পূর্ব প্রকাশিতর পর
‘পঞ্চ গৌড়’ ব্রাহ্মণ হইতেছেন—‘গৌড়, সারস্বত, কান্য-কুব্জ, উৎকল ও কাশ্মীর’; এবং ‘পঞ্চ দ্রাবিড়’— ‘গূর্জর, মহারাষ্ট্র, কর্নাট, অন্ধ্র, দ্রাবিড়’। এই শ্রেণীবিভাগ কতকটা ভৌগোলিক—‘গৌড়’ অর্থাৎ উত্তরদেশীয়, এবং ‘দ্রাবিড়’ অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের ও দক্ষিণ-ভারতের। ইঁহাদের মধ্যে সারস্বত ব্রহ্মণেরা কোঙ্কণ প্রদেশে ও পাঞ্জাবে উভয়ত্র বাস করেন; আবার গূর্জর ও মহারাষ্ট্র ব্রাহ্মণগণ, ‘নাগর, দেশস্থ, কাহ্রাড়, কোঙ্কণস্থ’ প্রমুখ নানা বিভাগে বিভক্ত, এবং সকলেই আর্য্য-ভাষী—গুজরাটী ও মারাঠী। ‘গৌড়’ ব্রাহ্মণ গৌড়-বঙ্গের রাঢ়ী’, বারেন্দ্র, পাশ্চাত্য বৈদিক, দাক্ষিণাত্য বৈদিক, মধ্যশ্রেণীর—সব-ই আসে। একমাত্র ‘গৌড়’ শব্দের ব্যাপক এবং অখিল-উত্তরাপথ-দ্যোতক অর্থ ছাড়া, এখানে ‘গৌড়’ শব্দের আর কোনও সার্থকতা নাই।
ভারতের আধুনিক আর্য্য-ভাষার আলোচনায় প্রথম যুগের বিখ্যাত ইউরোপীয় গবেষক, জরমান পণ্ডিত A.F.Rudolf Hoernle হ্যারনলে সাহেব এই ব্যাপক অর্থ ধরিয়াই তাঁহার সুবিখ্যাত পুস্তকের নাম-করণ করিয়াছিলেন— A Comparative Grammar of the Gaudian Languages, with, special reference to Eastern Hindi, অর্থাৎ ‘গৌড়ীয় ভাষা-সমূহের তুলনাত্মক ব্যাকরণ, পূর্বী হিন্দীর আধারে’ (প্রকাশিত হয় লন্ডনে, ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে)। উত্তর ভারতের সমস্ত আর্য্য-ভাষা এইভাবে প্রসারিত অর্থে ‘গৌড়ীয় ভাষা’ নামে ইংরেজিতেও অভিহিত হইল। অবশ্য রামমোহন রায় যখন তাঁহার বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ লেখেন, তাহার নাম দিয়াছিলেন ‘‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’’—বাঙ্গালা ভাষা অর্থে এই শব্দের সংকুচিত অর্থে তিনি শব্দটি ব্যবহার করেন।
‘গৌড়’ ছিল প্রধানতঃ পশ্চিম বাঙ্গালা, উত্তর মধ্য-বাঙ্গালা ইহার অন্তর্গত ছিল, এবং ‘বঙ্গ’ (দেশ-অর্থে, অধিবাসী অর্থে ‘বঙ্গাল’) ছিল ব্যাপকভাবে পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ। এইজন্য প্রাচীন ও মধ্য যুগে হিন্দু আমলে সমগ্র দেশের জন্য ‘গৌড়-বঙ্গ’ (অথবা ‘গৌড়-বঙ্গাল’) এই সমস্ত-পদ ব্যবহৃত হতি। ফেরিশতা (১৫৭০-১৬১২ খ্রীঃ অঃ) তাঁহার ফারসী ভাষায় রচিত ইতিহাসে (‘তারিখ্-ই-ফেরিশতা’) এক স্থলে লিখিয়াছেন—‘‘পূরব ও বঙ্গ্-এর জনগণ’’—এখানে খালি ‘বঙ্গ’ শব্দ-ই প্রযুক্ত হইয়াছে।
(ক্রমশ)