• facebook
  • twitter
Saturday, 26 April, 2025

বাংলায় ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনা হিসেবে সঙ-এর প্রচলন

কাছারিপাড়া সঙ বের হত উত্তর কলকাতার বারানসি ঘোষ স্ট্রিট থেকে। সঙের মিছিলে পরিহাসমূলক এবং রসাত্মক গানের সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গি থাকতো।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

‘ছো’ বা ‘ছৌ’ নাচের ভিত্তি ভূমি হলো গাজনের ‘ছো’ বা ‘সঙ’। সুধীর করণের মতে ‘ছো’ কথাটির অর্থ হলো ‘সঙ’। ‘ছো’ শব্দটির ওড়িয়া ‘ছু-অ’ (ছলনা) শব্দের সঙ্কুচিত রূপ। এর মাধ্যমে ‘সঙ’ সাজা বা ‘ঢং’ দেখানো বোঝায়। গাজনের সঙ বলতে ছো-নাচকে বোঝায় যা শিব দুর্গার বিবাহকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত এক উৎসব। অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য ছো-নাচকে ‘ছৌ-নাচ’ নামে অভিহিত করেছেন। মানভূম গবেষক দিলীপ কুমার গোস্বামীও মুখে কালি বা মুখোশ পরে নাচকেই ‘ছৌ নাচে’র আদিরূপ বলে মনে করেছেন ।

‘ভারতবর্ষে শিবপূজার প্রাচীনত্ব সমধিক। ইহা বা ইহার আদিম প্রতিরূপ প্রাক্-বৈদিক যুগ হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল এ অনুমান অসঙ্গত নহে। সিন্ধুনদের উপত্যকায় যে সব প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে উহা এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে। বেদের ‘রুদ্র দেবতার রূপকল্পনার মধ্যে এই আদিম দেবতার রূপের কিঞ্চিৎ প্রকাশ ঘটে এবং এই বৈদিক ও অবৈদিক দেবতার সংমিশ্রণে যে ‘শিব’-দেবতার রূপ বিকশিত। হয়, পরে উহাই সাম্প্রদায়িক শৈবধর্মের প্রতীক-দেবতারূপে পরিকল্পিত হয়। সাম্প্রদায়িক শৈবধর্মও যে বৈদিক যুগের শেষের দিকে বিকাশলাভ করিয়াছিল তাহার সাহিত্যগত নিদর্শন পাওয়া যায়।’

বাংলায় শৈবদের সংখ্যা খুব কম ছিল না। এই শিব ভক্তগণ চৈত্র-বৈশাখ মাসে আড়ম্বরের সঙ্গে শিবের আরাধনা করেন। দুই ধরনের ভক্ত বা সন্ন্যাসী এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। যারা চৈত্র মাসে শিবের সাধনা করেন তাদের বলা হয় শিব সন্ন্যাসী। আর যারা বৈশাখ মাসে শিবের সাধনা করেন তাদের বলা হয় ধর্ম সন্ন্যাসী। গাজনের সময় এই সন্ন্যাসীরা নানারকম সঙ সেজে ঘুরতেন।

বাংলায় ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনা হিসেবে সঙ-এর জন্ম বা প্রচলন হয়েছিল। বাংলাদেশে সঙের চল বহুদিন থেকেই। সাধারণত বিভিন্ন পূজা-পার্বণে সঙ বের করার একটি প্রথা ছিল। সকলকে আনন্দ দেবার জন্যেই প্রাচীনকালে মানুষ পূজা-পার্বণে সঙ বের করতেন। মুখ্যত চিত্তবিনোদনের জন্যই সঙের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের ঢাকায় প্রায় তিনশো বছর পূর্বে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রায় সঙ বের হতো। তখনও কলকাতায় জেলেপাড়ার সঙ বের হয়নি। লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে তখন অবিভক্ত বাংলায় সঙের প্রচলন। ১৮৮৬ সালের ২৪ মে কলকাতা শহরে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহাসমারহে সঙের দল ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ ছড়া কাটতে কাটতে পৌর কমিশনারের বাড়ির সামনে সমবেত হয়েছিলঃ
আয়রে ভাই সবাই মিলে, বাহু তুলে, হরি বলে নাচি চল!
সহরে কসাই-কালী-জবাই-বলি-ঢলাঢলি যত ছিল।

