• facebook
  • twitter
Friday, 14 March, 2025

জীবনের জ্যামিতি

অল্প হেসে উনি বললেন ‘সারাজীবন ধরে আমি অনেক হিসেব কষেছি।

কাল্পনিক চিত্র

অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

‘এ কী! কুমড়ো ফুলের বড়া কই? আমি অতো সকাল সকাল বাজারে গিয়ে বেছে বেছে টাটকা দেখে অতোগুলো কুমড়ো ফুল নিয়ে এলাম, দুপুরে ভাতের সঙ্গে ডাল দিয়ে কুমড়ো ফুলের বড়া খাবো বলে’।

—‘রোজ রোজ অমন বাচ্চা ছেলের মতো এটা খাবো, সেটা খাবো করে বায়না কোরো না তো। সর্ষের তেলের দাম জানো? তোমার ওই কুমড়ো ফুলের বড়া ভাজতে গিয়ে এককাঁড়ি তেল নষ্ট হবে। তারপর মাসের শেষে তোমার জামাইয়ের কাছে টাকা চাইলে কথা শুনতে শুনতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে।’

সদানন্দবাবুকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নিজের বক্তব্য পেশ করল অরুণিমা। মেয়ের কথা শুনে ‘আমি নিজের খাওয়া খরচ বাবদ তোদের সংসারে যে টাকাটা দিই তাতে আমার কেন তোদের সবার সারা মাস খাওয়া হয়ে যাবে’ বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন সদানন্দবাবু। মফস্বলের উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় বেতের ঘায়ে অনেক বেয়াড়া ছাত্রকে শায়েস্তা করেছেন। যাদের মাথায় গোবর পোরা ছিল তারাও সদানন্দ স্যারের মারের ভয়ে কখনও অঙ্কে ফেল করেনি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও নিজের একমাত্র কন্যারত্নটিকে কোনো সুশিক্ষাই দিতে পারলেন না, কীভাবে গুরুজনদের সঙ্গে কথা বলতে হয় সেটুকুও শিখিয়ে উঠতে পারলেন না এখনও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে সদানন্দবাবু বললেন ‘ফ্রিজের ঠান্ডায় ফুলগুলো সব নেতিয়ে যাবে। ও ফুল দিয়ে বড়া করলে আর তেমন স্বাদ হবে না। তুই ছিলিস না দেখে মালতীকে সবকিছু বলে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলাম’ এবারেও কথা শেষ করতে পারলেন না সদানন্দবাবু। তার আগেই অরুণিমা বলে উঠল ‘জানি জানি, মালতীবুড়ি সব বলেছে আমায়। তুমি ওকে বলেছ বেসনের মধ্যে খানিকটা পোস্ত দিয়ে বেশ মচমচে করে কুমড়ো ফুলের বড়া ভাজতে। আর তার সঙ্গে পাতলা করে মুসুরির ডাল আর মাছ ভাজা। ‘একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দম নেওয়ার জন্য একটু থামল অরুণিমা। তারপর সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি ভরা মুখে বলল ‘বাবা, তোমার আর কবে জ্ঞানগম্যি হবে বলো তো? ওই ফালতু কুমড়ো ফুলের জন্য কেউ এতো দাম দিয়ে কেনা পোস্ত নষ্ট করে?’

সদানন্দবাবু তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন। পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোট্ট শিশি বের করে অল্প একটু ভাজা মৌরি নিয়ে মুখে পুরে খাটে এসে বসলেন। বছর দেড়েক হল খাটের সামনের দেওয়ালটাতে সদানন্দবাবুর স্ত্রী সুপর্ণা ছবি হয়ে ঝুলে রয়েছেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে পুজোর ফুল কেনার সময় সদানন্দবাবু স্ত্রীর জন্য একটা করে ফুলের মালা কেনেন। কখনও রজনীগন্ধা, কখনও জুঁই। বিয়ের সময় সুপর্ণার কোমর অবধি লম্বা চুল ছিল। মনে শখ ছিল ছুটির দিনে হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো কাঞ্জিভরম শাড়ি পরে, চোখে মোটা করে কাজল আর কপালে বড় টিপ পরে, লম্বা বিনুনিতে একগোছা রজনীগন্ধ্যার মালা গুঁজে সদানন্দবাবুর হাত ধরে বেড়াতে যাওয়ার। সদানন্দবাবু অবশ্য সে সব অন্যায় আবদারকে কোনোদিনই প্রশ্রয় দেননি। মাষ্টারমশাইকে বউয়ের হাত ধরে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়াতে দেখলে ছাত্ররা কী মনে করবে?

লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন সদানন্দবাবু। স্ত্রীর ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে একমনে কষতে থাকেন এতোদিনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব।

সদানন্দবাবু ছোটবেলা থেকেই ভালো ছেলে। শুধু লেখাপড়ায় ভালো নয়, স্বভাবচরিত্রেও বেশ ভালো। পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে বয়সোচিত চাহিদাগুলোকে দমিয়ে রেখেছেন সবসময়। সুনাম রক্ষার জন্য পান থেকে চুন খসতে দেননি কখনও। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সদানন্দবাবুর। সারাজীবন এতো মেপেজুপে হিসেব কষে পা ফেলে শেষ অবধি জীবনের অঙ্কটা ঠিকঠাক মেলাতে পারলেন কি?


আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলটাকে ঠিক করতে করতে একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল মালতী। না, দেরি হয়নি। দিন কয়েক ধরে শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রোজ। এই বয়সে একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর সহজে ঘুম আসতে চায় না। তখন বাকি রাতটা জেগেই কাটাতে হয়। আর জেগে থাকা মানেই হাজার রকমের অনাবশ্যক দুশ্চিন্তা। কাল রাতেও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল পুরোনো স্মৃতি। মালতী বিছানায় শুয়ে অন্যদিনের মতোই এপাশ-ওপাশ করছিল। ভেবেছিল এই করতে করতেই রাত কেটে যাবে। কিন্তু ভোরের দিকে চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে এল। তাই আজ সকালে উঠতেও একটু দেরি হয়ে গেল। তবে মালতী হিসেব করে সময়টাকে ঠিকঠাক সামলে নিয়েছে। এখন বেরিয়ে পড়লে ঠিক সময়েই কাজের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারবে।

গেটে তালা লাগিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে মালতী। বাইরে রোদের বেশ তাপ। ছাতাটা খুলে মাথায় দিয়ে নির্জন পথ ধরে মালতী এগিয়ে চলে গন্তব্যের দিকে। ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়ার শোধ তুলতে শুরু করেছে স্মৃতিরা। রাস্তা ফাঁকা পেয়ে একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে তারা। ভিড় জমাচ্ছে মাথার মধ্যে।

মালতীর স্বামী নিবারণ একটা ছোটখাটো চাকরি করত। অল্প টাকায় বেশ টেনেটুনে সংসার চালাতে হত মালতীকে। নিবারণ ভেবেছিল ভালো করে লেখাপড়া শেখালে ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। বুড়ো বসয়টা নিশ্চিন্তে কাটবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। স্কুলের মাষ্টারমশাইদের কাছে আলাদা করে প্রাইভেট টিউশন নিয়েও নিবারণের সুপুত্র কৌশিক কোনোদিনই পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি। সাদামাটা ভাবে লেখাপড়া শেষ করার পর অনেক চেষ্টা করেও কৌশিক একটা সাদামাটা চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। রোজ দুবেলা খাওয়ার সময় বাবার মুখনাড়া খেতে খেতে কৌশিক একপ্রকার মরিয়া হয়েই মুম্বই পাড়ি দেয়। ওখানে ওর এক ছোটবেলার বন্ধু ছোটখাটো একটা কাজ করত। কৌশিক তার কাছেই গিয়ে ওঠে। মালতী স্বামী আর ছেলে দুজনের স্বভাবই জানত, তাই কাউকেই আর কিছু বলেনি। মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল সবকিছু। কৌশিককে অবশ্য খুব বেশিদিন বন্ধুর ঘাড়ে চেপে থাকতে হয়নি। মাস খানেকের মধ্যেই ও নিজের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। প্রথম প্রথম নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য বাবাকে কিছু হাতখরচ পাঠাতো। তারপর মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে সেটা বন্ধ করে দিল। কৌশিক এখন পানভেল-এ থাকে, জায়গাটা মুম্বাইয়ের কাছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে ওখানেই ওর সাজানো সংসার। মোটা টাকা নগদ নিয়ে বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করেছিল কৌশিক।

নিবারণ যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন পেনশনের টাকায় কোনোরকমে চলে যেত দু’জনের। কিন্তু বছর খানেক আগে নিবারণ মারা যায়। পেনশনের টাকাটাও অর্ধেক হয়ে যায়। মালতীর তখন নুন আনার আগেই পান্তা ফুরিয়ে যেত। ছেলে অবশ্য একবার বলেছিল দায়সারা ভাবে, বাড়িঘর বেচে দিয়ে ওর ওখানে গিয়ে থাকতে। কিন্তু মালতী নিজের ছেলেকে হাড়ে হাড়ে চিনত। জানত একবার বাড়ি বিক্রির টাকাগুলো হাতে পেলে মাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে ওর বেশিদিন সময় লাগবে না। তাই হাসিমুখে প্রত্যাখ্যান করেছিল ছেলের প্রস্তাব।

