হঠাৎই ক্রিকেটের শহর হয়ে গেল কলকাতা। অবশ্য সেই উন্মাদনা এবং উৎসাহ সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেল না। এমনকি, ময়দানের বটতলায় টিকিট কেনার জন্য কেউই ছোটাছুটি করলেন না। এমনকি মহমেডান স্পোর্টিং মাঠের কাউন্টার থেকেও টিকিট কেনার যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়, তাও নেই। কোথাও দেখতে পাওয়া যায়নি ঘোড়পুলিশদের ছোটাছুটি। তবে, সূর্যকুমার যাদবরা যখন বাস থেকে নেমে ক্লাব হাউসের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন, তখন দেখা গেল, ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কিছু মানুষ হইহই করে ওঠে। কিন্তু এই রকম দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। আসলে বুধবার ইডেন উদ্যানে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নামবেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু এই খেলা দেখার জন্য এমন কোনও আগ্রহ চোখে পড়ল না। তবে মানসিক দিক দিয়ে তৈরি হয়েছেন ভারতের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব ইংল্যান্ডকে পরাস্ত করার জন্য।
সাংবাদিক বৈঠকে বেশ জমাটি কথার মধ্যে দিয়ে সূর্যকুমার যাদব বললেন, আমি কোনও দলকেই ছোট করে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি না। কে বা কারা বলছেন ইংল্যান্ড দলের সেই দাপট নেই। দাপটের প্রশ্ন নয়, আসল কথা হল, মাঠে লড়াই। কে শক্তিশালী বা কে দুর্বল এটা ভাবার কোনও জায়গা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন লড়াই হয়, তখন দুই পক্ষের সেনারা চেষ্টা করেন নিজের দখলে নিয়ে নিতে। ঠিক সেই রকমই ভারতীয় দল অবশ্যই চেষ্টা করবে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা তুলে নিতে। তাহলে কি সহজভাবে ম্যাচ জেতার লক্ষ্যে ছক কষবেন? তার উত্তরে অধিনায়ক সূর্যকুমার বলেন, ছক কষাটা অন্য কথা। মাঠের পরিবেশ এবং উইকেট দেখে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে হয়। অর্থাৎ ওই লড়াইয়ে কীভাবে জিততে হবে, ঠিক সেইরকমই খেলতে হবে প্রত্যেককে। উইকেট যদি বোলারদের জন্য হয়, তাহলে বোলারদের বাড়তি সুবিধা থাকে। কিন্তু অনেক সময় বোলাররাই পিচ ভেঙে দেন। তখন কিন্তু অন্যরকম ঘটনা ঘটে যায়। আর সেই মুহূর্তে ব্যাটসম্যানরা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে রান করে থাকেন। আপনার দলের ভারতীয় দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্স দলের অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ডিয়া রয়েছেন। কিন্তু আপনার অধিনায়কত্বে খেলতে হবে। আবার সহঅধিনায়ক হার্দিক পাণ্ডিয়াকে না করে অক্ষর প্যাটেলকে করা হয়েছে, তাতে কি কোনও অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে আপনাকে? সূর্যকুমার এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, আপনাদের কোনও অসুবিধা না হলে আমারও কোনও অসুবিধা হবে না। মুম্বই দলে দীর্ঘদিন খেলেছি একসঙ্গে। হার্দিক পাণ্ডিয়ার টেম্পার্টমেন্ট আমার জানা আছে। তিনিই তো মাঠের অধিনায়ক। আর অক্ষর নিজেকে তৈরি করছেন। বেশ ভালো লাগছে। সব মিলিয়ে বলতে পারি, সবাই দেশের জন্য খেলবেন, এটাই তো বড় কথা। তাই কাউকে আলাদা করে ভাবার কোনও কারণ নেই। রিঙ্কু সিংয়ের কথা উঠতেই সূর্যকুমার বললেন, ও তো কলকাতারই ছেলে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে মনকাড়া সব ম্যাচ খেলেছে। চার বা ছক্কা দেখে দর্শকরা উৎফুল্ল হয়েছেন। আমিও চাইব, সীমিত ওভারের খেলায় দুরন্ত ভূমিকা নিয়ে রিঙ্কু ছক্কা মারুক আর ম্যাচটা আমাদের হাতের কোঠায় চলে আসুক।
তরুণ ক্রিকেটাররা এবারে জায়গা পেয়ে গেছেন ভারতীয় দলে। এই ভারতীয় দল আপনার কাছে নতুন উদ্দীপনার কথা বলতে পারবে? তার উত্তরে হাসতে হাসতে বললেন, আপনারাই বলুন না, এই ভারতীয় দল আপনাদের ভালো লাগছে কিনা? মাঠে যখন নামব, তখন কিন্তু ক্রিকেটকে ভালোবেসেই দেশের জন্য খেলব। তরুণ প্রতিভাদের বিকাশ ঘটানোটাই তো একটা নতুন দিক উন্মোচন হয়। আমি যখন শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিলাম, তখন কিন্তু আমি একেবারে আনকোড়া ছিলাম। তারপরে বাংলাদেশ সফরেও গিয়েছিলাম। তখনও কিন্তু নতুন খেলোয়াড় হিসেবেই আমার পরিচয় ছিল। কলকাতার ইডেন উদ্যানেও খেলেছি। ধীরে ধীরে বেশ কয়েকটা বছর পার করে ফেলেছি ক্রিকেট মাঠে। তবুও আমি এখনও পরিণত ক্রিকেটার হতে পারিনি বলে মনে করি। কিন্তু কলকাতার ইডেন উদ্যানে অনেক ইতিহাস