• facebook
  • twitter
Thursday, 23 January, 2025

গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ

মধ্যপ্রদেশের সৌন্দর্যের তুলনা কোনও কিছুর সঙ্গেই চলে না। মাণ্ডু দেখে এবার ঐতিহাসিক মালওয়া শহর মহেশ্বরকে চাক্ষুস করার পালা। সেই সঙ্গে ওঁকারেশ্বর। লিখছেন মন্দিরা মিত্র।

পর্ব ২

ফিরে এসে প্রাতরাশ সেরে চললাম নীলকান্ত মহাদেবকে দেখতে। শিবমন্দিরটি একটি দুর্দান্ত লোকেশনে অবস্থিত। মন্দিরের শিবলিঙ্গটি রয়েছে মাটির নীচে এবং একটি প্রাকৃতিক ঝরনা যেন প্রতিনিয়ত জলের ধারায় শিবের অভিষেক করে চলেছে। এই মন্দিরের জলের স্তর কখনওই কানায় কানায় পূর্ণ হয় না, কারণ একটি একক সর্পিল কাঠামো আছে যা দেখতে মুখোমুখি দুটি সাপের মতো। এর মধ্য দিয়ে জল কুণ্ড থেকে প্রবাহিত হয় এবং নীচের উপত্যকায় পড়ে সোজা ভূগর্ভে চলে যায়। মজার কথা জাহাজ মহলেও এই ধরনের সর্পিল কাঠামো দেখা যায়। গাইডের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুনলাম জামে মসজিদে, যাকে দামাস্কাসের মসজিদের অনুকরণে তৈরি করা বলে মনে করা হয়- তাতে একটি বিশাল উচ্চ গম্বুজ-যুক্ত বারান্দা আছে। মসজিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে চারপাশে তাকালে, স্থাপত্যকলার এক জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য দেখতে পাবেন।

সেদিন সন্ধেবেলায় রাজস্থানি শিল্পী মামে খানের মিউজিক্যাল ব্যান্ডটির মাণ্ডুতে অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। টেন্ট সিটি থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে অনুষ্ঠান চলছিল। তার অংশীদার হতে মিউজিক্যাল কনসার্টের জায়গায় চলে যাই। পারফরম্যান্সটি এতটাই মনোগ্রাহী ছিল যে, অনেকদিন মনে থাকবে।

পরের দিন প্রাতরাশ সেরে মাণ্ডুর পশ্চিমদিকে এক ঐতিহাসিক মালওয়া শহর, মহেশ্বরের উদেশে রওনা হলাম। রাস্তায় যেতে যেতে মনে পড়ছিল রানি রূপমতি আর বাজবাহাদুরের কথা। সঙ্গে এটাও ভাবছিলাম, রানি অহল্যাবাই হোলকারের শাসনকালে, মধ্যপ্রদেশের প্রায় অর্ধেকের উপর রাজ্য তাঁর শাসনাধীন ছিল। ম্যাপ, বই এইসব দেখতে দেখতে প্রায় ঘণ্টা খানেকের পথ পেরিয়ে মহেশ্বরের এমপিটি হোটেল নর্মদা রিসোর্ট-এ পৌঁছে গেছি। এটি প্রশস্ত নর্মদার কোলে হোলকার দুর্গে অবস্থিত। হোটেলের গা দিয়ে কুল কুল করে নর্মদা বয়ে চলেছে। শরীর ও মন যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল।

লাঞ্চ সেরে গাইডকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক শহর অহল্যাবাই হোলকারের সাম্রাজ্য দেখতে। গাড়ি ছেড়ে দুর্গের দিকে পা বাড়ানোর আগেই, রেওয়া সোসাইটির মহিলারা আমাদের সিঁদুর টিপ পরিয়ে বরণ করে নিলেন। এঁদের কথা না বললে অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