মালতীর রান্নার হাত চিরকালই বেশ ভালো। যে ওর হাতের রান্না খেয়েছে সে’ই ওর রান্নার প্রশংসা করেছে। মালতী তাই ঠিক করল পেট চালানোর জন্য কোনো গৃহস্থ বাড়িতে রান্নার কাজ নেবে। তবে ধারেকাছে কোথাও নয়, চেনাজানা লোকের বাড়ি কাজ করলে হাবিজাবি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাবে, তাই একটু দূরে কাজ নেওয়াই ভালো।

কাজের খোঁজ করতে করতে একদিন হঠাৎই দেখা হয়ে গেল সদানন্দ স্যারের সঙ্গে। ‘বৌদি’ মানে স্যারের মেয়ে অরুণিমার সঙ্গে কথা বলে কাজ বুঝে, মাইনেপত্র পাকা করে বেরিয়ে আসার সময় দেখা হল স্যারের সঙ্গে। মালতীর মনে পড়ে গেল কৌশিক এই বাড়িটাতেই অঙ্ক শিখতে আসত। কিন্তু তখন বাড়িটা এমন দোতলা ছিল না, তাই মালতী বাড়িটাকে দেখে চিনতে পারেনি।

স্যারের মেয়ে কাজের লোকেদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে পছন্দ করে না। শুধু হুকুম দিয়ে চলে যায়। কথামতো কাজ না হলে পরের দিন চেঁচামেচি করে, একঝুড়ি কটূ কথা শোনায়। প্রথমদিকে মালতীর একটু খারাপ লাগত, তবে এখন ওসব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। এই তো গতকাল, স্যার বাজার থেকে টাটকা কুমড়োফুল এনে পোস্ত দিয়ে বড়া ভাজতে বলল মালতীকে। কিন্তু স্যারের মেয়েকে সে কথা বলতেই সে মুখঝামটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘তোমাকে কে মাইনে দেয়? আমি না আমার বাবা?’ তারপর কড়া করে নির্দেশ দিল ‘এরপর থেকে এসব ফালতু কথা বলে একদম আমার সময় নষ্ট করবে না। যদি এখানে কাজ করতে চাও তাহলে আমি যেমন বলব ঠিক তেমন করেই কাজ করবে।’

ওদের ঠিকে-ঝি কমলা সুযোগ পেলেই মালতীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। একদিন কথায় কথায় বলছিল ‘জানো তো মালতীদি, মাষ্টারমশাইয়ের খুব কষ্ট। বৌদি মাষ্টারমশাইকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সুযোগ পেলেই কথা শোনায়। ঠিকঠাক করে খেতে অবধি দেয় না।’
‘ক্রিং ক্রিং’, সাইকেলের ঘণ্টির আওয়াজে সম্বিত ফিরল মালতীর। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে মালতী দেখল গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ও। সদানন্দ স্যারের গোলাপি রঙের দোতলা বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।


‘তুমি এতো ভালো রান্না করো, এভাবে পরের বাড়িতে রান্না না করে নিজের একটা হোম ডেলিভারি সার্ভিস খুলতে পারো তো?’ পোস্ত দিয়ে মচমচে করে ভাজা কুমড়ো ফুলের বড়াটাকে মুখে পুরে পরম তৃপ্তিতে কথাগুলো বললেন সদানন্দবাবু।

অরুণিমা দিন কয়েকের জন্য সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছে। বাবাকে রেখে গিয়েছে বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য। সদানন্দবাবু এখন একাই আছেন বাড়িতে। কমলা রোজকার মতো সাতসকালেই কাজ সেরে চলে গিয়েছে। মালতী এই কদিন একটু দেরি করে কাজে আসছে। রান্নাবান্না সেরে সদানন্দবাবুকে খাইয়ে-দাইয়ে তারপর বাড়ি ফিরছে। সদানন্দবাবু অবশ্য প্রথম প্রথম একটু আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু মালতীর জোরাজুরিতে সে আপত্তি আর ধোপে টেকেনি।

‘তার জন্য তো অনেক টাকা লাগবে। আমি অতো টাকা পাবো কোথায়?’ মেঝের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে উত্তর দিল মালতী।
সত্যিই তো! সদানন্দবাবু তো এই কথাটা একবারও ভেবে দেখেননি। মেয়ে তাহলে ঠিকই বলে, বাবার জ্ঞানগম্যি দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে। সদানন্দবাবু আনমনা হয়ে জানালার দিকে তাকালেন। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাঁদরলাঠি গাছটাকে দেখা যাচ্ছে। লম্বা লম্বা সীমের মতো ফলগুলো বিশ্রী ভাবে ঝুলে আছে। সদানন্দবাবু গাছের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন। মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে ভাবতে থাকেন ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।

