• facebook
  • twitter
Wednesday, 15 January, 2025

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থানই নিয়েছে ভারত

'নিরাপত্তার জন্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। আশাকরি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়া বাস্তবায়িত হবে।'

প্রতীকী চিত্র

সৈয়দ হাসমত জালাল

গত আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নানান প্রশ্ন এবং সেইসঙ্গে নানান গুজবও ছড়িয়েছে। এর জন্যে অবশ্যই দায়ী বাংলাদেশের কিছু অবিমৃষ্যকারী রাজনৈতিক লোকজন। বিশেষত সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু অপরিণতমনস্ক উপদেষ্টা এবং বিএনপির কোনও কোনও উচ্চ পর্যায়ের নেতা, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিকরাও। তাঁরা ভারত-বিদ্বেষ ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন এলাকা দখল করবেন বলে হুমকি দিচ্ছিলেন। যে কোনও সুস্থ রাজনীতিবোধ সম্পন্ন মানুষই বুঝেছেন, তাঁদের এই হুমকি কতখানি হাস্যকর।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু নির্যাতনের খবর ক্রমাগত ভারতে এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই নির্যাতনের কথা অস্বীকার করা হলেও শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার এ কথা অনেকটা স্বীকার করে নিয়েছে। সব মিলিয়ে গত ৫ আগস্ট থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩৪টি সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। সেগুলির ভিত্তিতে ৫৩টি মামলা দায়ের হয়েছে ও ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, ওপারের হিন্দু ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদ এপারে কোনও কোনও মাধ্যমে অতিরঞ্জিত আকারে প্রচার করা হয়েছে। তাতে এপারের সীমান্ত এলাকায়, বিশেষত যাঁদের আত্মীয়-স্বজন ওপারে রয়েছেন, তাঁরা অত্যন্ত শঙ্কিত বোধ করেছেন। এর সুযোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলটিও। রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে দেখা গিয়েছে, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের সদস্য ও কর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশ করতে এবং সেইসব সমাবেশে তিনি যেভাবে সাম্প্রদায়িক ও একপেশে কথাবার্তা ছড়িয়েছেন, তা পশ্চিমবঙ্গের বৃহৎ সংখ্যক মানুষ পছন্দ করেননি। পছন্দ করেনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও। এবিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী বারবার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যেহেতু ভিন্ন একটি রাষ্ট্র, তাই এ ব্যাপারে ভারত সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাকেই তিনি সমর্থন করবেন। তবে অনেকে মনে করেছেন, রাজ্যের বিরোধী দলনেতার উস্কানিমূলক কথাবার্তাকে সংযত করার জন্য তাঁর দল বা দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের বার্তা দেওয়া উচিত ছিল।

এটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কথা। কারণ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক সব সময় কাম্য। বিশেষত, দুই বাংলার একই ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে যে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে দুই বাংলার মানুষ, তাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশেও এরকম ভাবনা-চিন্তা করা মানুষের অভাব নেই। কিন্তু সেইসব শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ আপাতত বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপের কারণেই এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। বেশ কয়েকমাস অতিবাহিত হওয়ায় পরিস্থিতি অনেকটাই বোধগম্য হয়ে উঠেছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়াকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হলেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আমাদের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর আধিকারিকদের বৈঠকে সে বাধাও অনেকটা দূর হয়েছে। রাজ্যের সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও চোরাকারবার ঠেকাতে কাঁটাতারের বেড়া যে দিতেই হবে, এ বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভারত। সম্প্রতি ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় বর্মাকে তলব করার পাল্টা হিসেবে দিল্লিও বাংলাদেশের হাই কমিশনার নুরুল ইসলামকে ডেকে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় প্রণয় বর্মা বলেছিলেন,’নিরাপত্তার জন্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। আশাকরি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়া বাস্তবায়িত হবে।’ এদিকে দিল্লিতে নুরুল ইসলামকে তলব করার পর ইউনুস সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকালই জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পরিস্থিতি স্থিতিশীল। তিনি দাবি করেন, সীমান্তে কোনও উত্তেজনা নেই। এক সাংবাদিক বৈঠকে জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘আগামী মাসে বিজিবি এবং বিএসএফ-এর বৈঠক রয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে আলোচনা হবে।’

এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হতে পারে, দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যেও এই উত্তেজনা ছড়িয়েছে কিনা! কিন্তু ১৩ জানুয়ারি ভারতের সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদী সেনাবাহিনীর বার্ষিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, দুই দেশের দুই সেনাপ্রধান নিজেদের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ভারত তাঁদের জন্য স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সীমান্তের প্রায় সব দিকেই রয়েছে ভারত। সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা পরস্পরের প্রতিবেশী, আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। সুতরাং যে কোনও ধরনের শত্রুতা আমাদের উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকারক।’

এদিন ভারতের সেনাপ্রধানের মুখেও এ কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমাদের কোনও পক্ষেরই আক্রান্ত হওয়ার কোনও কারণ বা সম্ভাবনা নেই এবং দুপক্ষই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।’ গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের সময় দুই দেশের সেনাপ্রধানের মধ্যে সম্পূর্ণ যোগাযোগ ছিল এবং শেখ হাসিনার ভারতে আসার প্রক্রিয়াটিও দুই দেশের সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে যোগাযোগ রেখেই সম্পন্ন হয়েছিল।

তবে এ কথাও ঠিক যে, ভারত সবসময়ই চায়, বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসুক। বর্তমানে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তার সাংবিধানিক বৈধতা ভারতের কাছে স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনে জিতে না-আসা পর্যন্ত এরকম একটি সরকারের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক কাজকর্মের পরিধি খানিকটা সীমিত রাখাই বাঞ্ছনীয়। এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে জানিয়ে দিয়েছে, ভারত সম্পূর্ণ সঠিক অবস্থানেই রয়েছে। জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর কথার মধ্যেও রয়ে গিয়েছে তারই সমর্থন।