• facebook
  • twitter
Wednesday, 19 March, 2025

পশ্চিম মেদিনীপুরে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম নোয়াখালি দাঙ্গার ত্রাণ থেকে

নেকুড়সেনী বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের প্রধান উদ্যোক্তা যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী ছিলেন ওপার বাংলার ঢাকা জেলার উথুলি গ্রামের লোক।

ঔপনিবেশিক ভারতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। মিশনারী, এদেশীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সরকারি উদ্যোগে শিক্ষা বিস্তারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকেরা দেশের মুক্তির জন্য জোরদার আন্দোলন শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্ঠা অব্যাহত থাকে। রাজ্যের অঞ্চল ও ব্লকের নানা স্থানে শুভানুধ্যায়ী, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্তর থেকে কলেজ স্তর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় (বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর) নারায়ণগড় ব্লকে নেকুড়সেনি বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৯৫২ সালে গড়ে ওঠে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা স্বাধীন ভারতে নতুন কোন ঘটনা নয় কিন্তু এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। ১৯৪৬ সালে পূর্ব বাংলায় নোয়াখালিতে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, সেই দাঙ্গায় অসহায় মানুষদের কাছে দাঁড়ানোর জন্য নেকুড়সেনীর পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। আর উদ্বৃৃত্ত ত্রাণ থেকেই এই বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এর পেছনেই রয়েছে এক দীর্ঘ কাহিনী।

নেকুড়সেনী বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের প্রধান উদ্যোক্তা যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী ছিলেন ওপার বাংলার ঢাকা জেলার উথুলি গ্রামের লোক। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি এপার বাংলায় কর্মসূত্রে এলেন। দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের খড়গপুর স্টেশনের দক্ষিণে নেকুড়সেনি স্টেশন। আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। দাঁতন শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এই অঞ্চলকে উন্নত করতে এগিয়ে আসে মাড়োয়ারীরা। ব্যবসার গতি বাড়ানোর জন্য নেকুড়সেনি অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেন রাজস্থানের বিকানির থেকে আশা শঙ্করলাল রাঠি। প্রাথমিকভাবে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। পরে চালের ব্যবসাতেও যুক্ত হয়ে পড়েন। মনোহরপুরে গৌরিশঙ্কর রাঠি ও নন্দলাল রাঠি এবং স্থানীয়দের উদ্যমে তৈরি হয় ‘শ্রী রাধা রাইস মিল’। আর নগরমল আগরওয়ালদের হাত দিয়ে তৈরি হয় ‘হনুমান রাইস মিল’। কাপড়ের ব্যবসা বা রাইস মিলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই অঞ্চলের মানুষদের কাজের সুযোগের পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে। বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী নেকুড়সেনি স্টেশনে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বভার নেন। আর সহকারি স্টেশনমাস্টারের দায়িত্ব নেন কৃষ্ণপ্রসাদ ভট্টাচার্য। সে সময় বেলদা থেকে দাঁতনের মাঝে কোনো স্কুল ছিল না। সাধারণ বাড়ির ছেলে-মেয়েদের পড়ার ইচ্ছা থাকলেও এতদূরে গিয়ে পড়াশুনা সম্ভব হত না।

সম্পন্ন বাড়ির লোকেরা তাঁদের ছেলে-মেয়েদের দাঁতন বা বেলদায় বিদ্যালয়ের হোস্টেলে রেখে পড়াতে পারতেন। যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী এখানকার অবস্থা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। মনে মনে এই অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু করার কথাও ভাবছিলেন। কারু কারুর সঙ্গে আলাপ আলোচনাও করে ছিলেন। কিন্তু এই সময় যতীন্দ্রনাথ গোস্বামীর স্টেশনমাস্টার পদে বদলির নির্দেশ আসে। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে জনহিতে তিনি স্টেশনমাস্টার পদে ইস্তফা দেন। কারণ নেকুড়সেনিতে তিনি বিদ্যালয় গড়ে তুলবেন। তাঁর সহকারী কৃষ্ণপ্রসাদ ভট্টাচার্য (১৯১৮-২০১০)। ইনি ছিলেন ওপার বাংলার খুলনা জেলার বাসিন্দা। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন— “প্রথমে স্মরণে আনতে হয় যতীন্দ্রনাথ গোস্বামীর নাম। তিনি ছিলেন আমার সহকর্মী, নেকুড়সেনি রেল স্টেশনে সরকারি কাজের ফাঁকে এই স্থানের প্রতি অভাবনীয় এক টানে উন্নয়নের চিন্তায় সরকার চাকরিতে বদলি করায় ইস্তফা দিয়ে এই বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এখানেই থেকে যান। সেটা ১৯৫২ সাল। যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী ছিলেন নদিয়ার অদ্বৈত মহাপ্রভুর বংশধর। তাই এখানকার বৈষ্ণব বৈষ্ণবী অধ্যুষিত মানুষের কাছে তাঁর ছিল একটা বিশেষ শ্রদ্ধার আসন। তাঁর চিন্তা, চেতনায় ও ব্যক্তিত্বে একটা এমনই প্রভাব ছিল যে তাঁর পরিকল্পনা রূপায়ণে তাঁর প্রয়োজনীয় সাহায্যের দাবি কেউ কখনো ফেরায়নি। তাই অতি দ্রুত এই বিদ্যালয়ের গৃহ নির্মাণ থেকে পুকুর, ফুটবল মাঠ ও চাষযোগ্য জমিসহ নানা সম্পদ সৃষ্টি করে গেছেন।’ কিন্তু এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওপার বাংলার নোয়াখালি দাঙ্গার ঘটনা জড়িয়ে আছে।

