• facebook
  • twitter
Thursday, 23 January, 2025

আড়ালে থেকে গিয়েছে নেতাজির আত্মসংযম ও আত্মশোধনের কথা

স্কুলে পড়ার কালেই সুভাষচন্দ্রের সংযমী জীবন প্রেসিডেন্সি কলেজে আসার পর আরও তীব্রতা লাভ করে। ১৯১৩-এ ম্যাট্রিক পরীক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

নেতা থেকে নেতাজির বিস্তার সুগম ছিল না। তার সঙ্গে সর্বভারতীয় পরিচিতি থেকে সর্বজনীন শ্রদ্ধা লাভ করা আরও দুরূহ, আরও দুর্গম। সেই কণ্টকিত দুর্গম পথ বেয়েই সুভাষচন্দ্র বসুর উৎকর্ষমুখর উত্তরণ আমাদের বিস্মিত করে, আমাদের আলো দেখায়। সেবা ও সাধনার পথে তাঁর ঋষিসুলভ আত্মত্যাগ ও প্রজ্ঞাদীপ্ত বলিষ্ঠ নেতৃত্বই তাঁকে জননন্দিত নেতাজিতে পরম শ্রদ্ধেয় করে তুলেছে। সেখানে তাঁর চরিত্রের আলোই সময়ান্তরে মশাল হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্র বসুর অতুলনীয় আত্মসংযমের সাধনার আলোতে দেশবাসী আজও আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজিকে আজও শয়নে স্বপনে খুঁজে চলে নিরন্তর। তাঁর অদম্য লড়াকু প্রকৃতির মধ্যেই বাঙালি তার প্রত্যাশিত বীরকে খুঁজে পেয়েছে, দেশ দেখেছে তার দেশনায়ককে। আসলে বাঙালির মনীষার অভাব নেই, বরং তার বৈচিত্রমুখর প্রকৃতি পৃথিবীর যে কোনো জাতির সমীহ আদায় করতে পারে। উনিশ শতকেই বাঙালি মনীষার প্রাচুর্যই তার নবজাগরণের আলো হয়ে ওঠে। নীরবে কর্মসাধকের ভূমিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের পরিচয় যেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তেমনই সরবে বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবও ছড়িয়ে পড়ে। ত্যাগ ও সেবার ব্রতে দুজনেই সামিল হলেও দুজনের প্রকৃতি ভিন্ন। দুজনেই আবার বীরত্বের মহিমায় বাঙালি বন্দিত। বীরসিংহের সিংহশিশুটি অপরাজেয় শক্তিতে আজীবন মানুষের সেবায় আত্মনিবেদিত মহাপ্রাণ। অন্যদিকে বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ শুদু বিশ্বকে জয় করেননি, বাঙালির মননবিশ্বে অকুতোভয়ের জাগরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। তাঁর ‘মাভৈঃ, চরৈবেতি’ মন্ত্রে অর্থাৎ ‘ভয় নেই, এগিয়ে চলো’র বার্তা দেশোদ্ধারে মুক্তির সোপান হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে দুজনেই বাঙালি বীরের প্রতীকে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।

অথচ তখনও সশরীরে বাঙালির বীরের পরিচয় ছিল না। বাঙালির জাতীয়তাবোধের জাগরণে মারাঠা-রাজপুতদের মতো বাংলার ইতিহাসের আশ্রয়ে বীরদের তুলেধরার আয়োজন চলেছিল, তার মধ্যে সেই বীরের চেয়ে বীরত্বের কিছু নির্দশন উঠে এসেছে। এজন্য আধুনিকমনস্ক বাঙালির কাছে প্রকৃত বীরের প্রত্যাশা থাকলেও প্রতীক্ষা ছিল না। আসলে মননবিলাসী বাঙালির কাছে মনোবল যেভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, বাহুবল সেভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে। সেই মনোবল ও বাহুবলে বলীয়ান বীরের পরিচয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অপূর্ব মূর্তিই স্বাভাবিকভাবে সময়ান্তরে বাঙালিমানসে প্রতিমায় পরিণত হয়েছে। সেই বীরের আগমন অচিরেই স্বাধীনতা আন্দোলনে আবির্ভাব হয়ে ওঠে। অথচ বিষয়টি তত সহজসাধ্য ছিল না। সেই কঠিনের সাধনায় সুভাষের পথের দিশারি ছিলেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। সেক্ষেত্রে স্বামীজির আদর্শকে পাথেয় করে সুভাষের অভিযান যে সফল হয়েছিল, তা সারাদেশে তাঁর নেতাজির পরিচয় বিস্তারেই প্রতীয়মান। অন্যদিকে বীর সুভাষের রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দেশনায়ক’ (‘তাসের দেশ’ নাটকের উৎসর্গপত্রে) হয়ে ওঠার জন্যে আদর্শ বা মত স্বামীজির হলেও পথটি ছিল একান্ত নিজস্ব। শুধু তাই নয়, প্রথম থেকেই পরিকল্পনা করে তিনি যেভাবে জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন, তা শুধু সাধনাসাপেক্ষই নয়, বিস্ময়কর। অধিক সময় ব্যয় না করে সময়ের সদ্‌ব্যবহারের প্রতি প্রথমাবধি প্রখর আত্মসচেতন ছিলেন তিনি।