লোক-লজ্জার ভয়ে সারাজীবন গুটিয়ে রেখেছেন নিজেকে। কখনও খোলাখুলিভাবে বাঁচতে পারেননি। সুপর্ণার কত সাধ ছিল সেজেগুজে, চুলে ফুলের মালা জড়িয়ে স্বামীর হাত ধরে কয়েক পা হাঁটার। সদানন্দবাবু তখন সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে থাকতেন। এখন সুপর্ণা চলে যাওয়ার পর খুব মনে পড়ে সে সব কথা। তাই প্রতি বৃহস্পতিবারে নিয়ম করে সুপর্ণার ফটোটাকে মালা পরিয়ে দেন।
অরুণিমা কম বয়সে একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিল। ছেলেটা লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না। ওই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে লোকজনের কাছে আর মুখ দেখানো যেতো না। সদানন্দবাবু তাই তড়িঘড়ি নিজের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সদানন্দবাবু মেয়ের জন্য যাকে পছন্দ করলেন সে পাত্র হিসেবে যতটা ভালো, মানুষ হিসেবে ঠিক ততটাই খারাপ। শিক্ষকতা করার সময় চরম অবাধ্য ছাত্রকেও বেতের ঘায়ে চোখে সর্ষেফুল দেখিয়েছেন, কিন্তু ছাত্র আর জামাই এক জিনিস নয়। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর দিন কয়েকের মধ্যেই সদানন্দবাবু বুঝতে পারলেন ওই সুবিধাভোগী, অর্থপিশাচ জামাইকে সোজা রাস্তায় আনা তাঁর কম্ম নয়। সুপর্ণার অসুখের সময় শাশুড়ির সেবা করার ছুতোয় সেই যে এই বাড়িতে এসে উঠল তারপর থেকে আর যাওয়ার নাম নেই। একতলার ওই ছোট্ট ঘরটা ছাড়া পুরো বাড়িটাই এখন জামাইয়ের দখলে। বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর থেকেই অরুণিমা আর বাবাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না। এখন সুযোগ পেয়ে সুদে-আসলে গায়ের জ্বালা মিটিয়ে নিচ্ছে।

‘আপনাকে আর একটু ভাত দিই?’ মালতীর প্রশ্নে সদানন্দবাবুর চিন্তায় ছেদ পড়ল। উনি ঘাড় নেড়ে ইতিবাচক উত্তর দিলেন। মালতী খুব যত্ন করে সদানন্দবাবুর পাতে এক হাতা ভাত দিল। সদানন্দবাবু ভাত মাখতে মাখতে বললেন ‘টাকার জন্য কোনো চিন্তা কোরো না। তোমার হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করার জন্য যা টাকা লাগবে, আমি দেবো।’

মালতীর হাতের ডাবু হাতা’টা থেকে খানিকটা ডাল চলকে পড়ল ডাইনিং টেবিলের ওপর। মালতী অবাক হয়ে সদানন্দবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মাষ্টারমশাই শুধু শুধু ওকে ব্যবসা করার জন্য টাকা দেবেন কেন? যদি ব্যবসায় লোকসান হয় তাহলে তো টাকাগুলো সব জলে যাবে? তাছাড়া মাষ্টারমশাই টাকা দিতে চাইলেও ওঁর মেয়ে-জামাই সেটা মেনে নেবে কেন? ওরা হয়তো ভাববে মাষ্টারমশাইকে একা পেয়ে মালতী তাঁকে ফুঁসলিয়ে অতোগুলো টাকা আদায় করে নিয়েছে।

মালতীর মুখ দেখে সদানন্দবাবু ওর মনের কথাগুলো বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারলেন। অল্প হেসে উনি বললেন ‘সারাজীবন ধরে আমি অনেক হিসেব কষেছি। কিন্তু জীবনের অঙ্কটা কখনও ঠিকঠাক মেলাতে পারিনি। তাই এই শেষ বয়সে এসে একটু বেহিসেবি হয়ে দেখব, ঠিক কতটা গরমিল হল।’

মালতী চোখ নামিয়ে নিল। মাষ্টারমশাইয়ের কথা শুনে বোধহয় একটু লজ্জা পেয়েছে। সদানন্দবাবু আবার জানালার দিকে তাকালেন। এবার আর বাঁদরলাঠি নয়, সদানন্দবাবু জানালা দিয়ে সোনালি ফুলে ভরা অমলতাস গাছটাকে দেখতে পেলেন।