• facebook
  • twitter
Wednesday, 19 March, 2025

এখনও শিক্ষকরা সম্মানিত হন!

গুরুকুলে ছাত্ররা একাধারে পুঁথিগত শিক্ষা, বাহ্যিক বা ব্যবহারিক শিক্ষা, শরীর গঠন শিক্ষা, অস্ত্র চালনা শিক্ষা, কৃষিকাজ বা নীতিশিক্ষা সব লাভ করত।

ফাইল চিত্র

আমরা এখন একটা কথা বলতে খুব অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যেটা হল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আর আগের মতন নেই। আগের মতন মানে পারস্পরিক সেই স্নেহ, ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর নেই। আগে এগুলোই ছিল শিক্ষাক্ষেত্রের অলঙ্কার এবং অহংকার। গুরুকুলে ছাত্ররা একাধারে পুঁথিগত শিক্ষা, বাহ্যিক বা ব্যবহারিক শিক্ষা, শরীর গঠন শিক্ষা, অস্ত্র চালনা শিক্ষা, কৃষিকাজ বা নীতিশিক্ষা সব লাভ করত। শিক্ষার সাথে এগুলোও ছিল বাধ্যতামূলক। কালের নিয়মে অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেরকম ভাবে সেই গুরুকুলও নেই আর সেই পদ্ধতিও নেই। এসেছে অন্য ধারণা, অন্য চিন্তাভাবনা। তারাই এখন সমাজের ধারক বাহক। এখানেই এসেছে ওই কথাটা। আর বঙ্গে শিক্ষার ক্ষেত্রে এই কথাটা প্রযোজ্য হয়েছে বিংশ শতাব্দীর সাতের দশক থেকে। তখন থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি, অযোগ্য লোকের বাড়বাড়ন্ত, পরীক্ষা হলে গণ ঠোকাঠুকি বা এককথায় যাকে বলে শিক্ষাক্ষেত্র চরম নৈরাজ্যের শিকার হল। আমার জীবনেও আমি কয়েকটি ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রতি সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা বা আবেগ দেখেছি যে সেসব এখন সিনেমাতেই দেখা যায়। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা। বোলপুর থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষকের বদলি হওয়ার ঘটনা নিয়ে। ওই প্রধান শিক্ষকের বাড়ি ছিল হুগলী জেলায়।

স্বাভাবিক কারণেই তিনি পরিবারের মুখ চেয়ে হুগলী জেলাতে আসতে চেয়েছিলেন এবং সেভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানান। তারপর যা ঘটল তা আমি জীবনেও ভিলব না। ঘটনাচক্রে আমি সেসময় ওখানে ছিলাম। সাক্ষী ছিলাম সেই অভূতপূর্ব ঘটনার। টানা তিনদিন ওই প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টারের সামনে গ্রামবাসী পাহারা দিয়ে গেছে যাতে না উনি কোয়ার্টার থেকে বের হতে পারেন। সে এক অভিনব দৃশ্য! শেষপর্যন্ত ওই প্রধান শিক্ষক বাধ্য হন ওখানে থেকে যেতে। দ্বিতীয় ঘটনা হাওড়া জেলার। তাও প্রায় চার দশক পার হয়ে গেছে। সেখানে প্রধান শিক্ষক নয় ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। সেখানে আবার গ্রামবাসীদের সাথে শিক্ষককুলও যোগদান করেছিল। শতাধিক বছরের পুরানো একটি স্কুলের এক শিক্ষিকার কথা। তিনি হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকের একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। আরও একটি কোনো খবরের কাগজে পড়া। ওই একই ঘটনা। যেটা এই হালফিলের ঘটনা। অনেকেরই হয়ত মনে পড়ে যাবে সেই ব্যতিক্রমী ঘটনা। না, আর উদাহরণ না। আমরা অনেকেই এরকম ব্যতিক্রমী ঘটনার সাক্ষী বা শুনেছি। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখলাম এগুলি এখন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যেটা এককালের নিয়মিত ঘটনা ছিল সেটা এখন ব্যতিক্রমী ঘটনায় পর্যবসিত। সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নয় ওই শিক্ষকরা নিজেদের গুণে তা অর্জন করেছিলেন। একেবারেই সম্প্রতি এইরূপ একটা ঘটনা আবার নজরে এল। সেটার উপস্থাপনা করার জন্য আমার ওপরের ঘটনাগুলি মনে পড়ে গেল।