আহার, নিদ্রা ও মৈথুনের জীবন থেকে উত্তরণের প্রয়াসে তাঁর কঠোর সংযমী জীবনযাপন পালনের কথা সুভাষচন্দ্র নিজেই অকপটে ব্যক্ত করেছেন তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘An Indian Pilgrim’(১৯৩৭)-এ। লক্ষণীয়, পুণ্যকামী একজন ভারতীয় তীর্থযাত্রীর মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র তাঁর জীবনকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর মাত্রাতিরিক্ত আত্মসচেতনতাই তাঁকে যে ‘বালবৃদ্ধ’ ও ‘অকালপক্ব’ করে তুলেছিল, তা নিয়েও রসিকতা করেছেন সেখানে। প্রথমটির ক্ষেত্রে তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের ‘একটা অস্পষ্ট নৈতিক মূল্যবোধ’ সক্রিয় ছিল। প্রধান শিক্ষকের কাছেই তিনি সৌন্দর্যবোধ ও প্রকৃতিপ্রেমের দীক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু পার্থিব ব্যবহারিক জীবনের প্রতি আকর্ষণই তাঁকে উন্নততর জীবনের পরিপন্থী মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বয়ঃসন্ধিকালের স্বাভাবিক যৌনচেতনাও তাঁর কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। শুধু তাই নয়, তাতে চারিত্রিক দুর্বলতা খুঁজে পেয়ে তার দমনে সক্রিয় হয়েছিলেন সুভাষ।

এজন্য অবশ্য তিনি পরবর্তীতে আফশোস করেও বিরূপতা প্রকাশ করেননি, বরং নদীর সাগরে মেলার আনন্দ প্রকাশ করেছেন। ততদিনে অস্থির মন নিয়ে পার্থিব কামনাবাসনাময় জীবন থেকে উত্তরণের দিশায় অজ্ঞাতে খুঁজে চলা থেকে পাশের আত্মীয়ের বাড়িতে বই দেখতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলীর মধ্যে তার হদিশ মেলা সবই ঘটে গেছে সুভাষচন্দ্রের। তিনি সেই প্রাণসঞ্জীবনী বিশল্যকরণী প্রাপ্তির কথা দ্বিধাহীন চিত্তে জানিয়েছেন : ‘প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমার মধ্যে সৌন্দর্য ও নীতিবোধ জাগ্রত করেছিলেন, আমার জীবনে নতুন এক শক্তি এনে দিয়েছিলেন, কিন্তু এমন কোনও আদর্শ তাঁর কাছ থেকে লাভ করিনি, যার জন্য সমগ্র সত্তাকে আমি উৎসর্গ করতে পারি। বিবেকানন্দ আমাকে তাই এনে দিলেন।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বামীজির দেহত্যাগের সময় সুভাষচন্দ্রের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর। সদ্য পনেরোতে এসে কৈশোরোত্তীর্ণ সুভাষচন্দ্র স্বামীজির রচনাবলির মধ্যে তাঁকে খুঁজে পেয়েছেন। সেই স্বামীজিই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। অচিরেই তিনি বিবেকানন্দ থেকে রামকৃষ্ণে পৌঁছে যান। তাতে তাঁর সংযমী জীবনের লড়াই আরও তীব্র হয়। তাঁর কথায় : ‘রামকৃষ্ণের ত্যাগ ও শুদ্ধতার দৃষ্টান্তের ফল হয়েছিল এই যে, আমার সমস্ত কুপ্রবৃত্তির (যৌনপ্রবৃত্তি) সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