কিংবদন্তী ও মহীয়সী নারী হিসেবে, হোলকার রাজবংশের রানি অহল্যাবাই আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনিই প্রথম মাহেশ্বরী শাড়ির নকশা শুরু করেছিলেন। ১৮৭০ সালে প্রতিভাময়ী রানি নিজের নকশা করা বস্ত্র তৈরি করার জন্য, মাণ্ডু ও সুরাট থেকে অতি দক্ষ কিছু তাঁতিকে তাঁর রাজ্যে নিয়ে আসেন। তখন মূলত তৈরি হতো পাগড়ির জন্যে বিশেষ ধরনের ফ্যাব্রিক। আর বোনা হতো মালওয়া সাম্রাজ্যের নারীদের জন্য নয় গজের অতি সূক্ষ্ম নভরি শাড়ি- যা রাজকীয় উপঢৌকন হিসেবে যেত নানা রাজ্যে। গুণগত মান এবং সূক্ষ্ম ফ্যাব্রিক, মাহেশ্বরী শাড়ির এক স্বকিয় মর্যাদা তৈরি করে। এই মাহেশ্বরী শাড়ি ছিল প্রধানত সূক্ষ্ম সুতির সুতোর বুনন এবং তার মধ্যে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হতো মহেশ্বরের ফোর্টে বা বিভিন্ন মন্দিরে খোদিত নকশা।

রানির মৃত্যুর কিছুকাল পরে, নিম্ন মানের কম দামি ফ্যাব্রিকের কারখানা গড়ে ওঠে। ফলে আস্তে আস্তে মাহেশ্বরী শাড়ির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে থাকে। ১৯৭৯ সালে মহারাজা যশবন্ত রাও হোলকারের সন্তান রিচার্ড হোলকার, ও তাঁর পুত্রবধূ শেলি হোলকার- নিজেদের উদ্যোগে রেওয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাহেশ্বরী শাড়িকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এইখানে মূলত মহিলারাই কাজ করেন। এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরাকালের সেই হাতে বোনা মাহেশ্বরী শাড়ি, ওড়না এবং জামা-কাপড় তৈরির ফ্যাব্রিকের পুনর্বিন্যাস ঘটেছে। এই সোসাইটিতে এখন ২৫০ জন তাঁতি এবং ১৫০০টি তাঁত রয়েছে।

মহেশ্বরের মন্দিরের কথা রামায়ণে উল্লেখ আছে। তখন এই জায়গাটি রাজা কার্তিবার্জুনের রাজধানী মাহিষমতি নামে পরিচিত ছিল। শোনা যায়, একবার রাজা কার্তিবার্জুন তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে, খালি হাতেই শক্তিশালী নর্মদার জল বন্ধ করেছিলেন। এদিকে, রাবণ, একই পথ অতিক্রম করার সময়, শুকনো জায়গা দেখে ভাবলেন- এটি ভগবান শিবের উপাসনার জন্য একটি আদর্শ স্থান। তিনি নদীর তলার বালি থেকে একটি শিব লিঙ্গ তৈরি করে প্রার্থনা করতে লাগলেন। কার্তিবার্জুন ভ্রমণ শেষ করে ফেরার সময়, রাজা আবার নদীর জল প্রবাহিত করে দেন। প্রবাহিত জল শিব লিঙ্গকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে, রাবণ ক্রুদ্ধ হন। এই বিঘ্নের প্রতিশোধ নিতে, রাবণ কার্তিবার্জুনকে চ্যালেঞ্জ করেন। কিন্তু তিনি সাহসী রাজার শক্তিতে অভিভূত হন। রাজা কার্তিবার্জুন রাবণের মাথায় ১০টি প্রদীপ এবং তাঁর হাতে একটি রাখেন। অর্জুনের সেই বিজয় স্মরণ করে আজও মহেশ্বরের সহস্রার্জুন মন্দিরে, প্রতি সন্ধ্যায় ১১টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।

