• facebook
  • twitter
Friday, 14 March, 2025

শোচনীয় পরাজয়ের পথে ইউক্রেন?

ট্রাম্প-পুতিন আলোচনা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ বলছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হতে হলে ইউরোপকে অবশ্যই তাতে অংশ নিতে হবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু ইউরোপকে বাদ দিয়ে নয়।’ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা ব্যারবক বলেন, ‘ন্যায়সংগত এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।’

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তাঁর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছেন তিনি। তবে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় ইউক্রেনকে যুক্ত করা হয়নি। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে কয়েক দফা আক্রমণাত্মক কথাও বলেছেন ট্রাম্প।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক আলোচনার শর্তাবলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাশিয়ার অনুকূলে যাচ্ছে, যা ইউক্রেন ও পশ্চিমী বিশ্বের জন্য এক বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ করলে স্পষ্ট হয়, রাশিয়ার আগ্রাসন প্রশমিত হওয়ার বদলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সাম্প্রতিক সাফল্যের ভিত্তিতে তারা আরও শক্তিশালী অবস্থান নিচ্ছে। এই আলোচনার ফলে ইউক্রেন তার দখলকৃত ভূখণ্ড ফিরে পাবে কি না, তা পুরোপুরি অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে।

ট্রাম্পের বক্তব্য ও রাশিয়ার অবস্থান: ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমি শান্তি চাই, আমি ভূখণ্ড নিয়ে চিন্তিত নই।’ তার এই বক্তব্য রাশিয়ার কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়। কারণ রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করেছে এবং তারা এসব এলাকা ছাড়তে মোটেও আগ্রহী নয়। ট্রাম্প বলেছেন, ‘রাশিয়া বহু সৈন্য হারিয়ে এই ভূমি দখল করেছে।’ তার মানে তিনি রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের বিষয়ে ইউক্রেনের দাবির প্রতি ততটা সহানুভূতিশীল নন।

অন্যদিকে, পুতিন তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আসবে শুধু শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে’; কিন্তু তার শর্তাবলি অত্যন্ত কঠোর। রাশিয়া চায়, ইউক্রেন একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে থাকুক, ন্যাটোতে যোগ না দিক এবং পশ্চিমী সামরিক সাহায্য গ্রহণ বন্ধ করুক। এ অবস্থায় ইউক্রেন কৌশলগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

ইউক্রেনের জন্য এই আলোচনা কী সংকেত দিচ্ছে: ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুরুতে আলোচনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও বাস্তবে এটি ইউক্রেনের জন্য এক বিশাল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। কিয়েভ যদি শান্তির শর্ত হিসেবে রাশিয়াকে দখলকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়, তাহলে এটি শুধু ভূখণ্ডগত ক্ষতিই হবে না, বরং এটি রাশিয়াকে ভবিষ্যতে আরও আগ্রাসন চালানোর সুযোগ করে দেবে।
ন্যাটো সদস্যপদ ও নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ: ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না।’ এটি ইউক্রেনের জন্য বড় ধাক্কা। কারণ তাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্যই ছিল পশ্চিমী সামরিক জোটে যোগ দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি ‘বহুজাতিক বাহিনী’ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু এটি ন্যাটোর আওতায় আসবে না এবং এতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বড় ভূমিকা পালন করবে না।

এরই মধ্যে একপ্রকার তাড়াহুড়া করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আলোচনায় বসেন ইউরোপের নেতারা। ওই আলোচনার আয়োজন করেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। এই তাড়াহুড়া থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্পের বক্তব্যগুলো তাঁরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।ফ্রান্সের আঞ্চলিক সংবাদপত্রগুলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাখোঁ বলেন, ‘ইউরোপীয়দের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। অভাবনীয় কিছু ঘটতে পারে না—এমন কিছু ভাববেন না। সবচেয়ে খারাপ কিছুও ঘটতে পারে।’

তাহলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে? ইউরোপের কিছু দেশ তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে পারে। তবে সেটি ন্যাটোর প্রতিরক্ষা চুক্তির (ধারা ৫) আওতায় আসবে না। ইউক্রেন নিজস্ব সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু এটি যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীর বিপরীতে কতটা কার্যকর হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসন ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সাহায্যের বিনিময়ে ইউক্রেনের দুর্লভ খনিজ ও শক্তি সম্পদের ওপর মার্কিন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে চাইছে।

ট্রাম্প-পুতিন আলোচনা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ বলছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হতে হলে ইউরোপকে অবশ্যই তাতে অংশ নিতে হবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু ইউরোপকে বাদ দিয়ে নয়।’ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা ব্যারবক বলেন, ‘ন্যায়সংগত এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।’

রাশিয়া সামরিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের দাবি আগের চেয়ে আরও কঠোর হয়েছে। বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, যা ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২০ শতাংশ। ইউক্রেনের কৌশলগত পাল্টা আক্রমণ খুব বেশি অগ্রগতি আনতে পারেনি, ফলে আলোচনায় তারা তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। রাশিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘রাশিয়া কখনোই তাদের দখল করা ভূখণ্ড নিয়ে দর কষাকষি করবে না।’ অর্থাৎ দখলকৃত ভূমি তারা ফেরত দেওয়ার জন্য দখল করেনি।

নতুন মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য অব্যাহত রাখার পরিবর্তে এক নতুন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তির আলোচনা করছে। সম্ভাব্য চুক্তির শর্ত হতে পারে—মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য ইউক্রেনের দুর্লভ খনিজ এবং শক্তি সম্পদে প্রবেশাধিকার। মার্কিন অস্ত্র কেনার জন্য ইউক্রেনকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক শর্ত দেওয়া। ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা কমিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল করে তোলা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে কৌশল নিচ্ছে, তা মূলত রাশিয়াকে সুবিধা দিয়ে দ্রুত সমঝোতা করানোর একটি পরিকল্পনা।ট্রাম্প আসলে ভঙ্গদশায় থাকা পশ্চিমী জোটকে এড়িয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত পররাষ্ট্রনীতির উল্টো পথে হেঁটে যে কোনো মূল্যে নিজেকে ক্রমে শান্তিরক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে চাইছেন।

তাহলে এই চুক্তির আলোচনা কি ইউক্রেনের জন্য বিপজ্জনক? তা-ই তো মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে, কারণ রাশিয়া দখলকৃত ভূখণ্ড ফেরত দিতে রাজি নয়। ন্যাটো সদস্যপদের অনিশ্চয়তা ইউক্রেনের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে। রাশিয়া সামরিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় তারা আলোচনায় বেশি সুবিধা পাবে। ইউরোপ এ আলোচনায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলে ইউক্রেন আরও দুর্বল অবস্থানে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ইউক্রেনে অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে।

শেষ প্রশ্ন, যদি ট্রাম্প-পুতিন আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি হয়, তবে সেটি কি ইউক্রেনের জন্য ন্যায়সংগত হবে নাকি রাশিয়ার কৌশলগত জয় হবে? ইউক্রেন কি তার সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি রক্ষা করতে পারবে, নাকি এটিই হবে ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ সংঘাতের ভিত্তি?

News Hub