১৯৪৬ সালে ১০ অক্টোবর থেকে নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গা কলকাতার দাঙ্গার চেয়ে মর্মান্তিক। অশোক মিত্র (আইসিএস) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘সমস্ত কথা খুলে লিখেলে পাছে যা ঘটেছিল তার থেকে আরও ভয়ানক প্রতিক্রিয়া অন্যত্র ঘটে এই আশঙ্কায় কোন প্রত্যক্ষদর্শীই বিস্তৃত বিবরণ দেননি। অনেক কমিয়ে লেখেন। এ কথা অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু, যাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আমার গভীর আস্থা ছিল, আমাকে পরে বলেন।’ প্রায় ২০০ বর্গমাইল পরিধি এলাকা জুড়ে হামলা চালায়। এতে প্রায় ৫০০০ হিন্দু হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া অনেক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার হিন্দুনারী পুরুষদের জোর পূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ বেঁচে থাকা আক্রান্তদের কুমিল্লা, চাঁদপূর, আগরতলা ও অন্যান্য জায়গায় অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরগুলিতে আশ্রয় দেওয়া হয়। কয়েক হাজার বাড়ি লুঠ হয়েছে। যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী ওপার বাংলা ছাড়লেও শিকড়ের টান থেকে গিয়েছিল। তাই তো তিনি এপার বাংলায় এলেও নোয়াখালির দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নেকুড়সেনি এবং তার পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদী, নয়াগ্রাম থেকে পূর্বে খাকুড়দা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করা হয়েছিল।

খোল ও হারমোনিয়ম নিয়ে মানুষজনকে জড়ো করে গান গেয়ে প্রায় ছয়শো মণ ধান সংগ্রহ করে নোয়াখালির বাঙালিদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ‘নোয়াখালি দেশ হল রে শ্মশান, কত যে মানুষ করিল প্রাণ দান।’ এই গানটি ত্রাণ সংগ্রহের সময় গ্রামে গ্রামে গাওয়া হয়েছিল। সন্ধ্যা গাঙ্গুলি নামে এক কিশোরী সুরেলা গলায় এই গান গেয়ে সবার হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। কুমুদ বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্মথ গিরি সহ অনেকে দান সংগ্রহে গ্রামে ভিক্ষা করেন। ত্রাণে সংগৃহীত অর্থ পাঠানো হত ধাপে ধাপে। ক্রমান্বয়ে আরও দান আসায় সেই অর্থ নিয়ে কী হবে তা নিয়ে নেকুড়সেনি স্টেশন সংলগ্ন সারদা রাইস মিলের চাতালে এক সভা হয়। সভায় কেউ বলেন এই অর্থ নিয়ে কালীপূজায় যাত্রা করা হোক, আবার কেউ বলেন স্কুল গড়া হোক। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয় স্কুলই গড়া হোক। স্থাপিত হয় নেকুড়সেনি বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন। যতীন্দ্রনাথ গোস্বামীর কর্মতৎপরতায় ১৯৫৪ সালে এই বিদ্যালয় সরকারি অনুমোদন লাভ করে। কংগ্রেস নেতা চারুচন্দ্র মহান্তি এ কাজে যতীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেন। কালের নিয়মে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৭৫ বছরে পা দেবে। প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ৭৫ বছর বয়স তেমন কিছু নয়।

এই প্রতিষ্ঠান পাঠদানের বিষয়ে সদা যত্নশীল। স্মার্ট ক্লাসরুম, উন্নত ল্যাবরেটরি, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছাত্র-ছাত্রীদের মুগ্ধ করে রেখেছে। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ এবং এলাকার মানুষের সহায়তায় এই প্রতিষ্ঠান আজও স্ব-মহিমায় মহিয়ান। প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু নেই ইতিহাস গড়াই তার কাজ, সে কাজে আজও সে অক্লান্ত যোদ্ধা।