ বা সাহেবিয়ানার মর্জি তাঁকে অনেকের সঙ্গে দূরত্ব রচনায় সক্রিয় করলেও তাঁর অন্তরালের গুণী মানুষটির পরিচয় তাতে ঢাকা পড়েনি। আত্মসম্মানবোধে তিনি একাকী হলেও মানুষের ভালবাসায় তাঁর সহজ সরল স্বচ্ছন্দ বিচরণ অবাধে অকপটে যে সমান সচল ছিল, তাও দেখেছি তাঁর ক্ষণিকের যাপনে। পৃথিবীকে আপন করে যাপন করায় তাঁর সহজতার সাধনাই তাঁকে সৃজনবিশ্ব আজীবন সক্রিয় রেখেছিল। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মানুষটি আজ দিকশূন্যপুরের বাসিন্দা। সেখানেও যে তিনি সাহেবের মতো স্বতন্ত্রবিহারী। মো-সাহেবি যে তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল, দিনহাটাতেই তা প্রত্যক্ষ করেছি।