চৈত্র সংক্রান্তির দিন গাজনের দল ঢাক কাঁসি নিয়ে বাংলার পল্লী গ্রাম ও শহরের বাজারে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের সঙ্গে সঙ বের হত। চৈত্র সংক্রান্তির পরের দিন পয়লা বৈশাখ অজ্ঞাত ভবিষ্যতকে সানন্দে বরণ করতে সঙের খেলায় মেতে উঠতেন আপামর বাঙালি। গাজনের ভক্তদের মধ্যে থেকে দু’জনকে শিব ও দুর্গা সাজানো হত। অন্য ভক্তরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সঙ সেজে নৃত্য করতে করতে রাস্তায় পরিভ্রমণ করে শিবের নানা লৌকিক ছড়া ও গান পরিবেশন করতেন। মুখে নানা রঙ মেখে, বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে এই সঙের শোভাযাত্রা বের হতো দ্বিপ্রহরে। শেষ হতো মধ্যরাতে বা ভোরে। নানা ঘটনাবলীর নাটকীয় ভাব প্রকাশের প্রাচীনতম মাধ্যম ছিল সঙ। গ্রীস, মিশর, রোম, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু বছর ধরে সঙের প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের সঙ খুবই প্রাচীন। এই সঙ পরিবেশনা শিল্প প্রসঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘গৌড়-বঙ্গের প্রাচীন সংস্কৃতির এক অভিনব বিকাশ হইতেছে গত কয়েক শত বৎসর ধরিয়া প্রচলিত চিত্তবিনোদনের ধারা ‘সঙ্’। মেদিনীপুর শহরে বিশেষত চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাজনের সময়েই মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য বেশি সঙ বের হত। মেদিনীপুর শহরে সঙ প্রচলিত হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। তখন জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা প্রকারের ঘটনা এই সঙ-এর মাধ্যমে প্রকাশ পেত। তাই সেই সময় কালে এই সঙ ছিল জনপ্রিয় পূজা অনুষ্ঠানের একটি প্রধান অঙ্গ। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই সঙ এর রীতিগুলি নাট্যকলায় অঙ্গীভূত হয়েছে।

মাঠের ধান বাড়িতে আসার পর সাধারণত এই সময় খাদ্যের সমস্যা থাকে না। সকলে আনন্দে থাকেন। এই সময় আবহাওয়া খুব মনোরম। গরম থাকে না। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই বহুরূপীদের মুখের বা গায়ের রঙ ধুয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।
পৃথিবীর বহু দেশে সঙের প্রচলন ছিল। বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে’ বলেছেনঃ

ভারতীয় ও মিশরীয় সভ্যতায় এই ভঙ্গি ইতিপূর্বেই অভিনয়-কলা রূপে বিকাশ ও স্বীকৃতি লাভ করেছিল। প্রাচীন গ্রীকগণ কখনও-কখনও সঙের সঙ্গে সমবেত সংগীত যুক্ত করে দিতেন। প্রাচীন গ্রীসে কেবল দেবতা ও বীরপুরুষ -সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে সঙের অভিনয় হত। পরবর্তী কালে গ্রীসে ও রোমে সঙের দ্বারা সমকালীন প্রসঙ্গ অর্থাৎ তখনকার রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্রুপ করেও অভিনয় করা হত। রোমকগণ এই বিষয়ে সবিশেষ তৎপর ছিলেন। রোম-সাম্রাজ্যে এই বিশিষ্ট অভিনয়-কলা বহুল পরিমাণে বিকাশ লাভ করেছিল। এমন কি এই কলার অনুশীলন ও পরিবর্ধনের জন্য শিক্ষালয় স্থাপিত হয়েছিল। বিভিন্ন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করার জন্য তারা নানারকম মুখোশ ব্যবহার করতেন।
প্রধানত চৈত্র সংক্রান্তিতে সঙ বের হয়ে থাকলেও অন্যান্য পূজা-পার্বণে, বিবাহ অনুষ্ঠানে চিত্তবিনোদনের জন্য সঙের ব্যবস্থা ছিল। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথায়’ কলকাতা দ্বারিকানাথ ঠাকুরের নতুন বাড়িতে সঙ-এর প্রমোদমূলক অনুষ্ঠানের কথা তুলে ধরেছেনঃ

“নতুন গৃহ সঞ্চয়। মোং কলকাতা-১১ ডিসেম্বর, ২৭ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্রীযুক্ত দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক ভাগ্যবান সাহেব ও বিবিরদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া চতুর্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য ভোজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করিয়াছেন এবং ভোজনাবসানে ওই ভবনে উত্তম গানে ও ইংলণ্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমোদ করিয়াছিলেন। পরে ভাড়েরা নানা শং করিয়াছিল কিন্তু তাহার মধ্যে গো বেশ ধারণপুৰ্ব্বক ঘাস চর্বণাদি করিল”।

বাংলায় সঙের বহু দল ছিল। এক একটা পাড়া অনুযায়ী একটা দলের নাম হত। কলকাতার জেলেপাড়ার সঙ, কাছারিপাড়া সঙ, আহিরিতলা সঙ, খিদিরপুরের সঙ, শিবপুরের সঙ, বেনেপুকুর সঙ, শ্রীরামপুরের সঙ, মেদিনীপুরের সঙ, বীরভূমের সঙ প্রভৃতি সঙের গানের ভাষা বিভিন্ন হলেও সেগুলি সাধারণ মানুষজনের কাছে খুবই সহজ বোধ্য ছিল। সেগুলি রঙ্গরসে ভরপুর ছিল। ব্যঙ্গের বিষয়বস্তুকে আরো তীব্র ও কটাক্ষ করার জন্য লেখকগণ বাংলা সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে দিতেনঃ
লেট মি গো ওরে দ্বারী। আই ভিজিট টু বংশীধারী।
এসেছি ব্রজ হতে, আমি ব্রজের ব্রজনারী।