আর বিবেকানন্দের আদর্শ প্রচলিত পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে আমার সংঘর্ষ ডেকে এনেছিল।’ যৌনচেতনা দমনে তাঁর অতিসক্রিয়তা নিয়ে সুভাষচন্দ্র স্বাভাবিকভাবেই আত্মসচেতনতা ফিরে পেয়েছিলেন। এজন্য তা নিয়ে বাড়াবাড়ি মনে হলে তার প্রয়োজনকেও অস্বীকার করেননি। তাঁর কথায় : ‘নতুন করে আবার যদি আমার জীবন শুরু করতে পারতাম তা হলে খুব সম্ভবতঃ আমি যৌন বিষয়ে অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করতাম না, বাল্যে ও যৌবনে যা করেছি। এর অর্থ এই নয় যে যা করেছি তার জন্য অনুতাপ করেছি। যৌন-সংযমকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে যদি কোনও ভুল করে থাকি, সে ভুলে সম্ভবতঃ আমার ভালই হয়েছে, কেননা এর ফলে ঘটনাচক্রে হলেও আমি উপকৃত হয়েছিলাম। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, এর ফলে নিজেকে এমন একটা জীবনের জন্য তৈরি করে তুলেছিলাম যা চিরাচরিত পথ ধরে চলবে না এবং যাতে স্বাচ্ছন্দ্য, সুখ ও নিজের বৈষয়িক উন্নতির কোনও স্থান নেই।’ সুভাষচন্দ্রের এরূপ ধারণার মধ্যেই তাঁর পরিকল্পিত জীবনের ছায়া কায়া বিস্তার করে।

স্কুলে পড়ার কালেই সুভাষচন্দ্রের সংযমী জীবন প্রেসিডেন্সি কলেজে আসার পর আরও তীব্রতা লাভ করে। ১৯১৩-এ ম্যাট্রিক পরীক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর বাবা জানকীনাথ বসুর সুযোগ্য হয়ে দেশসেবার কথা তাঁর মনে ধরেছিল। এজন্য পড়াশোনাতেও তাঁর ফাঁকি ছিল না। শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষা যাতে তাঁর জীবনের উত্তরণকে সহজ করে তোলে, সেদিকেও সুভাষের পরিকল্পনামাফিক চিন্তাভাবনা সক্রিয় ছিল। তাঁর সেই লক্ষ্যভেদী জীবনকে তিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, যা তাঁর গভীর অধ্যাবসায় ও নিবিড় সাধনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর কথায় : ‘যখন স্কুল ছাড়লাম তখন যদিও দারুণ এক পরিবর্তনের ঝড় আমার মধ্যে বইছিল, তবুও ইতিমধ্যেই নিজের সম্বন্ধে আমি কতকগুলি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত করে ফেলেছিলাম। যাই হোক না কেন, গতানুগতিক পথে আমি চলব না, আমার জীবনের ধারা হবে এরকম যা আমার আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও মানব সমাজের উন্নতির সহায়ক হবে। আমি দর্শন নিয়ে গভীরতর পড়াশোনা করব যাতে জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারি; বাস্তব জীবনে যতটা সম্ভব অনুসরণ করব রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে এবং কোনও মতেই ব্যবহারিক জীবনের দিকে আমি যাব না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বামীজিও দর্শন নিয়ে কলেজে পড়েছেন। অন্যদিকে এভাবে সুভাষচন্দ্র ‘ব্যবহারিক জীবন’ বিমুখ হয়ে যেভাবে দৃঢ় সঙ্কল্পের মাধ্যমে স্বীয় লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, তার মধ্যে তাঁর মানসিক প্রস্তুতিই শুধু নয়, স্বামীজির আদর্শের পূর্ণ রূপায়ণও নিজের জীবনেই প্রতিফলিত করায় মনস্থির করেছিলেন। আসলে তিনি স্বামীজির মধ্যেই তাঁর আদর্শ খুঁজে পেয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, বিবেকানন্দের রচনাবলিতে অন্য জীবনের দিশা পেলেও সুভাষচন্দ্র কলেজে পড়ার সময়েও যথারীতি গুরু খুঁজে ফিরেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯১৪-তে গরমের ছুটিতে বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বন্ধুর সঙ্গে তিনি তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন এবং সাধুসন্ন্যাসীদের শুচিবায়ুগ্রস্ত মনের পরিচয়ে ও ভণ্ডামির মুখোশ দেখে মোহভঙ্গ হলে ঘরে ফিরে আসেন। সেক্ষেত্রে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছিল। তাঁর কথায় : ‘অধিকতর জ্ঞান লাভ করে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম এবং সন্ন্যাসী ও সংসারত্যাগীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেকখানিই হ্রাস পেয়েছিল। ভালই হয়েছিল যে নিজের কর্মের দ্বারাই আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম, কেন না এমন অনেক কিছুই আছে যা আমাদের শিখতে হয়।’ এই শেখার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও সুভাষের সুযোগ্য হয়ে ওঠার মধ্যে তাঁর বিস্ময়কর নিষ্ঠা ও অমানুষিক আত্মত্যাগের পরিচয়ই তাঁকে অতুলনীয় মাহাত্ম্য দান করেছে। সুভাষচন্দ্রের কঠোর সাধনাই তাঁকে নেতাজি করে তুলেছে! নিজেকে গড়ে তোলার জন্য তাঁর ঋষিসুলভ বিরলপ্রায় মহাজীবনও আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়, আদর্শ নেতার রোল মডেল।