• facebook
  • twitter
Friday, 24 January, 2025

‘২০২৫-এ এসেও বিনোদিনীকে কিন্তু একাই লড়তে হচ্ছে’

আজীবন থিয়েটারের জন্য নিবেদিত প্রাণ বিনোদিনীর ইতিহাস, আসলে এক কলঙ্কময় বঞ্চনার ইতিহাস। সেই ঘটনাকেই পুনরায় পর্দায় ফেরালেন নির্দেশক রাম কমল মুখোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারে অবন্তী সিনহা।

সালটা ছিল ১৮৮৪। সেই ঔপনিবেশিক কলকাতায়, থিয়েটারের দর্শকরা একজন তরুণ ‘অভিনেতার’ অভিনয় দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। একের পর এক শো হাউসফুল। সমালোচনাও হল বিস্তর, শেষমেশ শো বন্ধ হল আদালতের আদেশে। নাটকটি ছিল ‘চৈতন্য লীলা’ এবং তাতে শ্রী চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কোনও পুরুষ অভিনেতা নয়, নটী বিনোদিনী দাসী। তাঁর ওই অসাধারণ অভিনয় দেখতে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি বিনোদিনীকে পুরুষ বলে চিনতে না পেরে পরে প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘দারুণ ঠকালি মা, আসলে নকলে গুলিয়ে গেল’! চৈতন্য লীলার মঞ্চায়নের শেষে তিনি অভিনেত্রীকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘তোর চৈতন্য হোক, ওদের চৈতন্য হোক’। এটি নিশ্চিতভাবে সে যুগে এক যুগান্তকারী ঘটনা, যেখানে একজন পতিত মহিলা, চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করছেন এবং সমাজ সংস্কারক হিসেবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা করছেন ঠাকুর। যে-বয়সে বিনোদিনী মঞ্চ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই তেইশ বা চব্বিশেই কিন্তু চৈতন্যও সংসার ত্যাগ করেছিলেন- এ এক আশ্চর্য সমাপতন!

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকেই, মঞ্চে অভিনেত্রীদের উপস্থিতির সূত্রপাত হয়েছিল। এর আগে পুরুষরা মহিলা চরিত্রগুলিতে অভিনয় করতেন। কিন্তু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা ‘রং মেখে’ থিয়েটার করতেন না। বিনোদিনী ছিলেন বাংলার প্রসেনিয়াম থিয়েটারে নতুন রূপে অভিনয় করা অভিনেত্রীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পূর্বসূরীরা, অর্থাৎ এলোকেশী, গঙ্গা বাইজি, গোলাপসুন্দরী, ক্ষেত্রমণি, লাখিমণি এবং রাজকুমারী- সকলেই ছিলেন বেশ্যালয়ের বাসিন্দা। তাই তাঁদের মতোই বিনোদিনীও, গা থেকে তাঁর অন্ধকার অতীতটা আজীবন মুছতে পারেননি। অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হলেও, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, কলকাতার ভদ্রলোক সম্প্রদায়, একজন ‘বেবুশ্যের’ নামে থিয়েটার হলের নামকরণকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বাবু গুরমুখ রায় যদিও তাঁকে কথা দিয়েছিলেন যে, নতুন থিয়েটারটি বিনোদিনীর নামেই হবে ‘বি থিয়েটার’ কিন্তু গিরীশ ঘোষ, অমৃতলাল এবং দাসুবাবুর তঞ্চকতায় শেষ পর্যন্ত এটির নামকরণ করা হয় ‘স্টার থিয়েটার’। আজীবন থিয়েটারের জন্য নিবেদিত প্রাণ বিনোদিনীর ইতিহাস আসলে এক কলঙ্কময় বঞ্চনার ইতিহাস। সেই ইতিহাসকেই পুনরায় পর্দায় ফেরালেন নির্দেশক রাম কমল মুখোপাধ্যায়। জেনে নেওয়া যাক এই ছবি সম্পর্কে তাঁর ভাবনার কথা।

নটী বিনোদিনীকে নিয়ে যাত্রা, নাটক এবং সিনেমাও হয়েছে এর আগে। আপনার ক্ষেত্রে ঠিক কোন মোটিভেশন কাজ করেছে এই ছবি করার জন্য?

বিনোদিনীকে নিয়ে বীণা দাসগুপ্তার যাত্রা একসময় ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এখনও গ্রামেগঞ্জে বিনোদিনীকে নিয়ে যাত্রাপালা হলে মানুষ দেখতে আসেন। নাটকটাও ভীষণ পপুলার হয়েছে। ওটা দেখে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, ওটাই বিনোদিনীর জীবন। আমি বিনোদিনীকে দেখেছি আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। গিরীশচন্দ্রের বা রামকৃষ্ণের বই থেকে, বিভিন্ন সময়ের সাহিত্য বা গবেষণাপত্র থেকে নানা গল্পকথা পেয়েছি এই নটীকে ঘিরে। সবটা মিলিয়েই আমার ছবি ‘বিনোদিনী একটি নটীর উপাখ্যান’। আমরা এখানে বিনোদিনীর ৭ থেকে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত ঘটনাক্রমকে এক নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে চেয়েছি। তাঁর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের অ্যাচিভমেন্টসগুলোকে এভাবে আগে কোথাও তুলে ধরা হয়নি।

এই ছবির লুক অ্যান্ড ফিল ক্রিয়েট করার সময় কি কোনও ইন্সপিরেশন কাজ করেছে?

ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) ‘চোখের বালি’ মনে দাগ কেটেছিল আমার। সেটা কিছুটা প্রভাব ফেলতেও পারে। তবে আমার ‘বিনোদিনী’ একটা লার্জার দ্যান লাইফ পটভূমিতে তৈরি, ফলে আমি সেটস এবং কস্টিউমে ঐতিহ্যশালী বাংলাকে তুলে ধরতে চেয়েছি, যেখানে গিরীশ ঘোষের বাড়িটিও রীতিমতো প্রাসাদোপম।

বলতে পারেন হিরোর বাজেটে হিরোইন কেন্দ্রিক ছবি হয়েছে। সেলুলয়েডে কিছুটা স্বাধীনতা নিলেও, আমি মূলত আস্থা রেখেছি আমার রিসার্চ টিমের উপর। অভ্র চক্রবর্তী ও ভাস্কর সেনগুপ্তর গবেষণা, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লিখেছেন প্রিয়াঙ্কা পোদ্দার, অতিরিক্ত সংলাপ করেছি আমি এবং আমার রিসার্চ অ্যসোসিয়েট পবন অগ্রওয়াল। গল্প বলতে গিয়ে অনেক সময় সালটা ক্রোনোলজিক্যালি বসানো যায়নি ঠিকই কিন্তু ঘটনাগুলো সবই রাখার চেষ্টা করেছি। রিয়েল রিসার্চ রেখে, গল্প বলার ক্ষেত্রে যখন কোথাও বাধা তৈরি হয়েছে, শুধু তখনই আমি কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি।

একজন নির্দেশক হিসেবে আপনার কী মনে হয়, রুক্মিণী চরিত্রটার প্রতি কতটা জাস্টিস করলেন?

আমার মতে এটা রুক্মিণীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়। সব অভিনেত্রীর জীবনেই তো আর বিনোদিনীর মতো চরিত্র আসে না। যিনি সেটা করার সুযোগ পান, তিনি তাতে তাঁর সর্বস্ব দিয়ে অভিনয়টা করেন। সেটা রুক্মিণীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলেই আমি মনে করি। শুধু অভিনয় নয়, যেভাবে গত কুড়িদিন ধরে ও লাগাতার পরিশ্রম করল এর প্রমোশনের জন্য, মানতেই হবে সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ রুক্মিণীর একার লড়াই। একটা মহিলাকেন্দ্রিক ছবির জন্য, যেখানে ও-ই হিরো, তার প্রচারে যে-সাপোর্ট দরকার ছিল, সেই সাপোর্ট সিস্টেম কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রির পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দিল না। গল্পটা আজও তেমন বদলায়নি তাহলে! এই ২০২৫-এ এসেও বিনোদিনীকে কিন্তু একাই লড়তে হচ্ছে।

এই ছবিটির জন্য এনএসডি থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ার অনুভূতিটা কেমন?

আমরা তো একজন থিয়েটার শিল্পীর জীবন নিয়েই কাজ করলাম, ফলে থিয়েটারের পীঠস্থান ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে ডাক পাওয়া এবং সম্মান পাওয়াটা একটা বিশাল উপলব্ধি।

বাঙালি নটীর জীবন নিয়ে ছবিতে, হিন্দি গান কি বাণিজ্যিকভাবে সফল করার জন্যই ব্যবহার করা হল?

বিনোদিনী যে নাচতেন বা গাইতেন তার তো কোনও ভিডিয়ো ডকুমেন্টেশন নেই। সাধারণ স্টিল ছবি আছে। সিনেমাতে যে গুরমুখ রায়ের সামনে গানটা উপস্থাপনা করছেন বিনোদিনী, ভুললে চলবে না তিনি কিন্তু একজন অবাঙালি লোক। গিরীশ ঘোষ প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন বিনোদিনীকে ভাষা শিক্ষা দেবেন বলে। তিনি ইংরেজি যেমন শিখেছেন, তেমনই ধরে নেওয়া যায় লখনউ গিয়ে হিন্দিটাও রপ্ত করেছিলেন। সেটা তো ১৮৬২-এর অবিভক্ত বাংলা, মানে সম্মিলিতভাবে অঙ্গ বঙ্গ, কলিঙ্গ এবং এখনকার বাংলাদেশ। ফলে হিন্দুস্তানী ভাষার চর্চা ছিলই। রবীন্দ্রনাথ তো ততদিনে মৈথিলি থেকে ভানু সিংহের পদাবলি লিখে ফেলেছেন। আমিও ওই মৈথিলি ভাষার ব্যবহারই দেখাতে চেয়েছি।

আপনার পরবর্তী প্রোজেক্ট ‘দ্রৌপদী’। এর আগে দ্রৌপদী হয়েছেন রূপা গাঙ্গুলি, স্টেজে দ্রৌপদী করেছেন মল্লিকা সারাভাই এবং হেমা মালিনী। নামভূমিকায় আপনার পছন্দ আবার রুক্মিণী, এটা কেন?

রুক্মিণীর ডেডিকেশনটাই এর একমাত্র কারণ। আমার ওই চরিত্রটির জন্য এমন একজনকেই প্রয়োজন, যে-নিজেকে ওই চরিত্রে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেবে- তা তৈরি হতে যতদিনই সময় লাগুক না কেন। ‘বিনোদিনী’র সাফল্যের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে পরের প্রোজেক্টটা। কারণ যে-বাজেটে ওটা করতে চাইছি, তার কিছুটা অন্তত এই ছবি থেকে উঠে আসা দরকার। স্ক্রিপ্ট আর কাস্টিং রেডি, সব ঠিকঠাক চললে ২০২৫-এর শীতে শুরু হবে শুটিং।