আমরা যখন বলি ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এখন তলানিতে বলে আমাদের মূল্যবোধের অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সেখানে শিক্ষকের জন্মদিন পালন ও তাঁকে নিয়ে প্রতিবছর বই প্রকাশ করা ইতিমধ্যেই বিরল নজির সৃষ্টি করেছে। পুরুলিয়ার ‘জীবনের পরম পরশ’ কমিটি বিগত বছরগুলির মতো এবছরও পালন করল তাঁদের জীবনের পরশমণি তথা সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও একালের বরেণ্য প্রাবন্ধিক প্রফেসর স্বপনকুমার মণ্ডলের জন্মদিনটি। তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘শ্রী স্বপন কুমার মণ্ডল : জীবনের পরম পরশ’ সিরিজের নবম গ্রন্থ। এতে লিখেছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাক্তন সহকারী সম্পাদক অলোক দাস, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর প্রিয়কান্ত নাথ, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুবীর ঘোষ থেকে প্রফেসর স্বপনকুমার মণ্ডলের অসংখ্য গুণী-অনুরাগী লেখক, গবেষক ও ছাত্রছাত্রী। উল্লেখ্য, স্যারের জন্মদিনটি পালন করার জন্যই জীবনের পরম পরশ কমিটি গড়ে ওঠে নয় বছর আগে। এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ছিল প্রফেসর ড. মণ্ডলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি ও ৫১তম জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যে জীবনের পরম পরশ কমিটির আয়োজনে পুরুলিয়ার জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্রের অডিটোরিয়ামে শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধনে চাঁদের হাট বসে। এই মহতী অনুষ্ঠানে প্রফেসর মণ্ডলের গৌরবময় পঞ্চাশ বছর ও ৫১তম জন্মদিন উদযাপনে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের প্রোক্টর দেবাশিস মণ্ডল, পুরুলিয়া এম এম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপনকুমার সাও, পুরুলিয়া চিত্তরঞ্জন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায়, মণিপুর স্বামী বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সভাপতি দেবেন্দ্রনাথ পরামানিক।

এছাড়া কমিটির পক্ষে মঞ্চে উপস্থিত জীবনের পরম পরশ কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা ও মণিপুর স্বামী বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের ড. কার্তিক কুমার মণ্ডল স্বাগত ভাষণে কমিটির আগামী পরিকল্পনা নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সামনের বছর জীবনের পরম পরশ কমিটির দশ বছর পূর্তিকে স্মরণে বরণীয় করে তোলার জন্য সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দশজন গুণীকে সংবর্ধনা জানানোর কথা ঘোষণা করেন ড কার্তিক কুমার মণ্ডল। ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে নিয়ে এ রকম বিরল কর্মকাণ্ড আপনাতেই শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। অন্যদিকৈ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রফেসর মণ্ডলের অগণিত বর্তমান ছাত্র ও গবেষকেরা। এই অনুষ্ঠানে পরম পরশ কমিটি “শ্রী স্বপন কুমার মণ্ডল : জীবনের পরম পরশ ৯” স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সংকলনে প্রফেসর স্বপন কুমার মণ্ডলকে নিয়ে তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ গুণী ও কৃতী অনুরাগী লিখেছেন। অতিথিরা প্রফেসর মণ্ডলকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তাঁর লেখার প্রতি বিমুগ্ধতা জানিয়ে অকপটে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অন্যদিকে প্রফেসর স্বপন কুমার মণ্ডল তাঁর স্বভাবসুলভ আকর্ষণীয় বক্তব্যে আধুনিক শিক্ষার অন্ধকার দিকটির প্রতি আলো ফেলে দর্শকের মনে আলো জ্বেলে দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্রমশ শিক্ষার আসল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যে শিক্ষা আমাদের বাঁচো ও বাঁচাও মন্ত্রে দীক্ষিত করার কথা, সবার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার আলো হয়ে ওঠার বার্তা মনে হয়, তার তীব্র অভাব নিজে বাঁচার লক্ষ্যেই প্রকট হয়ে উঠছে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একার সুখভোগের আয়োজনেই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এজন্যই দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত, নিঃসঙ্গতার হাহাকার, ভালো থাকার দেখনদারি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের নিবিড় আয়োজন। সেই শিক্ষা আমাদের তীব্র প্রতিযোগিতায় সামিল করেছে, অথচ শিক্ষারই মহৎ আদর্শ সহযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে চলেছে অবিরত। আমরা আজ আধুনিক শিক্ষার শিকার আর শিকারী।’

এই মহতী অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নিউ আলিপুর কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. বৈদ্যনাথ বাস্কে, লেখক ও সম্পাদক ড. ব্রতীন দেওঘরিয়া, সাংবাদিক ও কবি দেবরাজ মাহাতো, পিএইচডি গবেষক রিবা দত্ত, প্রভাস মণ্ডল, সত্যজিৎ রায়, সুমন্ত দাস ও মৌমিতা রায়, লেখক ড. ব্রতীন দেওঘরিয়া এবং কৃতী ছাত্র গৌতম রজক। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সুচারুভাবে পরিচালনা করে সবার সমীহ আদায় করে নেন গবেষক বিকাশ কালিন্দী। এ রকম মহতী অনুষ্ঠান মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পীড়িত সমাজে সোনালি স্বপ্নের হাতছানি দেয় নীরবে-নিভৃতে নিরন্তর। পরিশেষে বলি এই ধারা যেন চিরকালীন হয়। আমরা যেন এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপনা না করে নিত্যনৈমিত্তিক বা সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হই। মনে রাখি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যদি শুধু একটা গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তো তা দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আসুন, আমরা সংকল্প করি সমাজের ও নিজেদের প্রয়োজনে এই পেশাটাকে আবার উচ্চস্থানে বসাই।

News Hub