যাইহোক ১৮ শতকের সময়কালে, মহেশ্বর রাজমাতা দেবী অহল্যাবাই হোলকর, অসাধারণ সুন্দর কিছু ভবন, বিশেষভাবে খোদাই করা মন্দির, একটি মনমুগ্ধকর প্রাসাদ এবং একটি অত্যন্ত শক্তিশালী দুর্গ দিয়ে শহরটিকে সুসজ্জিত করেছিলেন। এইসব জায়গা ঘুরে প্রছুর সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছলাম নর্মদা মাইয়ের শান্ত ও শীতল ঘাটে। বেশ কিছুক্ষণ এখানে বসেছিলাম। এরপর ফিরে আসি প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো ফোর্টটিতে, যা এখন হেরিটেজ হোটেল হয়েছে। কিন্তু খিদেতে পেট বেশ জ্বলছে। দেখি নর্মদা ঘাটের কাছেই রয়েছে বাঁকে বিহারী প্রসাদের দোকান। ওখানের স্থানীয় মানুষদের মতো রাজকীয় রাজওয়াড়ি পদ্ধতিতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী ডাল বাফলা খেলাম।

আসলে এই ধরনের প্রাচীন শহরকে উপভোগ করতে হলে হেরিটেজ ওয়াকে যেতেই হবে। তাই পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম রাজওয়াড়া, রাজদরবার, স্বর্ণ ঝুলা, অহল্যেশ্বর মন্দির, অহল্যা ঘাট এবং আরও অনেক জায়গা পরিদর্শন করার জন্যে।

এরপর লাঞ্চ সেরে বেরোলাম ওঁকারেশ্বরের উদ্দেশে। প্রায় দেড় ঘণ্টার রাস্তা কিন্তু অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম পবিত্র নর্মদা এবং কাবেরী নদীর সঙ্গমে অবস্থিত, ওঁকারেশ্বর টেম্পল ভিউ হোটেলে। কী অপূর্ব নর্মদার উপর ঝুলন্ত সেতু! মহেশ্বর ও ওঁকারেশ্বরের মধ্যে অনেক ফারাক থাকলেও, সবচেয়ে বড় যোগসুত্র হল এই নর্মদা।

হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প করতে করতে জানলাম ওঁকারেশ্বর, পবিত্র নর্মদার তীরে অবস্থিত ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম জ্যোতির্লিঙ্গ। এই জায়গাটিতে নদীর গতিপথ সংস্কৃতের ‘ওম’ শব্দের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ, যা ভারতের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থেও উল্লিখিত আছে। তাই শহরটিকে ওমকারজিও বলা হয়।

এখানে ৬৮টি তীর্থক্ষেত্র এবং ১০৮টি শিবলিঙ্গ রয়েছে, যার জন্যে এটি সম্পূর্ণরূপে অতি গুরুত্বপূর্ণ এক শৈব স্থান বলে পরিচিত। মনে করা হয়, এই শহরে নর্মদার তীরে, আদি শঙ্করাচার্য পরিদর্শন করেছিলেন এবং বেদান্তের অনেকটাই রচনা করেছিলেন।

পৌরাণিক কাহিনী বলে যে, ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতী ওঁকারেশ্বরে বিশ্রাম নেন। তাই জ্যোতির্লিঙ্গের প্রধান মন্দিরের শয়ন আরতি, রোজ রাত ৯টা থেকে আরম্ভ হয়। ওঁকারেশ্বরের মূল মন্দিরে প্রবেশের সময় ভক্তরা প্রথমে পঞ্চমুখী গণেশের দর্শন পান। এই গণেশ মন্দিরটি আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গণেশ চতুর্থী উৎসবের সময় বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠে।

নর্মদার বাম তীরে প্রাচীন মামলেশ্বর মন্দির। এইখানে শিবের মন্দিরের দেয়ালে যে-পবিত্র শিলালিপি দেখা যায়, সেগুলো ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দের। এগুলি প্রাথমিক মধ্যযুগের সময়কালের মালওয়াদের রাজধানীর অংশ বলে মনে করা হয়। ১৮০০ শতাব্দীর সময় মারাঠারা অনেক মন্দিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায় মহারানি অহিল্যাবাই হোলকার নাকি এই মন্দিরগুলি তৈরির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

(চলবে..)