• facebook
  • twitter
Friday, 17 January, 2025

অহলদারার অলীক সৌন্দর্য

কার্শিয়াং জেলার অন্তর্গত শেলপু পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত অহলদারা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একই সফরে দেখে নিন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত মংপু। লিখছেন নন্দিতা মিত্র।

রোজনামচা জীবনে একটু সময় আর সুযোগ পেলেই মন অজান্তেই যেন দুটো ডানা মেলে দেয়। মেঘের পালকে ভেসে গিয়ে পড়তে চায় সেই পাহাড় চূড়ায়, যেখানে মনের মধ্যে জমে থাকা সব ক্লান্তি, মলিনতা, জড়তা মুছে যায়।

রাতের দার্জিলিং মেলে সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে, ব্যস্ত শিলিগুড়ি শহরকে পিছনে ফেলে আমরা মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। কালিঝোরা পৌঁছে বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে উত্তরের বন্ধু তিস্তাকে সঙ্গে নিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। বর্ষায় সে গেরুয়াবর্ণা হলেও শরতে তিস্তার রঙ পান্না-সবুজ। এ যেন একেবারে মেটামরফোসিস!

হিমালয়ের সর্পিল চড়াই পথে পাড়ি দেওয়া শুরু করতেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হিমেল হাওয়া। পেরিয়ে যেতে থাকি রাস্তার পাশের পাহাড়ি লাল, নীল, বেগুনি, কমলারঙা বাড়িগুলো। বাড়ির সামনে ও উঠোন উপচে রঙবেরঙের ফুল। সেবক ব্রিজকে একপাশে রেখে কালিঝোরা, বিরিকধারা হয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে, শেলপু পাহাড়ের অভিমুখে গাড়ি ছুটতে থাকে। একটু পরে পৌঁছে গেলাম ‘কমলালেবুর গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত সিটং-এ। শীতকালে এখানে চারপাশ কমলা রঙে রঙিন হয়ে ওঠে।

এক রাত সিটংয়ে কাটিয়ে পরের দিন খুব ভোরে রওনা দিলাম অহলদারার দিকে। কার্শিয়াং জেলার অন্তর্গত শেলপু পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত অহলদারা, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাকদণ্ডী পথ বেয়ে গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। হাত বাড়াচ্ছে মেঘ, গোটা পথ জুড়ে পাইন, ধুপি আর জুনিপারের ছায়া। মাঝে মাঝে খাদের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে অতলান্ত সবুজ। এই সবকিছু সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রায় ৪৫০০ ফুট উচ্চতার নির্জন পাহাড়ি জনপদ অহলদারায়। গাড়ি পার্কিং এলাকা থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হয়। এবার এমন একটি জায়গায় পৌঁছলাম, যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় ৩৬০ ডিগ্রির নজরমিনার থেকে গোটা পৃথিবীকে যেন দেখছি। প্রচন্ড জোরে হিমেল বাতাস বইছে। তবুও ছেড়ে যেতে এক মুহূর্ত ইচ্ছে করছে না। কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর সূর্যের আলোর ঘন ঘন রূপ পরিবর্তন হচ্ছে! মুহূর্তে মুহূর্তে ভোল বদল হয়ে কখনও গোলাপি, রক্তিম লাল, কমলা, সোনালি, হলুদ তারপর একেবারে শেষে রজতশুভ্র রং ধরছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। মনে হয় পৃথিবীর শেষ সীমায় এসে উপস্থিত হয়েছি। এরপরেই শান্ত আকাশ আর পাহাড়ের সীমান্ত শুরু। ভিউ পয়েন্ট থেকে নিচের দিকে তাকালে ছবির মতো সাজানো তিনটি কটেজ চোখে পড়ে। মনে মনে ভাবলাম এখানে রাত কাটানো এক ঈর্ষণীয় ব্যাপার। কোনও একদিন এই কটেজে এসে এক রাত কাটিয়ে যাব, প্রতিশ্রুতি দিই অহলদারাকে।

আশেপাশে পাহাড়, উপত্যকা, তিস্তা নদী আর চা-বাগানের ঢাল, পাহাড়ের উঁচু টিলায় সূর্যোদয় দেখার নজরমিনার আর মাথার ওপরে ছাউনি দিয়ে বসার জায়গা করা রয়েছে। যেদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় তার ঠিক উল্টোদিকের অন্যান্য পাহাড় আর তার দৃশ্যপট অদ্ভুত সুন্দর। ভিউ পয়েন্ট থেকে দূরে একটি টিলা, সাদাদাড়ি সমেত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখাবয়বের মতো দেখতে লাগে বলে, পর্যটক মহলে ইদানীং একে ‘টেগোর নোজ’ বলার রীতি চালু হয়েছে।

মেঘমুক্ত দিন বলে এখান থেকে কালিম্পং, সিকিমের কিছু অঞ্চল, বাগোড়া, তিনচুলে, তিস্তা নদী ও তার উপত্যকার অপরূপ দৃশ্যাবলী পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। অহলদারার একমাত্র মালিকানা ঘুমন্ত বুদ্ধের। তাঁর সৌম্যকান্তি রূপ দেখে চোখ ফেরানো মুশকিল। স্থানীয় এক হোমস্টের মালিকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ২০০৬ সালে নরবাহাদুর ভুজেল নামে এক ব্যক্তি অহলদারার খাসমহল পুরোটাই কিনে নেন। এই পাহাড়ি অঞ্চলে বর্তমানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোক মিলেমিশে বসবাস করেন।