দুই শতাধিক বছর পরেও কলকাতার কালীঘাটের সেই চড়কের ছবি খুব একটা বদলায়নি। পটুয়াপাড়া থেকে সন্ন্যাসীরা ঠিক সেই আগের মতই সাজসজ্জা করে ঢাকের তালে নাচতে নাচতে নকুলেশ্বর মন্দিরের সামনে পৌঁছে ধুনো পোড়ান। শিব জ্ঞানে সন্ন্যাসীদের পায়ে লুটিয়ে পড়েন ভক্তিমান স্থানীয় মানুষজন। তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করেন কেউ কেউ। সেই সঙ্গে নানা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চরিত্রের সাজে সেজে সঙের মিছিলও বের হয়।

বাংলার নানা স্থানে একাধিক সঙের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল জেলেপাড়ার সঙ। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে জেলেপাড়ার সঙ যাত্রা শুরু করে ১৩২০ সালের চৈত্র মাসে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে আগে থেকেই গান নিয়ে প্রস্তুতিপর্ব চলত। নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট, চিৎপুর রোড, কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট, বউ বাজার প্রভৃতি এলাকার অসংখ্য মানুষ জেলেপাড়ার সঙ উপভোগ করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেন। বাবুদের কেচ্ছা, দরিদ্র ও শোষিতদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদ স্বরূপ জেলেপাড়া সঙ পরিবেশিত হত। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই গান ও ছড়াকে রাজনৈতিক আন্দোলন সন্দেহ করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে সঙ এর গানগুলি পরিবেশিত হওয়ার জন্য ১৯৩১ সালে জেলেপাড়া সঙ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বন্ধ করার চেষ্টা করে। ১৩৩৬ সালে শেষবারের মতো জেলেপাড়ার সঙ বের হয়েছিল। তারপর বরাবরের মতো এই সঙ বন্ধ হয়ে যায়।

কাছারিপাড়া সঙ বের হত উত্তর কলকাতার বারানসি ঘোষ স্ট্রিট থেকে। সঙের মিছিলে পরিহাসমূলক এবং রসাত্মক গানের সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গি থাকত। তাতে কখনও কখনও অশ্লীলতাও প্রকাশ পেত। তাই ‘অশ্লীলতা নির্বাচনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করে এই সঙ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীরা সঙ-কে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতেন। তাঁরা সমাজের শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের দিয়ে সঙ এর গান লেখার কাজে নিয়োজিত করতেন। সঙ এর গানগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। কলকাতার বস্তি বা ফুটপাতের লোকজন সঙ সেজে অভিনয় করতেন আর স্বদেশ-প্রেমের গান গাইতে গাইতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সে সঙগুলি কাছারিপাড়ার সঙ, জেলেপাড়ার সঙ, খুরুটের সঙ নামে পরিচিত। ভারতবাসীর মধ্যে স্বদেশ প্রেম জাগ্রত করতে জেলেপাড়ার সঙ শুরু করেছিলঃ
একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরবো ফাঁসি,
মাগো, দেখবে ভারতবাসী।

ব্রিটিশদের শাসনকালে খিদিরপুরের সঙের খুব ক্যাতি ছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সময় লোকের মুখে মুখে ঘুরত খিদিরপুরের সঙঃ
বউমা আমার সেয়ানা মেয়ে
চরকা কিনেছে।
ঘরের কোনে আপন মনে
সুতো কেটেছে।
হাওড়ার খুরুট থেকে প্রায় ত্রিশ রকমের সঙ বের হতো। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বা দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের প্রয়াণে এই খুরুটের সঙ নিবেদন করেছিলঃ—
হে বঙ্গ কর্মবীর, উন্নত শির, দেশপ্রিয় সেনগুপ্ত,
রাজনীতি গগন মাঝে, এখনও বিরাজে, তব স্বর প্রদীপ্ত!
তোল তোল তোল তান, মিলিত কণ্ঠে গান।
বল জয় বল জয়, জয় জয় দেশপ্রাণ।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশবাসীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল খিদিরপুরের মনসাতলার সঙঃ—
হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার যত বিদেশী তস্কর,
সজাগ হয়েছে দেশবাসী, মজুর-চাষী লস্কর।
আমরা হয়েছি এক, কেরাণী, উকিল, মাস্টার,
আমরা তোমাদের লুটতে দেব না আর।
হিন্দু-মুসলমান গায় স্বরাজের গান,
আমরা সবাই হয়েছি একপ্রাণ।