রচনা হয়েছে। সেই ইতিহাসের কথা মনে করেই নতুন অধ্যায় নিজেদের নাম লেখাতে চাই। মহম্মদ শামি দলে ফিরেছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত? অবশ্যই একটা ভালো দিক বলে সূর্যকুমার যাদব বলেন। এই মুহূর্তে বিশ্বে দ্রুতগামী বোলার হিসেবে প্রথম সারিতে থাকেন শামি। সেই শামিকে পেয়ে আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। তারপরে ইডেন উদ্যানে তিনি বলত করতে ছুটবেন। তাঁর একেবারে পরিচিত জায়গা। তারপরে দর্শকদের সমর্থন তাঁকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে। তাই বলতে দ্বিধা নেই, শামির উপরে দলের ভাগ্যটা অনেকটাই নির্ভর করবে।
উইকেট রক্ষক হিসেবে সঞ্জু স্যামসনকে খেলাবেন? নিশ্চয়ই। তিনি একজন দক্ষ উইকেটরক্ষক। এটা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সঞ্জু না থাকাটা আপনাকে ভাবিয়েছে? দুটো টুর্নামেন্টের চরিত্র দুইরকম। সেখানে নিশ্চয়ই নির্বাচক, কোচ এবং অধিনায়কের সিদ্ধান্তকে এগিয়ে রাখতে হয়। তাই এই বিষয়ে বলার মতো কোনও জায়গা নেই। তিলক ভার্মা, ওয়াশিংটন সুন্দর, হর্ষিত রানা ও আর্শদীপ সিংয়ের সঙ্গে আপনার একাত্মটা বেশ ভালো। এই প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে সূর্যকুমার বললেন, আমরা তো একটা পরিবার। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই জেতার রশদ জোগায়। সেইভাবেই খেলতে হবে।
সবাইকে হাত নেড়ে যখন সাংবাদিক বৈঠক শেষে মাঠমুখী হলেন, তখন কোচ গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হয়তো কোনও খেলার ছকের বিশ্লেষণ করছিলেন। মাঠে নেমে তিনি আর্শদীপ সিংয়ের সঙ্গে হালকা চালে কথা বলতে দেখা গেল। অনুশীলনের মাঝেই সূর্যকুমার হিন্দি কথা বলতে বলতে একটু বাংলাও বললেন। এটা অনেকটা হরভজন সিংয়ের মতো ব্যবহারটা চোখে পড়ল। হরভজন যেমন কলকাতায় আসেন খেলার জন্য, তখন তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় দর্শকদের মন জয় করে নিতেন। এটাও অনেকটা সেইরকম পরিবেশ তৈরি হল। সূর্যকুমার এগিয়ে যান আর্শদীপের কাছে। কাছে গিয়ে অধিনায়ক বললেন, পাজি ভালো। তার উত্তরে আর্শদীপও বললেন, ভালো আছি। অর্থাৎ বোঝাই গেল, এই কয়েকদিনের মধ্যেই আর্শদীপ কয়েকটা বাংলা কথা শিখে ফেলেছেন। তাই খোলামেলা মেজাজে দুই ক্রিকেটার অনুশীলনের মাঝে কথা বলে নিলেন।
এদিকে ইংল্যান্ড দল দুপুরে অনুশীলনটা সেরে নেয়। দলের অধিনায়ক জস বাটলার মনে করেন, ইডেনের উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্যই তৈরি হয়েছে। তবে, পেস বোলার গাস অ্যাককিনসন দলে ফেরাতে সতীর্থ খেলোয়াড়রা খুব খুশি। তার প্রধান কারণ হল উইকেট যদি পেস বোলারদের জন্য তৈরি হয়, তাহলে আক্রমণে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন তিনি। এ বদেও পেসার জো আর্চার, জেমি ওভারটন এবং মার্ক উডের মতো বোলররা রয়েছেন। তাঁদের দুরন্ত বোলিংয়ে ভারতীয় দলকে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়াও এই দলে রয়েছেন স্পিনার আদিল রশিদ। তাহলে কি ধরেই নেওয়া যেতে পারে ইডেনের উইকেট পেস বোলারদের জন্যই তৈরি হয়েছে? অধিনায়ক জশ বাটলার, বেন ডাকেট, ফিল সল্ট ও লিয়াম লিভিংস্টনরা বড় ভূমিকা নিয়ে স্কোরবোর্ডকে উজ্জ্বল করার জন্য চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখবেন না। মনে করা হচ্ছে, প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কে এগিয়ে থাকবেন, তা নিয়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা কোনও মন্তব্য করতে পারছেন না। আসলে ভারতীয় দলে তরুণ ব্যাটসম্যানদের ভূমিকার উপরেই ভাগ্য নির্ভর করবে জয়ের জন্য। আবার ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররাও নিজেদের বুঝে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। সব মিলিয়ে বলতে পারা যায়, খেলাটা শেষ মুহূর্তে রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির জায়গায় পৌঁছতে পারে।
সম্ভাব্য ভারতীয় দল— সূর্যকুমার যাদব (অধিনায়ক), নীতীশকুমার রেড্ডি, সঞ্জু স্যামসন (উইকেট রক্ষক), অভিষেক শর্মা, তিলক ভার্মা, হার্দিক পাণ্ডিয়া, রিঙ্কু সিং, বরুণ চক্রবর্তী, অক্ষর প্যাটেল (সহ-অধিনায়ক), মহম্মদ শামি ও আর্শদীপ সিং।
সম্ভাব্য ইংল্যান্ড দল— জস বাটলার (অধিনায়ক), বেন ডাকেট, ফিল সল্ট (উইকেট রক্ষক), হ্যারি ব্রুক, লিয়াম লিভিংস্টন, জ্যাকব বেথেল, জেমি ওভারটন, গাস অ্যাটকিনসন, জোফরা আর্চার, আদিল রশিদ ও মার্ক উড।