সিটং থেকে অনেক ভোরে বেরিয়েছি বলে হাতে আজ আমাদের অফুরন্ত সময়। অহলদারার প্রাকৃতিক দৃশ্য মন-প্রাণ ভরে উপভোগ করার পর চলে যাই নামথিং পোখরি নামে একটি জলাশয়ে। ‘পোখরি’-র অর্থ পুকুর। বিলুপ্তপ্রায় হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডারের নিভৃত বাসভূমি বলে এলাকাটি বিশেষভাবে পরিচিত। প্রবেশপথের বোর্ডে বিজ্ঞপ্তি লেখা ‘এই জলাশয় প্রাকৃতিক প্রাণীটির নৃতাত্ত্বিক স্বাভাবিক আবাস। এখানে অ-অনুমোদিত কার্যকলাপ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গ্রাহ্য হবে।’

চারপাশ নিস্তব্ধ। একটা গা-ছমছমে ভাব। লেকের পাশে পাইন বনের পাশের কাঁচারাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে লেকের একদম ধার অবধি যাওয়া যায়। আসলে উভচর স্যালামান্ডার, সেই ডাইনোসরের আমল থেকে এখনও টিকে রয়েছে। স্থানীয়দের মতে বর্ষার জলে টইটম্বুর হয়ে যখন নামথিং পোখরি ভরাট হয়ে যায়, তখন মাঝে মাঝে এদের হয়তো বা দেখা মেলে। তবে আমাদের ড্রাইভার দাদা বললেন, নেপালে ভূমিকম্পের সময় থেকে এই পোখরি একদম শুকিয়ে গেছে এবং তারপর থেকেই এই প্রাণীদের আর দেখা পাওয়া যায় না।

অহলদারা থেকে কিছুটা দূরেই বৌদ্ধদের একটি প্রাচীন গুম্ফা। মাটি আর পাথরের দ্বারা নির্মিত প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো এই লেপচা বৌদ্ধ-মঠটি আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও, এর ভাবগম্ভীর পরিবেশ মুগ্ধ করে। ভেতরে নিংমা ধারার মূর্তি। পাশেই রয়েছে একটি চা-বাগান। চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা ট্রেকিং করে গেলে ‘পাঁচপোখরি’ নামে একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছনো যায়। স্থানীয়দের কাছে এই জায়গা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আকাশের ব্যাকরণ এখানে খুব ঘন-ঘন বদলায়। মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশা আর রোদ্দুরের এই বহুরূপী স্বভাবই যে-কোনও পাহাড়ের নিজস্ব অলংকার। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর সামনে পড়ল একটি ব্রিজ আর তার নিচ দিয়ে কুলু কুলু ধ্বনিতে বয়ে চলেছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী। জায়গার নাম যোগীঘাট আর নদীর নাম রিয়াংখোলা। নদীর উপর শতাব্দী প্রাচীন কাঠের ঝুলন্ত সেতু, পাশে নবনির্মিত ব্রিজ। নদীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথোপকথন সেরে চলে গেলাম অর্কিড গার্ডেনে।

এখানকার কেয়ারটেকার জানালেন, এ বছর গার্ডেনে অর্কিডের সংখ্যা কম। তবু যা দেখলাম, তাতেই মন ভরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম মংপুর ‘রবীন্দ্রভবন’। পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এই ছোট্ট গ্রামটি সিঙ্কোনা চাষের জন্য বিখ্যাত হলেও, বাঙালির কাছে আবেগের এক হিমেল ঠিকানা। কবিবন্ধু সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ীদেবীর আমন্ত্রণে, কবি এখানে মোট চারবার এসেছিলেন ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত। পরে আরেকবার আসার ইচ্ছে থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য আর আসতে পারেননি।

মৈত্রেয়ীদেবী কবির সঙ্গে তাঁর সেই অবকাশ যাপন অত্যন্ত সুমধুর ভাষায় চমৎকার লিখনশৈলীতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তাঁর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। কাচের দরজা-জানলা দেওয়া দুধসাদা বাড়ি। প্রবেশপথের বাঁদিকে কবিমূর্তি। সবুজ লন পেরিয়ে লম্বা টানা বারান্দা। বারান্দায় একটি আরামকেদারায় সাদা চাদরের উপর তাঁর ছবি। সামনে ফুলের অর্ঘ্য, সুগন্ধী ধূপ। এখানে কবি প্রতিদিন ভোরবেলা শান্ত সমাহিত চিত্তে ধ্যানে বসতেন।

১৯৪০ সালের ২৫ বৈশাখ জন্মদিনের দিন, গুরুদেব এখানেই রচনা করেছিলেন ‘জন্মদিন’ কবিতাটি। এখানে থাকাকালীন লিখেছিলেন ‘শেষকথা’, ‘আকাশপ্রদীপ’, ‘নবজাতক’, ‘বাংলা ভাষার পরিচয়’ ইত্যাদি। তাঁর আঁকা ছবি, চেয়ার-টেবিল, বিছানা, আঁকার সরঞ্জাম সবই সযত্নে রাখা আছে। ছবির সামনে পড়ে কিছু ক্যামেলিয়া। এ বাড়ির গাছটিকে নিয়েই কবি লিখেছিলেন ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি। সামনের বারান্দায় বসে লিখেছিলেন ‘মংপু পাহাড়ে’। তাঁর নিজের হাতে লাগানো সপ্তপর্ণী গাছটি আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখান নেপালি কেয়ারটেকার শিশির রাউত, যাঁর ঠাকুরদা ছিলেন কবির এখানে প্রথমবার আসার এক পালকিবাহক। তিনি কথা বলতে বলতে কখনও চোখ বুজে কবিতা আওড়ান, কখনও গেয়ে ওঠেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী….’। শিশিরবাবুর ভাঙা ভাঙা শব্দের সেই গানের রেশ নিয়ে এগোতে থাকি নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনের দিকে।